Saturday, August 26, 2017

হজরত শাহ সূফী আমানত খান (র.)

হজরত শাহ সূফী আমানত খান (র.)
আলী ফোরকান 
তৎকালীন বাংলাদেশের মুর্শিদাবাদ, জাহাঙ্গীর নগর ও ইসলামাবাদ মুঘল আমলের শেষের দিকে সূফীদের আধ্যাত্মিক সাধনার কেন্দ্র হিসাবে ব্যাপক প্রসার লাভ করে। হজরত শাহ সূফী বখতেয়ার মাহি সওয়ার (র.) প্রমুখ আরবীয় সূফী ঐ সময় চট্টগ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। তাই চট্টগ্রাম সূফী সাধকদের প্রবেশ দ্বার রূপে চিরকাল চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
চট্টগ্রাম পাহাড় পর্বত ঘেরা নির্জন পরিবেশ মন্ডিত এলাকা। এ অঞ্চলের পশ্চিম তটে যেখানে বঙ্গোপসাগরের ফেনিল জলরাশি যুগ যুগ ধরে আছড়ে পড়ছে তার পিছনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধ্যানমগ্ন জালালাবাদ পাহাড়। চট্টগ্রামের এই প্রকৃতি পরিবেশ যেন রাব্বুল আলামীন শুধু সূফীদের আত্মিক ক্রিয়াকলাপের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করেছেন। তাই চট্টগ্রামের সাথে সূফী সাধকদের চমৎকার আধ্যাত্মিক ও জাগতিক যোগাযোগ লক্ষ্যণীয়।
কোন এক সময় কাদেরীয়া তরীকার প্রবক্তা প্রখ্যাত সাধক বড়পীর হজরত মহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানী (র.) এর বংশধর ভারতের বিহারে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। মরমীবাদের ব্যাপক প্রচারণা খোদা প্রেমিক পুরুষদের হৃদয়ে ভীষণভাবে নাড়া দেয়, ফলে বড়পীর ছাহেবের বংশোদ্ভূত ত্যাগী পুরুষ শাহ সূফী আমানত (র.) বিহার শরীফের নিজ পিত্রালয় ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক জগতের আকুল ইশারায় আত্মিক জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর কাশ্মীরের পথে চলে যান। এখানে এসে তিনি উপযুক্ত মুর্শিদের খোঁজ করতে থাকলেন নীরবে। কাশ্মীরের জনৈক বুজর্গ ব্যক্তি তাঁকে মহান অলী হজরত আবদুর রহিম শহীদ (র.) এর সন্ধান বলে দেন।
তাঁর কাছে জানতে পারলেন আবদুর রহিম শহীদ (র.) ঐ সময় লক্ষ্মৌ অবস্থান করছেন। অতঃপর লক্ষ্মৌ এসে জানতে পারলেন মাত্র অল্পকাল হলো তিনি মখসুসাবাদ (মুর্শিদাবাদ) চলে গেছেন। এর পর হজরত এল্ম মারিফাতের অমোঘ আকর্ষণে লক্ষ্মৌ থেকে মখসুসাবাদে এসে পৌঁছলেন। অতঃপর প্রেমাস্পদ তাঁর প্রিয়তমের সন্ধান পেলেন। হজরত আবদুর রহিম শহীদ (র.) এর কর চুম্বনের মাধ্যমে তিনি এল্ম মারিফাতে দীক্ষা গ্রহণ করলেন। সেই জ্যোতির্ময় পুরুষের সান্নিধ্য পেয়ে হজরত অত্যন্ত গৌরবান্বিত হলেন। মাত্র অল্পকাল মধ্যে তিনি মুর্শিদের সাহচর্য থেকে এল্ম বাতেন শাস্ত্রে চরমোৎকর্ষতা লাভ করে অফুরন্ত নেয়ামত হাসিল করলেন। পীর ছাহেব বুঝতে পারলেন শাহ আমানতের অন্তর আল্লাহ প্রেমের জোয়ারে পরিপূর্ণ এবং রাব্বুল আলামীনের সাথে মিলনাকাঙক্ষায় মন তাঁর উন্মুখ। এমন এক প্রেমাস্পদের সন্ধান পেয়ে মুর্শিদ অত্যন্ত আশান্বিত হলেন। একান্ত মনোযোগের সাথে তাঁকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা দান করতে থাকেন। হজরতের ঐশী ক্ষমতার ব্যাপকতা দর্শন করে মুর্শিদ তাঁকে কাদেরীয়া, নকশবন্দীয়া এবং মাদারীয়া তরীকায় খেলাফত প্রদান করতঃ বিবাহিত জীবন যাপনের মাধ্যমে হালাল উপার্জন করার উপদেশ দিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় শহর চট্টগ্রাম যেতে নির্দেশ দিলেন। চট্টগ্রামের আত্মিক জগতের কর্তৃত্বের ভার গ্রহণ করে শাহ সূফী আমানত খান (র.) অত্যন্ত ধন্য হলেন। এদিকে চট্টগ্রাম শহরে এসে তিনি সরওয়ারে কায়েনাত হজরত মুহাম্মদ মোস্তাফা (স.) এর সুন্নত পালনার্থে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে স্থানীয় আদালতে সামান্য একটি চাকরি জুটিয়ে নিলেন। (ঐ সময়কার নবাবী আমলের আদালতটি পরবর্তীকালে মোহসেনিয়া মাদ্রাসা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।) অতঃপর দিনের বেলায় হজরত আদালতের কাজে এবং রাত্রি বেলায় আধ্যাত্মিক সাধনায় ব্যাপৃত হলেন। আদালতে কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি এবাদত বন্দেগীর জন্যে একটি নিরিবিলি স্থানের খোঁজ করছিলেন। অতঃপর একদিন আন্দরকিল্লা পাহাড়ের পাদদেশে পীর বদরুদ্দিন আল্লামার সমাধির কিছুটা পশ্চিমে বদর পুকুরের পশ্চিম পাড়ে একটি নিরিবিলি স্থান নির্বাচন করে তথায় তিনি খানকাহ স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে ঐ স্থান খানকাহ আমানতিয়া নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
হজরত শাহ সূফী আমানত খান (র.) লোক চক্ষুর অন্তরালে আত্মিক কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে থাকেন। বস্তুতঃ তিনি সুন্নতের অত্যন্ত বিনয়ী অনুসারী ছিলেন বিধায় হালাল পন্থায় রোজগার করে জীবিকা নির্বাহের জন্য অত্যন্ত সচেষ্ট ছিলেন। তিনি সাধারণ লোকের মন জয় করতে পেরেছিলেন তাঁর নম্র ব্যবহার, পরম ধৈর্যগুণ এবং মৌনতার দ্বারা। তাই তাঁকে স্থানীয় বাসিন্দারা সমীহ করতেন তাঁর এ সমস্ত গুণাবলীর জন্যে।
মৌনতা, সরলতা এবং বিশ্বস্ততার কারণে স্থানীয় জনসাধারণের কাছে তিনি মিয়া ছাহেব নামে পরিচিত ছিলেন। কর্মক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ এবং নিরলস কর্মী। আদালতের সামান্য চাকরি গ্রহণ করে তিনি বড় ছোট ভেদাভেদ তুলে দিয়ে ইসলামের সাম্যতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। খেটে জীবিকার্জনের মাধ্যমে খোদার স্মরণ চালু রাখতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। একজন বেলায়েত প্রাপ্ত সূফী হয়েও সামান্য চাকরি গ্রহণ করে তিনি সুন্নতের প্রতি অসীম অনুরাগ দেখিয়েছেন।
হালাল পন্থায় উপার্জন তাঁর অসাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্টের পরিচায়ক। প্রায় সময় তিনি নীরবতা অবলম্বন করতেন বলে তাঁর চরিত্রের এক বিরাট অধ্যায় অজ্ঞাত রয়ে গেছে। নিজের কোন প্রকার প্রচারণাকে তিনি প্রাণভরে ঘৃণা করতেন। তাঁর কাছে আদবের অত্যন্ত সমাদর ছিলো কিন্তু বে আদবকে তিনি কখনো প্রশ্রয় দিতেন না।
মৌনপন্থী ছিলেন বিধায় সাধারণ মানুষ তাঁকে চিনতে পারেননি। কিন্তু অসহায় মানুষের মনোবেদনা তিনি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতেন। তিনি অত্যন্ত স্বল্পভাষী কোমল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। এমনই এক মাহেন্দ্রক্ষণে এক চরম অসহায় ব্যক্তিকে মামলার দলিলপত্র সংগ্রহে সাহায্য করতে গিয়ে জন সমক্ষে তাঁর আধ্যাত্মিক আভরণ প্রকাশ পেয়ে যায়। রুমাল দিয়ে নৌকা বানিয়ে চোখের পলকে দুর্গম সুমদ্রের শত মাইল পথ সংকুচিত করে মুহূর্তের মধ্যে মামলার কাগজপত্র সংগ্রহের অত্যাশ্চর্য্য ঘটনার কিংবদন্তি আজও বংশ পরম্পরায় চট্টগ্রামবাসীর মুখে মুখে উচ্চারিত।
ফারসী ভাষায় রচিত (ফিহা আইনুন জারিয়া, মাওলানা আহমদ উল্লাহ, পৃঃ ২৫ ঢাকা ১৯৭০) গ্রন্থ পাঠে জানা যায় যে, মুর্শিদ কেবলা হজরত আবদুর রহিম শহিদ (র.) তদীয় সুযোগ্য মুরীদ হজরত শাহ সূফী আমানত খান (র.)কে খেলাফত প্রদান করতঃ চট্টগ্রাম গিয়ে বিবাহিত জীবন যাপনের মাধ্যমে হালাল পন্থায় উপার্জনের নির্দেশ প্রদান করে নিজ ভ্রাতুষ্পুত্রসহ হিজরী ১১২০ সনে ঢাকার পথে রওয়ানা হন। সুতরাং এতে প্রতীয়মান হয় যে, এর পর পরই হজরত চট্টগ্রামে তশরীফ নিয়ে আসেন।
তদীয় একমাত্র ঔরশজাত পুত্র শাহজাদা মুহাম্মদ আনোয়ার খানকে খানকাহ শরীফ এবং নিজ বসতবাড়ীর তদারকীর ভার ন্যস্ত করে এই মহিমামন্ডিত সূফী তাত্ত্বিক হজরত শাহ সূফী আমানত খান (র.) ১২৫ বৎসর বয়সে (প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানীর মতে) ১১৮৭ হিজরীর ৩০শে জেলক্বদ খানকাহ্ শরীফে ইন্তেকাল করেন (আজিমপুর দায়েরা শরীফ পৃষ্ঠা–১১০ সৈয়দ শাহ আহমদুল্লাহ)।
পটিয়া থানার হরিণখাইন নিবাসী জনৈকা খোসা মাবুদী হজরতের দরবারে খেদমত করতেন। আবদুল ওয়াহাব নামে তাঁর অল্প বয়সী একটি ছেলে ছিলো। ছেলেটি অত্যন্ত ডানপিটে ছিলো। সে হজরতকে নানা সম্বোধন করতো। কথিত আছে যে, হজরতের রূহানী ফয়েজের প্রভাবে এই শিক্ষাবঞ্চিত গ্রামের ছেলেটি পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম শহরের স্বনামধন্য উকিল হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। উকিল ছাহেব মরহুম নানাজানের নির্দেশ রক্ষার্থে ওফাতের পূর্বে ১৮০৬ সনে হরিণখাইন গ্রামে একটি পাকা মসজিদ নির্মাণ করেন। বর্তমানে সেটি কুরা কাটনী মসজিদ নামে পরিচিত।
এতদঞ্চলে হজরতের অসংখ্য মুরীদ ছিলেন। তৎমধ্যে ঢাকাস্থ আজিমপুরা দায়রা শরীফের প্রখ্যাত বুজর্গ হজরত শাহ সূফী মুহাম্মদ দায়েম (র.) (ওফাত ১৭৯৩), মীরসরাই মাস্তান নগরস্থ হজরত শাহ সূফী কেয়ামুদ্দীন (র.) (ওফাত ১৭৯৬) এবং আনোয়ারা থানাধীন হজরত শাহ সূফী মিয়া হাজী দৌলত (র.) হজরতের অন্যতম খলিফা ছিলেন।
চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার ওশখাইন দরবার শরীফের প্রখ্যাত সূফী কবি হজরত আলী রেজা (র.) (ওফাত ১৮৩৭) তদীয় রচিত জ্ঞানসাগর নামক কাব্যগ্রন্থে নিজেকে হজরত কেয়ামুদ্দীন (র.) এর মুরীদ এবং হজরত কেয়ামুদ্দীন (র.)কে হজরত শাহ আমানত খান (র.) এর মুরীদ হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
তিনি লিখেছেন, ‘শাহে আলী রেজা জ্ঞান সিদ্ধাবতার।/ তার গুরু কেয়ামুদ্দীন আউলিয়া সর্দার।/ তার গুরু হজরত আমানত নমায়ী খান/ তার গুরু খাজা আবদুর রহিম মগফুর’। (জ্ঞান সাগর পৃঃ ১৩৬, সম্পাদনা এস.এম. আবদুল আলীম)। পাটনাস্থ ফুলওয়ারী শরীফের প্রখ্যাত বুজর্গগণ, মিথিন ঘাটস্থ হজরত মুন এম পাক বাচ (র.) হজরত খলিল বিহারী (র.) এবং ঢাকাস্থ লক্ষ্মীবাজর খানকাহ্ শরীফের সাজ্জাদানশীন হজরত নাজিমুদ্দীন (র.) এর সাথে হজরতের রূহানী সম্পর্ক ছিলো অত্যধিক। জাগতিক ও আধ্যাত্মিক যে কোন পর্যায়ের মনস্কামনা পূরণের উছিলায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর জন্যে অহোরাত্র অবারিত এই সার্বজনীন দরগাহ শরীফ। দেশি বিদেশী পর্যটকগণ চট্টগ্রাম সফরে এলে তাঁর সমাধি দর্শন করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে থাকেন। শতাব্দীকাল ধরে এখানে হজরতের ভক্তদের জন্যে দু’বেলা লঙ্গর চালু রয়েছে। শহর চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা তাঁর পুণ্যস্মৃতি বহন করে চলেছে। এর মধ্যে সবিশেষে উল্লেখযোগ্য হলো দক্ষিণ চট্টগ্রামমুখী সড়ক পথের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ কর্ণফুলী নদীর উপর নির্মিত শাহ আমানত সেতু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের জন্যে নির্মিত শাহ আমানত হল এবং আকাশ পথে চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার শাহ আমানত আর্ন্তজাতিক বিমান বন্দর।
হজরত শাহ সূফী আমানত খান (র.) এর একমাত্র পুত্র শাহজাদা মুহাম্মদ আনোয়ার খান তদীয় পিতার স্মৃতি রক্ষার্থে এবং নিজ পরিবারের ভরণ পোষণের নিমিত্তে ১১ই বৈশাখ ১২০২ মঘী একখানা ব্যক্তিগত ওয়াক্ফ নামা সম্পাদন করেন। উক্ত ওয়াক্ফনামায় তিনি স্বীয় দুই পৌত্র যথাক্রমে আলিয়ার খান এবং আমানত খানকে উক্ত ওয়াক্ফ এস্টেটের মুতওয়াল্লী নিযুক্ত করেন। (আনোয়ার খানের একমাত্র পুত্র আলেফ খান পিতার জীবিত কালেই ইন্তেকাল করেন)। ওয়াক্ফ নামায় তিনি উল্লেখ করেছেন যে তাঁর পৌত্রদ্বয়ের ইন্তেকালের পরে তাঁদের পুত্রগণ এবং পরবর্তীকালে পৌত্র পৌত্রাদি পুরুষানুক্রমে বংশ পরম্পরায় যৌথভাবে মুতওয়াল্লী হিসাবে গণ্য হবেন।
পরবর্তীকালে আলেফ খানের পুত্র আমানত খানের নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যু হলে আলিয়ার খানের একমাত্র পুত্র মৌলভী ফজর আলী খান দরগাহ শরীফের মুতওয়াল্লী নিযুক্ত হন। মৌলভী ফজর আলী খান তাঁর একমাত্র ছেলে মৌলভী শের আলী খানকে নাবালক অবস্থায় রেখে ১৮৯২ সনে ইন্তেকাল করলে বালক মৌলভী শের আলী খান মাতা বদিউন্নেসার তত্ত্বাবধানে পালিত হন। ২০শে জানুয়ারি ১৯৪২ সনে মৌলভী শের আলী খান ইন্তেকাল করেন। শের আলী খানের ইন্তেকালের পরে তাঁর চার পুত্র যথাক্রমে শাহজাদা ফৌজুল কবির খান (-১৯৮২), শাহজাদা ফৌজুল আজীম খান (১৯২০ -১৯৭৮), শাহজাদা ফৌজুল করিম খান (-১৯৬২) এবং শাহজাদা ফৌজুল আলী খান (১৯৩৫ -২০০৯) যৌথ মুতওয়াল্লী হিসাবে অধিষ্ঠিত হন।
এদিকে হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার মানসে কতিপয় পরধন লোভী অসাধু ব্যক্তি পরস্পর যোগসাজশ করে দরগাহ শরীফের কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেয়ার অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৪৩ সনের ৩রা সেপ্টেম্বর তদানিন্তন ওয়াক্ফ কমিশনার বরাবরে একখানা দরখাস্ত করে।
স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় পড়ে ওয়াক্ফ কমিশনার সাহেব দরগাহ শরীফ সহ ওয়াক্ফকৃত যাবতীয় সম্পত্তিকে পাবলিক ওয়াক্ফ ঘোষণা করতঃ এস্টেট পরিচালনার জন্যে সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তিদের নিয়ে ১১ ডিসেম্বর ১৯৫২ সনে একটি কমিটি গঠন করেন যা চরম ভ্রান্ত এবং বেআইনী হিসাবে পরবর্তীকালে মহামান্য আদালত কর্তৃক মত প্রকাশ করা হয়।
এ ঘটনায় ব্যথিত হয়ে অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে হজরতের বংশধরগণ সুষ্ঠু বিচার এবং পৈত্রিক সম্পত্তি পরিচালনার অধিকার ফিরে পাবার আশায় ওয়াক্ফ কমিশনার এবং বেআইনীভাবে গঠিত কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের করেন।
এভাবে দিন গড়িয়ে মাস। মাস গড়িয়ে বছর। মামলা চলছে তো চলছেই। ইতোমধ্যে মহামান্য আদালত কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে ফার্সি ভাষায় লিখিত আনোয়ার খানকৃত ওয়াক্ফ নামার বাংলা অনুবাদের জন্যে চন্দনপুরা মাদ্রাসা দারুল উলুমের ফার্সী বিভাগের মোহাদ্দিস, ফিকাহ শাস্ত্রে স্বর্ণ এবং রৌপ্য পদক প্রাপ্ত মাওলানা মুহাম্মদ ফোরকান ছাহেব এবং চট্টগ্রাম কলেজের আরবী এবং ফার্সী বিভাগের সিনিয়র প্রফেসর সৈয়দ এ.কে.এম. জালাল উদ্দীন ছাহেব অনুবাদক নিযুক্ত হন। উভয়ের তরজমাকৃত ওয়াক্ফ নামার বিষয়বস্তু এবং বক্তব্যগুলো দেখে মহামান্য আদালত অত্যন্ত সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।
এর ভিতর ডাক পড়ে চট্টগ্রামের কতিপয় প্রণিধানযোগ্য ব্যক্তিত্বদের। তাঁরা আদালতের এজলাশে দাঁড়িয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হজরতের বংশধরগণের পক্ষে সত্য মত প্রকাশ করেন। তাঁদের মধ্যে সর্বজনাব এখলাছুর রহমান সাব রেজিস্ট্রার, খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক (দৈনিক আজাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা), ক্যাপ্টেন বখতেয়ার, রফিউদ্দীন আহমদ সিদ্দিকী, ডাঃ আবু জাফর ইউসুফ এর নাম বিশেষ উল্লেখ করার মতো।
অতঃপর সকল জল্পনা কল্পনার অবসান শেষে চূড়ান্ত রায়ের দিন ঘনিয়ে এলো। ২৯শে জুলাই ১৯৬৩ সনের রৌদ্র করোজ্জ্বল সকাল বেলা দীর্ঘ ১২ বৎসরের অচিন্ত্যনীয় প্রতীক্ষা শেষে জাস্টিস এম.আর.খান তাঁর ঐতিহাসিক রায়ে বলেন, ‘হজরত শাহ সূফী আমানত খান (র.) এর পুত্র আনোয়ার খান তাঁর মরহুম পিতার স্মৃতি রক্ষা এবং নিজ পরিবারের ভরণ পোষণের নিমিত্তে যে ওয়াক্ফনামা সম্পাদন করেছেন তা কোন পাবলিক ওয়াক্ফ নয় বরং এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ওয়াক্ফ। ওয়াক্ফ দলিলেই এর উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে বর্ণিত রয়েছে। সুতরাং ওয়াক্ফ কমিশনার এই দরগাহ শরীফ পরিচালনার ব্যাপারে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। এমন কি মুতওয়াল্লীগণ ওয়াক্ফ এস্টেটের হিসাব নিকাশ প্রদানের ক্ষেত্রে তার কাছে দায়বদ্ধ নন। দরগাহ শরীফে জেয়ারতকারীদের প্রবেশের এবং মুসল্লীদের মসজিদে নামাজ পড়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু হজরতের বংশধরগণের বাসস্থান, পুকুর, কবরস্থান প্রভৃতি একান্তভাবেই পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত। মরহুম মৌলভী শের আলী খানের পুত্র চতুষ্টয় যথাক্রমে ফৌজুল কবির খান, ফৌজুল আজীম খান, ফৌজুল করিম খান এবং ফৌজুল আলী খান হজরত শাহ সূফী আমানত খান (র.) এর আওলাদ বিধায় দরগাহ শরীফের বৈধ মুতওয়াল্লী হিসাবে গণ্য হবেন। পরবর্তীকালে তাঁদের পুত্র পৌত্রাদি বংশ পরম্পরায় যৌথভাবে মুতওয়াল্লী হিসাবে দরগাহ শরীফ এবং ওয়াক্ফ এস্টেটের তদারকীতে নিয়োজিত থাকবেন।’ রায়ে আরো উল্লেখ করা হয়, ‘দরগাহ শরীফে আগত ভক্ত বৃন্দের প্রদত্ত নজর নেওয়াজ এবং উপটৌকন সমূহ গ্রহণ করার পূর্ণ অধিকার হজরতের বংশধরগণের রয়েছে’।
প্রধান বিচারপতি জাস্টিস ইমাম হোসেন চৌধুরী তার বক্তব্যের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ঘোষণা দেন, ‘মরহুম আনোয়ার খান সম্পাদিত ওয়াক্ফ নামাটি সঠিক এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই এবং এটা একটা ব্যক্তিগত ওয়াক্ফ। ওয়াক্ফল আলাল আওলাদ নিঃসন্দেহে একটি ব্যক্তিগত ওয়াক্ফ।
হজরতের বংশধর গণের পক্ষে দেয়া যুগান্তকারী রায়ের মাধ্যমে পরধনলোভী স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়া হয়। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন মনে করছি। হজরতের বংশধরগণকে মানসিকভাবে যন্ত্রণা দানে অংশগ্রহণকারী এবং সহায়তাকারী প্রতিটি ব্যক্তির শেষ পরিণতি অত্যন্ত দুঃসহ এবং কষ্টদায়ক ও বেদনাময় হয়েছিলো বলে জানা গেছে।
প্রতি বৎসর ৩০শে জ্বিলক্বদ হজরতের পবিত্র ওরশ শরীফ দরগাহ শরীফ প্রাঙ্গনে তাঁরই বংশধরগণ কর্তৃক অত্যন্ত ভাব গম্ভীরভাবে পালিত হয়ে থাকে।

0 comments:

Post a Comment