ইয়াবা আগ্রাসনে জিম্মি যুবসমাজ
আলী ফোরকান
ইয়াবার মরণনেশায় জিম্মি হয়ে পড়ছে দেশের যুবসমাজ। এক সময় অভিজাত সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এর আগ্রাসন ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের সর্বত্র। এমনকি বস্তিবাসীদের একাংশের নেশার উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ইয়াবা। রাজধানীর এমন কোনো মহল্লা নেই যেখানে এই মরণনেশা থাবা বিস্তার করেনি। একটি দৈনিকে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে সাংসদ,ছাত্র, সরকারি কর্মকর্তা এমনকি মাদ্রাসার শিক্ষকরাও। আনুমানিক হিসাবে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে অন্তত ২০ হাজার মানুষ জড়িত। ইয়াবা আসছে সীমান্ত ডিঙিয়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে। ইয়াবার আগমন নেশার রাজ্যে অতি সাম্প্রতিক হলেও এর বিস্তার ঘটছে দ্রুত। এর ব্যবহারকারীরা এ ব্যবসায় জড়িত হওয়ায় প্রতিদিনই ইয়াবা গ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়ছে। ইয়াবাসক্ত ব্যবসায়ীরা নিজেদের খদ্দের বাড়াতে ছাত্রছাত্রী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীদের ব্যাপক হারে এ নেশার রাজত্বে নিয়ে আসছে। ইয়াবা আসক্তদের মধ্যে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও তরুণ-তরুণীর সংখ্যা বেশি। সরকারি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে মাদকাসক্ত মুক্ত হতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর মধ্যে ৮০ শতাংশ ইয়াবায় আসক্ত। ইয়াবার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান চললেও এর আগ্রাসন থেমে নেই। নানাভাবে রাজধানীতে এর চালান ঢুকছে। নদী, সড়ক ও রেলপথ- এই তিন পথেই ইয়াবা আনছে শক্তিশালী মাদক সিন্ডিকেট। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে ইয়াবার চালান নানা কৌশলে ঢাকায় আসছে। মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে ইয়াবা আসছে টেকনাফ ও কক্সবাজারের হাতে গোনা কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ীর কাছে। সেই ইয়াবা ছড়িয়ে পড়ছে ঢাকাসহ সারা দেশে। এসব ইয়াবা ‘ডিলারদের’ নাম-পরিচয়সহ বিস্তারিত তালিকা সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে রয়েছে কয়েক বছর ধরেই। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি কখনো। বিভিন্ন সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে মাদক হিসেবে ব্যবহারের দিক দিয়ে শীর্ষে এখন ইয়াবা। তবে দেশে ইয়াবা তৈরি হয় না। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, টেকনাফের অরক্ষিত সীমান্ত, বিস্তীর্ণ উপকূল দিয়ে সহজে ইয়াবা পাচার হয়ে আসছে। এই ইয়াবা সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করছেন ৭০ থেকে ৮০ জন ব্যবসায়ী বা ইয়াবা ডিলার। যাঁদের তালিকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর হাতেই রয়েছে। এই ইয়াবা ব্যবসায়ীদের হাতেই সারা দেশের ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ। তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই কেবল ইয়াবা ঠেকানো সম্ভব হবে। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ মতে. স্থানীয় সাংসদ আবদুর রহমান বদিসহ রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা এই ব্যবসার পৃষ্ঠপোষক হওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। ঠেকানো যাচ্ছে না ইয়াবার স্রোত। তাঁরা বলছেন, আকারে ছোট হওয়ায় ইয়াবা বহন সুবিধাজনক। একটি দেশলাইয়ের বাক্সে বা মুঠোফোনের ব্যাটারির জায়গায় ১০০ ইয়াবা বহন সম্ভব। তাই ইয়াবা দেশে ঢুকে পড়ার পর ছড়িয়ে পড়া রোধ করা খুবই কঠিন। আর যে পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার হচ্ছে প্রতিবছর, তা মোট ব্যবহারের তুলনায় যৎসামান্য। আর ইয়াবাসহ যাঁরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন,তাঁরা এগুলোর বাহকমাত্র, পুরো চক্রের শেষের দিকের ধাপে যাঁদের অবস্থান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সরকারের দুটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৈরি তিনটি তালিকা একটি দৈনিক সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি তৈরি করে। অন্য দুটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী পৃথক দুটি বাহিনীর তৈরি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি ‘ইয়াবা ট্যাবলেট চোরাচালান প্রসঙ্গে বিশেষ প্রতিবেদন’-এ টেকনাফের ৩১ জন মাদক ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বাকি দুটির একটিতে ৬৯ জনের নাম, আরেকটিতে ১৭ জনের নাম রয়েছে। ৬৯ জনের তালিকার নামগুলোই ঘুরেফিরে অন্য তালিকাগুলোতে রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই ৩১ জনের তালিকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাংসদ আবদুর রহমানের তিন ভাই আবদুল আমিন, মুজিবুর রহমান ও আবদুস শুক্কুরের নাম রয়েছে। আরও কয়েকজনের নাম রয়েছে, যাঁরা রাজনৈতিকভাবে সাংসদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে এলাকায় পরিচিত। ১৭ জনের তালিকায় সাংসদের আরেক ভাই মো. ফয়সালের নামও রয়েছে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, সাংসদ আবদুর রহমান এই এলাকার ইয়াবা ব্যবসার প্রধান প্রশ্রয়দাতা। তাঁর চার ভাইও এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে আবদুল আমিন মাঝেমধ্যে নারায়ণগঞ্জে থাকেন। বাকি তিন ভাই টেকনাফেই থাকেন। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত ইয়াবা ডিলার জাহিদ হোসেন ওরফে জাকু সাংসদের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। জাহিদ হোসেনের ছেলে রাফচানের নামও রয়েছে ১৭ জনের তালিকায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় আরও রয়েছে পৌর কাউন্সিলর ও টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি একরামুল হক ও যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নূর হোসেনের নাম। উপজেলা চেয়ারম্যান শফিক মিয়ার জামাতা নূর হোসেন। তাঁরা সবাই সাংসদের ঘনিষ্ঠ হিসেবেই এলাকায় পরিচিত। প্রকাশিত সংবাদের বরাত দিয়ে জানা যায়, টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে বৈধ পথে আসা মালামালের চালানের সঙ্গে ও শাহপরীর দ্বীপ করিডর দিয়ে নৌকায় গরু-ছাগলের সঙ্গে ইয়াবা আসে। টেকনাফের বিস্তীর্ণ উপকূলে ছোট ছোট জেলে নৌকাগুলোর মাঝিরা মিয়ানমার থেকে ইয়াবা নিয়ে উপকূলে আসেন। কিন্তু যে-ই ইয়াবা আনুক না কেন, এ দেশে আসার পরে তা বিপণন করেন তালিকাভুক্ত ইয়াবা ডিলাররা। ওই ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কায়দায় তা ছড়িয়ে দেন ঢাকাসহ সারা দেশে। এ জন্য সারা দেশে তাঁদের নিজস্ব নেটওয়ার্ক রয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, সাংসদের প্রশ্েরয়র কারণেই ইয়াবা ডিলারদের ধরতে পারে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আবার হঠাৎ এঁদের কেউ ধরা পড়লেও কয়েক দিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যান। ১৭ জনের তালিকার প্রথম নাম শাহপরীর দ্বীপের মো. ইসমাইল। তিনি র্যাবের হাতে বমাল গ্রেপ্তার হওয়ার পর দুই মাস কারাগারে ছিলেন। ছাড়া পেয়ে আবারও ব্যবসায় নেমেছেন। এই তালিকার আরেকজন জহিরুল ইসলাম বিজিবির হাতে আটক হয়ে কারাগারে ছিলেন কিছুদিন। তিনিও বের হয়েছেন। তবে টেকনাফের (কক্সবাজার-৪) আসনের সাংসদ আবদুর রহমান বদির দাবি, ‘ইয়াবা ব্যবসায়ীরা ধরা পড়লেই সুবিধা পেতে আমার নাম বলে। আমার ভাইয়েরা কর দিয়ে বৈধভাবে বন্দরে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করে। আমি থাকি ঢাকায়। আমরা কেউই ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নই। সেই সুযোগও নেই।’ তিনি বলেন, টেকনাফের প্রায় ৪৫ কিলোমিটার সীমান্ত অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এ কারণে ইয়াবা সহজে পাচার হয়ে আসছে। তিনি সংসদে দাঁড়িয়েও সীমান্ত সুরক্ষিত করার কথা বলেছেন বলে জানান। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির টেকনাফ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক বলেন, বিজিবি হাতেনাতে মাদকসহ কাউকে গ্রেপ্তার করার পর তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দেয়। এরপর পুলিশ তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়। বিজিবি তদন্ত করে। তিনি বলেন, দুঃখজনক হলো, ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হওয়ার পরেও অনেক আসামি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যান এবং আবারও এই অবৈধ ব্যবসা শুরু করেন। অরক্ষিত সীমান্ত প্রসঙ্গে ওই কর্মকর্তা বলেন, টেকনাফ এলাকায় মিয়ানমারের সঙ্গে ৫৪ কিলোমিটার সীমান্ত নাফ নদী দ্বারা বিভক্ত। এই নদী যেকোনো জায়গা দিয়ে পারাপার সহজ। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ১৭০ কিলোমিটার উপকূলেও নিরাপত্তাব্যবস্থাও খুব নাজুক। প্রচুর জেলে এ অঞ্চলের সাগরে ও নদীতে মিয়ানমারের জেলেদের পাশাপাশি মাছ ধরেন। জেলেদেরও কেউ কেউ ইয়াবা পাচার করেন। কিন্তু সে জন্য তো আর সব মাছ ধরা বাধাগ্রস্থ করা যায় না। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, এই ব্যবসায়ীরা অনেক ক্ষমতাশালী। এঁদের কমবেশি সবাই চেনেন। এঁদের ধরে আদালতের মুখোমুখি করতে হলে জোরালো প্রমাণ প্রয়োজন। যেটি সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। প্রযুক্তিগতভাবে আরও সক্ষমতা অর্জন করতে পারলে এই রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করে তাঁদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। মহাপরিচালক বলেন, প্রচলিত মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে অপরাধীদের যথাযথ সাজা দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে মাদক আইন আধুনিকায়নের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে এই ধরনের অপরাধীদের বিশেষ সাজার বিধান রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইয়াবা ব্যবসা করে টেকনাফের প্রত্যন্ত গ্রামের অনেক মানুষ কয়েক বছরের মধ্যেই কোটিপতি বনে গেছেন। বিত্তহীন লবণচাষি বা মৎস্যজীবীরা রাতারাতি ধনী হয়েছেন। এলাকায় এটি প্রায় প্রকাশ্য একটি ব্যবসা। অপরদিকে মাদক বিশেজ্ঞরা বলছেন, ‘ইয়াবা মস্তিষ্ককে চরমভাবে উদ্দীপ্ত করে। সেবন করলে তাৎক্ষণিক হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ ও শরীরে তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং মস্তিষ্কের কিছু কোষের তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটে। এ মাদক সেবনে হৃদদুর্বল ব্যক্তিদের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সহিংস যৌনতাও ইয়াবা সেবনের একটি সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। যদিও এক বছর নিয়মিত এই বড়ি সেবন করলে যৌনক্ষমতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। রাজধানীতে গত কয়দিনে লাখেরও বেশি ইয়াবা আটক হয়েছে। যার দাম কয়েক কোটি টাকা। এ মাদক নেশার আগ্রাসন কতটা যে বিস্তৃত এ পরিসংখ্যান তারই প্রমাণ। যুবসমাজকে এর আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে ইয়াবাবিরোধী অভিযান আরও জোরদার করা দরকার। একই সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ।
লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ
০১৭১১৫৭৯২৬৭
’
0 comments:
Post a Comment