নীল নদের প্রতি খলিফা ওমরের চিঠি
আলী ফোরকান
মিশরের নীল নদে পানি প্রবাহের জন্য আমিরুল মোমেনীন হযরত ওমর (র.) বিশ্বখ্যাত এ নদের প্রতি একটি চিঠি দিয়েছিলেন। ব্যাপারটি অলৌকিকত্বের পর্যায়ে পড়ে। বাস্তবও তাই। বিশ্বের ইতিহাসে অলৌকিকত্বকে অস্বীকার করা যাবে না। পবিত্র জমজম কূপের পানি, জেরুজালেম নগরীতে শূন্যে পাথরসহ অনেক অলৌকিকত্ব বর্তমান রয়েছে বিশ্বের বুকে। আমিরুল মোমেনীন হযরত ওমর (র.)’র আমলে মিশর ইসলামি নিয়ন্ত্রণে আসে। এর নেতৃত্বে ছিলেন প্রখ্যাত সাহাবা হযরত আমর বিন আস (র.)। মিশর জয়ের পর হযরত ওমর (র.), হযরত আমর বিন আস (র.)-কে মিশরের গভর্নর নিযুক্ত করেন।
মিশর মুসলমানগণের শাসনে আসার পর পর স্থানীয়রা হযরত ওমর বিন আস (র.)’র কাছে এসে বলেন, এখানে সনাতন কাল থেকে একটা নিয়ম প্রচলন আছে যে, নীল নদের পানি প্রবাহের নিমিত্তে প্রতি বছর আজম মাসের (কিপ্তিদের একটি মাস) ১২ তারিখ আগমন করলে তখন মিশরীয়রা পিতা মাতার অধিকারী একজন অবিবাহিত যুবতী নারীর প্রতি মনোনিবেশ করত। এরপর যুবতীর পিতা মাতাকে রাজি করায়ে উন্নতমানের অলংকার ও পোশাক দ্বারা তাকে নববধূর সাজে সজ্জিত করা হত। অতপর কিপ্তিরা তাকে নীল নদে ভাসিয়ে দিত। সে দিনকে মিশরীয়রা ঈদের দিন হিসেবে পালন করত এবং নানা ধরনের আয়োজনের মাধ্যমে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠত। উৎসবে সম্রাট নিজে উপস্থিত থাকতেন। কবিতা আবৃতি করা হত, গান গাওয়া হত। অনুষ্ঠানে গরু, মহিষ, ছাগল ও মুরগি জবাই করা হত। অন্যান্য মুর্তি উপাসকের ন্যায় তারাও নীল নদকে দেবতা মনে করত। তাদের ধারণা হল নীল নদকে যদি এ উৎকোচ দেয়া না হয় তবে সে অসন্তুষ্ট হয়ে যাবে। যার ফলে পানি প্রবাহিত করবে না। কিপ্তিদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা হযরত ওমর বিন আস (র.)’র নিকট এ নিয়ম চালু রাখার ব্যাপারে অনুমতি চাইলে তিনি বলেন, ইসলাম এ নিয়ম সমর্থন করে না। শুধু মুসলমান নয় তিনটি আসমানী ধর্মের কোন ধর্মে নর নারীর বলি দেয়ার বৈধতা নেই।
মিশরে ইসলামের সেনাপতি ও গভর্নও এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করলেও এটা মিশরে যুগ যুগ ধরে এ নিয়ম চলে আসছিল। বস্তুত নীল নদ মিশরের প্রাণ বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর অন্যতম। আবার বিশ্বের দীর্ঘতম নদীও বটে। মিশরের মধ্য ভাগ দিয়ে দক্ষিণ থেকে উত্তরে প্রবাহিত ঐতিহাসিক এ নীল নদ।
মিশরীয়রা বিশ্বের প্রাচীন সভ্য দেশ বলে দাবিদার। এ সভ্যতা গড়ে তুলতে মিশরকে প্রথম পথ দেখিয়েছে এ নীল নদ। নীল নদবিহীন দু’একটি মরুদ্যানসহ মিশর মরুভূমি হয়ে পড়ে থাকত। হয়ত বা যুগে যুগে সভ্যতার লালন ভূমি হতে পারত না। নীল নদকে বাদ দিয়ে মিশরের কৃষি ও সভ্যতার কথা কল্পনাতীত। অতি প্রাচীনকাল থেকেই নীল নদের দু’পার্শ্বে লোকজন বসবাস করতে শুরু করেছিল। নীল নদ ও এর অববাহিকা অঞ্চল মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের জন্য বিশ্বে যুগ যুগ ধরে বিখ্যাত ও সুপরিচিত। নীল নদের তীরে হাজার হাজার বছরের পুরনো বিশ্বখ্যাত কায়রো শহর মনোরম সাজে সজ্জিত হয়ে আছে। যা চোখে না দেখলে কল্পনা করা অসম্ভব। এ নীল নদে শিশু নবী হযরত মূসা (আ.)’র বেলা ভেসেছিল এবং ফেরআউনের শাহী মহলের মহিলারা তাঁকে তুলে নিয়ে লালন পালন করেছিল।
মিশরের সভ্যতা প্রায় ৬ হাজার বছরের পুরনো। ৩৩০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে মিশরীয় সভ্যতার ইতিহাস পাওয়া যায়। এ দীর্ঘ ইতিহাসে যুগে যুগে নানা সভ্যতা মিশরবাসীদের নাড়া দিয়ে যায়–ফেরাউনিক, গ্রিক ও মুসলিম সভ্যতা গ্রহণ করে। ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে আমিরুল মোমেনীন হযরত ওমর (র.)’র শাসনামলে মিশর ইসলামের আলোতে আলোকিত হয়।
মিশরের গর্ব বিশ্বের দীর্ঘতম এ নীল নদের দৈর্ঘ্য ৬৬৭১ কি.মি.। বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী হচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার আমাজান যার দৈর্ঘ্য ৬৪৩৭ কি.মি.। বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম ইয়াং–শি নদী হচ্ছে আমাদের এশিয়াতে, যার দৈর্ঘ্য ৬৩০০ কি.মি.। মিশরের দক্ষিণে সুদান পার হয়ে ইথিওপিয়া, ওগান্ডা, কেনিয়া, থানজানিয়া, জায়ার, বুরুন্ডী দেশসমূহে নীল নদ প্রবাহিত। পবিত্র কুরআনে সুনির্দিষ্ট কোন নদ–নদীর কথা উল্লেখ হয়নি, শুধু নীলের কথা উল্লেখ রয়েছে। নীল নদ হতে মানুষ যত উপকৃত হয় অন্য কোন নদী হতে তত হয় না। নীলের দু’ধারেই মিশরের জনপদ বলা চলে অর্থাৎ মিশরের প্রায় ৮০% উপরের এলাকা মরুভূমি। বিশ্বের বৃহত্তম আফ্রিকা সাহারা মরুভূমির পূর্ব অংশ মিশরে এসে শেষ হয়েছে। নীলের দু’পার্শ্বে হয় শহর, নদী বন্দর নয়তো পাশে সুন্দর সবুজ ঘনঘন গাছ ও শস্য ক্ষেত্র। নদীতে চলতে হাজার হাজার রংবেরং এর নৌকা, রয়েছে অসংখ্য প্রমোদতরী, ভাসমান বিলাসবহুল হোটেল, রেস্টুরেন্ট।
প্রাচীন মিশরীয়রা খ্রিস্টান ধর্মে থাকা অবস্থায় প্রতি বছর একজন কুমারিকে সাজিয়ে নদীতে ছেড়ে দিত। তখন নীল নদ দ্বিগুণ উৎসাহে বয়ে যেত, কিন্তু মিশরীয় কিপ্তিদের এ অগ্রহণযোগ্য প্রস্তাব গভর্নর হযরত আমর বিন আস (র.) মেনে নিতে পারলেন না। সেই বছর ঘটনাক্রমে দেখা গেল নীল নদের পানির প্রবাহ বাস্তবেই বন্ধ হয়ে যায়। মিশরীয়গণের চাষাবাদে সীমাহীন বেঘাত ঘটল। এমনকি যে সমস্ত লোকের উপার্জনের একমাত্র ভিত্তি চাষাবাদ তারা দেশ ছেড়ে চলে যেতে মনস্ত করল। আবার অনেকে নদীতে কুমারী নিক্ষেপ করতে উদ্ভুত হল।
হযরত আমর বিন আস (র.) অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে পবিত্র মদিনায় আমিরুল মোমেনীন হযরত ওমর (র.)’র নিকট পত্র লিখলেন। পত্র পেয়ে খলিফা হযরত ওমর (র.) নীল নদে কুমারী নিক্ষেপ করার রীতিকে নিষেধ করাতে খুশি হলেন এবং পত্রের জবাবে মিশরের গভর্নরের প্রতি লিখলেন, আপনি যেটা করেছেন ঠিকই করেছেন। আপনার কাছে লিখিত এ পত্রের ভিতর একটি ছোট কাগজের টুকরা আছে। কাগজের টুকরায় লিখিত ছোট পত্রটি নীল নদের মাঝে ফেলে দিবেন।
পত্রের ভাষা নিমরূপঃ–
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
আল্লাহর বান্দা মোমেনগণের আমির ওমর ইবনে খাত্তাবের পক্ষ থেকে মিশরের নীল নদের প্রতি ঃ “তুমি যদি তোমার ইচ্ছায় প্রবাহিত হও, তবে তোমার প্রবাহিত হওয়ার কোন দরকার আমাদের নেই। আর যদি তোমার জারি হবার ক্ষমতা মহাপরাক্রান্ত আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয় তবে রাব্বুল আলামীনের দরবারে মিনতি জানাই তিনি যেন তোমাকে জারি করে দেন।”
আমিরুল মোমেনীন হযরত ওমর ফারুক (র.)’র নির্দেশ অনুযায়ী ছোট পত্রটি নীল নদের মাঝে ছেড়ে দেয়া হয়। ঐতিহাসিকগণের মতে পত্রখানা নদীর মাঝখানে দিয়ে কিনারায় ফিরে না আসতেই মহান আল্লাহ পাকের কৃপায় পানি প্রবাহিত হতে আরম্ভ হয়। এক রাতেই ১৬ গজ পানি প্রবাহিত হয়েছিল। যা অন্যান্য বছরের তুলনায় ৬ গজ বেশি। তখন থেকে আজ অবধি নীল নদের পানি প্রবাহমান আছে।
নীলের বৈশিষ্ট হল নীল মানুষের ক্ষতি করে না। মিশরের নীল ভারসাম্য ও শান্তিপূর্ণভাবে বয়ে চলছে। অন্য নদীর মত ভাঙে না মানুষের ঘর–বাড়ি। মিশরে নীলের প্রবাহ প্রচন্ড খরা, গ্রীষ্ম ও তাপদাহের প্রচন্ডতাকে থামিয়ে দিয়ে আবহাওয়াকে ভারসাম্যপূর্ণ করে তুলেছে। মিশরের সৌন্দর্য্য নীলের কৃতিত্ব। তাই মিশরকে নীল কন্যা বলা হয়। নীল মানে সিক্ততা, স্নিগ্ধতা। নীলের প্রবাহ মানেই শস্য ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়ে উঠা। গুদাম হয় পরিপূর্ণতা। দারিদ্রতা চুফিসারে পালিয়ে যায়। হাজার হাজার কি.মি. পাড়ি দিয়ে প্রবাহিত নীল কত শহর নদী বন্দর পেরিয়েও তার পানি পরিষ্কার রাখতে সক্ষম। মিশরীয়রা নীলের পানিকে রেখেছে দুষণমুক্ত স্বচ্ছ। তাই তারা নীলের প্রতি কৃতজ্ঞতার সাথে বলে থাকে নীলই জীবন। বস্তুত: মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের পত্রের অলৌকিকত্বে আজ নীল সুন্দর শান্তভাবে প্রবাহিত থেকে মিশরীয়দের কল্যাণে রয়েছে।
0 comments:
Post a Comment