স্বাধীনতা সংগ্রাম ও একটি পরিসংখ্যান
আলী ফোরকান
১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়। কোনো আকস্মিক ব্যাপার ছিল না। ইতিহাসের সুদীর্ঘ পথ-পরিক্রমায়
যুগে যুগে এ জনপদে গণমানুষের যে সংগ্রামী চেতনার উন্মেষ ঘটেছে। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাদের জীবন সংগ্রামে। এ ভ‚-ভাগের সংগ্রামী মানুষ কখনো লড়েছে বহিঃশত্রæ
কিংবা বাইরের কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে। এ অঞ্চলের মানুষের চেতনার দ্রোহ ও সংগ্রামী মানস। এ ভখন্ডে সংগঠিত করেছে স্বাধিকার
ও স্বাধীনতার অনেক সংগ্রাম। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের
সে বিশাল প্রেতি ও ঘটনা পরম্পরা ইতিহাসের পাতায় বহুবর্ণে উজ্জ্বল হয়ে আছে। ইতিহাস স্যা দেয়। এ স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক এক অনিবার্য পরিণতিই আজকের স্বাধীন
বাংলাদেশ। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সুদূর অতীত। ইতিহাসের অনেক অধ্যায়কে পিছনে ফেলে, আলোচনার সূত্রপাত করতে চাইবে অপরিহার্যভাবেই। ১৭৫৭ থেকে ১৯৭১। সময়ের সূ² মানদন্ডে তা ২০০ বছরেরও অধিককাল। এ সময়ে এ উপমহাদেশে রাষ্ট্রনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিগন্তে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। ১৭৫৭ সালের জুন মাসে পলাশী প্রান্তরে স্বাধীনতার যে সূর্য অ¯Íমিত হয়েছিল, দু’শতাব্দীরও বেশি
কাল ধরে স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতায় সেই স্বাধীনতাই আমরা পুনরুদ্ধার
করেছি ১৯৭১ সালে। এক সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। মাঝখানে আরো অনেক সংগ্রাম-বিদ্রোহ ইতিহাসের নানা অধ্যায়কে আপ্লুত করেছে। পরাধীনতার বিরুদ্ধে। এ দেশের মানুষের সে সংগ্রামের প্রথম সূত্রপাত ঘটেছিল। ফকির ও সন্নাসী-বিদ্রোহ দিয়ে (১৭৬০-১৮০০)। তারপর একে একে সংঘটিত হয়েছে কৃষক বিদ্রোহ (১৭৯৩-১৮৩৩)। সংঘটিত হয়েছে ওহাবী ও ফরায়েজী আন্দোলন (১৮৩১-১৮৫৭)। সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭) এবং নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-১৮৬০)। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেতি সময়ের এ সব গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহ তেমন কোনো সংগঠিত
আন্দোলন ছিল না। ফলে অধিকাংশ েেত্রই এ সব সংগ্রাম ও বিদ্রোহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত
হয়েছে। এমনকি, প্রায় সর্বেেত্রই দেশীয় জমিদার শ্রেণী এ গণসংগ্রামের প্রতি কোনো
সমর্থন যোগায়নি।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলন : স্বাধিকারের পথে অগ্রযাত্রাবাংলাদেশের
স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় যে, ঔপনিবেশিক আমলে বঙ্গদেশেই প্রথম জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতার বীজ অঙ্কুরিত হয়। তবে এটা একদিনে গড়ে ওঠেনি। যে জমিদার শ্রেণী একসময়
ইংরেজদের পাবলম্বন করে ইতিপূর্বে বিভিন্ন গণবিদ্রোহে বিরোধিতা করেছে। তারাই একসময় সংগঠিত হয়ে ইংরেজ বিরোধী ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হন। এ ধারায় ১৮৩৭ সালে
গঠিত হয়েছিল। ‘জমিদার সভা’, ইয়ং বেঙ্গলদের নেতৃত্বে ১৮৩৪ সালে গঠিত হয় ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি’। ১৮৭৫ সালে জন্ম নেয় ‘ইন্ডিয়ান লীগ’। ১৮৭৬ সালে গঠিত হয় ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন। বলতে গেলে এ সব সভা-সমিতি এ দেশের শিতি মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং জমিদার শ্রেণীর মাঝে
ক্রমশ জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করে। ১৮৮৫ সালে তদানীন্তন ভাইসরয় লর্ড ডাফরিনের নির্দেশে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের আলেকজান্ডার
হিউমের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ভারতের জাতীয় কংগ্রেস’। এ ‘জাতীয় কংগ্রেস’ই এ দেশে প্রথম
জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন ১৯০৫ সালে বাংলাদেশ ভাগ এবং পূর্ববাংলা ও আসাম নিয়ে
একটি আলাদা প্রদেশ গঠিত হয়। ঢাকায় এ নতুন প্রদেশের
রাজধানী স্থাপিত হয়। পূর্ববাংলার মুসলিম নেতা নবাব স্যার সলিমুলøাহ বঙ্গ-বিভাগকে সমর্থন করেন। পূর্ববঙ্গ ও আসামকে
নিয়ে যখন বঙ্গবিভাগ ঘটে। ঠিক সেই সময় পাঞ্জাবের একটি অংশকে উত্তর-পশ্চিম এলাকার সঙ্গে
জুড়ে দিয়ে গঠিত হয় উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ। কিন্তু পাঞ্জাব বিভক্তি
নিয়ে সেখানে কোনো প্রতিবাদ বিােভ না হলেও ‘বঙ্গ মাতা’কে বিভক্ত করার
জন্য বর্ণ হিন্দুদেব মাঝে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। বঙ্গভঙ্গের প্রাক্কালে ১৯০৪ সালে কলকাতায় শুরু হয় সখারাম গণেশ দেউসূরের নেতৃত্বে
‘শিবাজী উৎসব’। ১৯০৬ সালে কলকাতায় ‘শিবাজী উৎসব’-এর আয়োজন করেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। এ উৎসবের অন্যতম অনুষ্ঠান ছিল ‘ভবানী পূজা’। শিবাজী উৎসব ও ভবানী পূজা উপলে লোকমান্য তিলক একদিন ত্রিশ হাজার
লোক নিয়ে গঙ্গাস্নানে যান। একই সময় সংগঠিত হয়
স্বদেশী আন্দোলন। বঙ্গভঙ্গ মূলত ‘শিবাজী উৎসব’ ও ভবানী পূজার রূপ পরিগ্রহ করেছিল। ফলে এ আন্দোলন ধর্মনিরপে আন্দোলনের রূপ নিতে পারেনি। আর এ কারণেই বাংলার মুসলমান সমাজ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কখনো জাতীয় আন্দোলন হিসেবে
গ্রহণ করেননি। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন এবং একই সময়ে শিবাজী উৎসবের পটভ‚মিতে ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠালাভ ঘটে। একই সময় ১৯০৬ সালে জন্মলাভ করে ‘হিন্দু মহাসভা’। এ দেশের ইতিহাসে দ্বিজাতিতত্তে¡র প্রথম সূত্রপাত এভাবেই ঘটেছিল। তা সত্তে¡ও বঙ্গভঙ্গ এবং বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলন একদিকে যেমন হিন্দু-মুসলিম
জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছে। তেমনিভাবে দু’শ্রেণীকে আন্দোলনের যে দীা দিয়েছে। তা পরবর্তীকালে স্বাধিকার ও ঔপনিবেশিক বিরোধী আন্দোলনে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করেছে। বাংলাদেশে বঙ্গ বিভাগের
বিরুদ্ধে দু’হাজারেরও বেশি জনসভা হয়। পান্তরে, পূর্ববঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায় নবাব সলিমুলøাহ’র নেতৃত্বে কিছুটা সংগঠিত হলেও জনমত তৈরিতে তারা পিছিয়ে ছিলেন। বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনকারীগণ এ সময়ে ব্যাপকভাবে স্বদেশী আন্দোলন গড়ে তুলতে সম হন। তারা বিদেশি দ্রব্য বয়কট শুরু করেন। এ সময়ে স্বদেশী কাপড়ের
কল, ব্যাংক, স্কুল, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি,
সাবানের ফ্যাক্টরি এবং ‘ল²ীর ভান্ডার’, ‘বেঙ্গল স্টোর’, ‘ইন্ডিয়ান স্টোর’ নামে স্বদেশী দ্রব্যের ভান্ডার গড়ে তোলেন। পূর্ববঙ্গের ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, বরিশাল, পাবনা, ফরিদপুর প্রভৃতি স্থানে এ আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করেছিল। বরিশালে অশ্বিনী কুমার দত্তের প্রচেষ্টায় এবং চারণকবি মুকুন্দ দাশের দেশাত্মবোধক
গান ‘মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই’ ইত্যাদি দেশব্যাপী স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার বয়ে আনে। এ কথা সত্য যে, বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন এবং স্বদেশী আন্দোলনে পূর্ববাংলার বাঙালি
মুসলমানদের রাজনৈতিকভাবে কোনোরকম লাভবান হওয়ার সুযোগ ছিল না। বর্ণবাদী হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত বঙ্গ বিভাগ রদ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সফল হলে
পূর্ববাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের একটি রাজনৈতিক অধ্যায়ের অবসান ঘটে। তবে এ সময়ের গঠিত মুসলিম লীগ পরবর্তীকালে পূর্ববাংলার মুসলমানদের ভাগ্য নির্ধারণের
দায়িত্ব গ্রহণ করে। অন্যদিকে হিন্দু বর্ণবাদী ও শিতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বদেশী
ও বয়কট আন্দোলন যে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করেছিল। সেটাই ধাপে ধাপে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেছে। রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনকালে রচিত ‘আমার সোনার বাংলা আমি
তোমায় ভালোবাসি’ গানটি সে সময়ে যেমন স্বদেশী আন্দোলন বর্ণবাদী হিন্দুদের প্রেরণা যুগিয়েছে। তেমনিভাবে পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেও এটি ছিল প্রেরণার অন্যতম
উৎস। রাজনীতিতে ধর্ম ও সম্প্রদায় চেতনা যে বিষবাষ্পের জন্ম দেয়। তা উপমহাদেশের রাজনীতিতে পরবর্তীতে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। আজকে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে মাঝে মধ্যে অনভিপ্রেত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার
যে মহড়া চলে তার সূত্রপাত এ শতাব্দীর গোড়াতেই শুরু হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনকালে পূর্ববাংলায় বঙ্গভঙ্গের পরে মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী বর্ণহিন্দুদের দ্ব›েদ্বর সূত্র
ধরেই ১৯০৭ সালে কুমিলøা, জামালপুর এবং পাবনায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকালে যদি হিন্দু-মুসলিম বিরোধ রাজনৈতিক রূপলাভ না করত তাহলে
হয়ত এ দেশে হিন্দু-মুসলিম মিলন ঐক্যের ইতিহাস অন্য রকম লিখিত হতো।
স্বাধীনতা প্রচেষ্টা : বিপ্লবী ধারা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালেই বাংলাদেশে
বিপ্লবী প্রচেষ্টা সংগঠিত হতে থাকে। এক সময়ের বরোদা রাজ
কলেজের অধ্য অরবিন্দ ঘোষ এবং তাঁর ভ্রাতা বঙ্গভঙ্গকালে বঙ্গদেশে এসে বিপ্লবী কর্মতৎপরতা
শুরু করেন। এ সব বিপ্লবী কর্মকাÐের মূল উদ্দেশ্য ছিল এ দেশ থেকে বেনিয়া ইংরেজদের উচ্ছেদ করা। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে এ কাজটি ততো সহজ ছিল না। তবুও শিÿিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটা অংশ ক্রমশ এ বিপ্লবী কর্মকান্ডে
ঝুঁকে পড়তে থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর ও বন্দরে গড়ে উঠতে শুরু করে ‘অনুশীলন সমিতি’। ১৯০৬ সালে বিপ্লবীদের মুখপত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ‘যুগান্তর’ পত্রিকা। পূর্ববাংলার প্রধান প্রধান শহরে এ সমিতির শাখা প্রতিষ্ঠা লাভ
করতে শুরু করে। এভাবে একমাত্র ঢাকাতেই অনুশীলন সমিতির ৫০০ শাখার সদস্য সংখ্যা
দাঁড়িয়ে ৩০ হাজার। বাংলার এ বিপ্লববাদী প্রচেষ্টা খুব মহান হলেও এ আন্দোলনে বাংলার
মুসলমানদের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। ফলে এটা কোনো সর্বজনীন
ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে পর্যবসিত হতে পারেনি। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলা শহরে ‘অনুশীলন সমিতির’ শাখা স্থাপিত হয়েছিল। ফরিদপুরের ‘ব্রতী সমিতি’, বরিশালের ‘বান্ধব সমিতি’ এবং ময়মনসিংহের ‘সুহৃদ ও সাধন সমিতি’ ছিল এর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ বিপ্লব প্রচেষ্টা এতই প্রসার লাভ করেছিল যে, ১৯১৮ সালের সেভিশান কমিটির রিপোর্টের ১৮০ পৃষ্ঠার মধ্যে ১১০ পৃষ্ঠাই ছিল বাংলাদেশের
বিপ্লবী আন্দোলন সংক্রান্ত। প্রকৃতপে এ সময়ের বিপ্লব
প্রচেষ্টায় বাংলার মুসলমানদের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না। কেননা তখন পর্যন্ত মুসলমানদের ইংরেজরা পৃষ্ঠপোষকতা করার নীতি অনুসরণ করেছিল।
অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন: ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ সরকার দমনমূলক রাউলাট
বিল পাস করে। মহাত্মা গান্ধী দÿিণ আফ্রিকা থেকে এসে ইংরেজদের এ দমননীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন
এবং রাউলাট বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। এ সময়ে ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড’ সংঘটিত হলে রবীন্দ্রনাথ এর প্রতিবাদে তাঁর ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন। এ আইনে কোনো নাগরিককে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার, প্রত্যহ থানায় হাজিরা দেয়া এবং কোনো স্যা-প্রমাণ ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে আদালতে শা¯িÍ দেয়া যেত। অসহযোগ আন্দোলন বাংলাদেশে
ব্যাপক প্রভাব বি¯Íার করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক ইংরেজদের বিরোধিতা করে। ফলে ইংরেজরা তুরস্কের অঙ্গ-বিচ্ছেদ করে এবং যুদ্ধে পরাজিত তুরস্কের প্রতি অন্যায়
সন্ধি চাপানোর কথা প্রকাশ পেলে ভারতীয় মুসলমান সমাজ তুরস্কের সুলতানের স্বাধীনতা রÿার দাবি তোলে। মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলীর নেতৃত্বে মুসলমানরা
এ আন্দোলনকে একটি সর্বভারতীয় আন্দোলনে পরিণত করেন। মহাত্মা গান্ধী এ আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। তিনি এটাকে‘An
opportunity of uniting Hindus and Muslims
as world not arise in hundred years.’ এ আন্দোলনের ফলে সাময়িকভাবে হলেও হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। স্বরাজ দল ও বেঙ্গল প্যাক্ট দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ১৯২২ সালে
‘স্বরাজ দল’ গঠন করেন এবং ‘ফরোয়ার্ড’ নামে দলের একটি দৈনিক মুখপত্র প্রকাশ করেন। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ঐতিহাসিক বেঙ্গল প্যাক্ট বা হিন্দু-মুসলিম চুক্তি
স্বাÿর করেন। এ চুক্তির ফলে সর্বপ্রথম
বাংলাদেশে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা স্বীকৃতি পায়। মুসলমানদের পÿে স্যার আবদুল রহিম,
মৌলভী আবদুল করিম, মৌলভী মুজিবুর রহমান, মওলানা মোহাম্মদ আকরম খা, মওলানা মনিরুজ্জামান
ইসলামাবাদী প্রমুখ মুসলিম নেতা স্বাÿর করেছিলেন। এ চুক্তির কারণে অনেক
মুসলমান শিÿিত শ্রেণী কলকাতা করপোরেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ
পান। বঙ্গভঙ্গকালে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের যে সর্বনাশ ঘটেছিল, পরবর্তীকালে মহাত্মা গান্ধীর রাজনীতিতে আসার কারণে এবং মুসলিম নেতৃবৃন্দের দূরদৃষ্টির
ফলে তা অনেকটা প্রশমিত হয়। গান্ধীজী দÿিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন সেখানে যে সত্যাগ্রহ আন্দোলন করেছেন, তা করেছিলেন মূলত সেখানকার ভারতীয় মুসলমান ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের জন্য। গান্ধীজির অহিংস ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাব পরবর্তীকালে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ফাটলে
অনেকটা জোড়া লাগাতে সÿম হয়। ১৯১৬ সালের ‘ল²ৌ চুক্তি’ অবশ্য ‘হিন্দু-মুসলিম’ ঐক্যের পথ সুগম করেছিল।
পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি : আইন অমান্য আন্দোলন ১৯২৭ সালে ব্রিটিশ
প্রধানমন্ত্রী ‘সাইমন কমিশন’ গঠন করেন। এ কমিটির কাজ ছিল ভারতবর্ষকে
কতটুকু স্বাধীনতা দেয়া যায়, তা খতিয়ে দেখা। কিন্তু এ কমিটিতে কোনো
ভারতীয় সদস্য না থাকায় দেশজুড়ে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংঘটিত হয়। ফলে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়েই এক পর্যায়ে ‘ডোমিনিয়ন’ দেয়ার কথা ঘোষণা করে। কিন্তু তা সত্তে¡ও লাহোরের কংগ্রেস অধিবেশনে দাবি ওঠে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার। এ সম্মেলনেই বয়কট ও আইন অমান্য আন্দোলনের সিদ্ধান্ত বা¯Íবে রূপ দেয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র
বসু এ সময়ে ১৯২৯ সালের ২৬ জানুয়ারি স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের কথা ঘোষণা করলে স্বাধীনতা
সংগ্রামের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ হয়। ১৯১৬ সালের ল²ৌর চুক্তির দ্বারা অবশ্য মুসলিম লীগ এবং জাতীয় কংগ্রেস একমত
হয়েছিল যে, ‘কাল বিলম্ব না করে ভারতবাসীকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে’ ব্রিটিশ সরকারকে। অবশ্য ইতিপূর্বেই ১৯১৫ সালে বাল গঙ্গাধর তিলক এ দেশের স্বায়ত্তশাসনের
দাবিতে ‘হোমরুল লীগ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হোমরুল আন্দোলনের মূলকথাই
ছিল, ভারতবর্ষ নিজেদের দ্বারা শাসিত হবে। হোমরুল আন্দোলন খোদ ব্রিটিশ সরকারকে বিচলিত করেছিল। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং আলী ভ্রাতৃদ্বয় একসময় এ আন্দোলনে যোগ দিয়ে হিন্দু-মুসলিমের
মিলিত ধারায় এ আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন।
ভারত শাসন আইন : মুসলিম স্বাতন্ত্র্যের উৎস সাইমন কমিশনের পরে
৩টি গোল টেবিল বৈঠকের পরিপ্রেেিত ১৯৩৫ সালে ‘ভারত শাসন আইন’ পাস হয়। এ আইন অনুযায়ী ১৯৩৭
সালে অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচন মুসলিম
লীগকে আলাদা সরকার গঠনের সুযোগ এনে দেয় এবং ফজলুল হকের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের মন্ত্রিসভা
গঠিত হয়। এভাবে স্বতন্ত্র মন্ত্রিসভা গঠনের ফলে মুসলিম মানসে ভারত ভূখন্ডে
মুসলিমদের আলাদা রাষ্ট্র চিন্তার বিষয়টি মুখ্য হয়ে দেখা দেয়ার সুযোগ হয়েছিল। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনীতির মধ্যে সাম্প্রদায়িক
ভেদ-বুদ্ধি দানা বাঁধতে থাকে। এ সময়ে মি. জিন্নাহ
সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন, ‘কংগ্রেস নিজেকে হিন্দুদের প্রতিনিধি বলে ঘোষণা করুক এবং মুসলীম
লীগকে মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিমূলক দল হিসেবে স্বীকৃতি দিক’। জিন্নাহর এ উক্তির মাঝে যে দ্বিজাতিতত্তে¡র বীজ লুপ্ত ছিল। সেটাই পরবর্তীতে বিকশিত
হয়ে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক উত্থাপিত ‘লাহোর প্র¯Íাব’-এ প্রতিফলিত হয়েছিল। যদিও জিন্নাহ একসময়
ঐতিহাসিক লাহোর প্র¯Íাবকে ‘ছাত্রের স্বপ্ন’ বা ঝঃঁফবহঃং উৎবধস বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।
ঐতিহাসিক লাহোর প্র¯Íাব : যেখানে স্বাধীনতার মূল নিহিত ছিল১৯৪০ সালের ২২ মার্চ লাহোরে
মুসলিম লীগের সপ্তবিংশতিতম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে এ কে ফজলুল হককে ‘শের-ই-বাংলা’ উপাধি দেয়া হয়। শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল
হক এ অধিবেশনেই ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্র¯Íাব’ পেশ করেন। এ প্র¯Íাবে বলা হয় ‘The areas in which Muslims
ar numerically in a majority as in the North-Western and Eastern zones of India
should be grouped to constitute independent states in which constituent units
shall be antonymous and sovereign
১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্র¯Íাবকে তখনকার কংগ্রেস সমর্থিত পত্রিকাগুলো ‘পাকি¯Íান প্র¯Íাব’ হিসেবে আখ্যা দেয়। লাহোর প্র¯Íাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে দু’টি আলাদা রাষ্ট্রগঠনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। ১৯৪১ সালে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে লাহোর
প্র¯Íাবকে মুসলিম লীগের ‘ক্রিড’ বা ‘ঈমান’ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ১৯৪৬ সালের সাধারণ
নির্বাচনে এ প্র¯Íাবের পÿেই মুসলিম লীগ ম্যান্ডেট লাভ করে। কিন্তু এ দেশের ইতিহাসে গণমানুষের অধিকারের প্রশ্নে বোধ হয় প্রথম কলঙ্ক আরোপ করা
হয় ১৯৪৬ সালের দিলøীতে অনুষ্ঠিত ‘লেজিজ লেটার্স’ কনফারেন্সে। এখানেই লাহোর প্র¯Íাবের ‘States’ শব্দের পরিবর্তে‘State’ লিখে পূর্ববাংলার প্রাণের দাবি- একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নকে
ধুলিসাৎ করে দেয়া হয়। ফলে পরবর্তীতে যে ‘পাকি¯Íান’ রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়,
সেখানে লাহোর প্র¯Íাবের সেই ‘ভৌগোলিকভাবে পাশাপাশি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল যেমন পাওয়া গেল
না, তেমনি উত্তর-পশ্চিমে ও পূর্ব ভারতে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোও পাওয়া
গেল না। পাওয়া গেল দু’টির স্থলে একটি
জগাখিচুড়ি রাষ্ট্র ‘পাকি¯Íান’। যা ছিল মূলত কতিপয় লীগ নেতা ষড়যন্ত্রের ফসল। সে দিন যদি লাহোর প্র¯Íাব কার্যকর হতো, তাহলে পূর্বাঞ্চলে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয়
১৯৪৭ সালেই হতে পারত। ঐতিহাসিক লাহোর প্র¯Íাবের মাঝে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারটিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। যে কারণে যথাযর্থভাবেই বলা হয়, ‘লাহোর প্র¯Íাবের মধ্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল’।
‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ : বিদেশে মুক্তির লড়াই
ঐতিহাসিক লাহোর প্র¯Íাবের আলোকে মুসলিম লীগ যখন স্বতন্ত্র আবাসভ‚মির স্বপ্নে বিভোর, ঠিক সেই সময়ে বাংলার আরেক বিপ্লবী সুদ্র বসু নজরবন্দি অবস্থা
থেকে পালিয়ে প্রথমে জার্মানি যান এবং সেখানে থেকে জাপান গিয়ে সেখানে বন্দি ১৪০০ ভারতীয়
অফিসার এবং ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে সিঙ্গাপুরে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠন করেন। ১৯৪১ সালে জাপান প্রায়
সমগ্র দÿিণ-পূর্ব এশিয়া দখল করে ভারত আক্রমণের উদ্যোগ নিলে ব্রিটেন চিন্তিত
হয়ে পড়ে। ভারতবাসীর সমর্থন ছিল তখন ব্রিটেনের জন্য জরুরি। তাই ব্রিটিশমন্ত্রী স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ভারতে এসে এই বলে আশ্বাস দেন যে, যুদ্ধ শেষে ভারতকে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দেয়া হবে। ইতিহাসে এটাই ‘ক্রিপস মিশন’ নামে পরিচিত। কিন্তু ভারতে এ প্রচেষ্টা
ব্যর্থ হয়। ফলে ভারতব্যাপী শুরু হয় ‘কুইট ইন্ডিয়া’ বা ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন। অন্যদিকে সিঙ্গাপুরে
গঠিত নেতাজীর ‘আজাদ হিন্দ সরকার’ জাপান, ফিলিপাইন, জার্মানি, থাইল্যান্ড, বার্মা ও ইতালির স্বীকৃতি লাভ করে এবং ভারতের আন্দামান ও নিকোবর
দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেয়। ১৯৪৪ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজ চট্টগ্রাম অঞ্চল পথে ভারতে প্রবেশ
করে। আজাদ হিন্দ ফৌজের অপর একটি দল কর্নেল শাহনাওয়াজের নেতৃত্বে বার্মা
ও আসামের নিবিড় অরণ্য ও পাহাড় অতিক্রম করে মনিপুর আক্রমণ করে। কিন্তু তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার অত্যন্ত কঠোর গোপনীয়তা ও সেন্সরের মাধ্যমে ভারতবাসীর
এ স্বাধিকার সংগ্রামের বিজয় সংবাদ গোপন রাখতে সম হয়। বাংলা ও ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যদি নেতাজীর এ সাফল্যের সংবাদ সঙ্গে সঙ্গে জানতে
পারতেন, তাহলে ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলন আরো তীব্র হতো। এমন কি, একটি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালেই এ
দেশ থেকে ইংরেজ শাসন উৎখাত করা সম্ভব হতো। বলার অপো রাখে না যে, সে েেত্র পূর্ববাংলা ও আসামই হতো এ সব স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রবেশদ্বার। এ অঞ্চল স্বাধীন হলে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়া কোনো বিলম্বের ব্যাপার ছিল না। আর এ ভাবেই আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ।
লেখক গবেষক
মোবাইল:০১৬১১৫৭৯২৬৭
dr.fourkanali@gmail.com
0 comments:
Post a Comment