Monday, July 25, 2016

মাদক: নেশার ঘোরে দেশ

মাদক: নেশার ঘোরে দেশ
আলী ফোরকান
নেশার ঘোরে দেশ। দুর্নীতি, দূর্বৃত্ত, দুঃশাসন ইত্যাদি। এ হরেক রকম নেশার হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দেশ। একটি সুস্থ, প্রশস্ত পথে দেশকে এগিয়ে নিতে চেষ্টাও হরেক রকম। হরেক রকম ভাবনা, চিন্তা, উদ্ভাবনা, পলিসি, গবেষনা, রাজনৈতিক অংগীকার, উক্তি, বিভক্তি সর্বোপরি দেশপ্রেম প্রকাশে, প্রচারে হরেক রকম গোষ্ঠীরও জন্ম, আর্বিভাব দেশে। দেশকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে যেমন তৎ্পর শ্রেণী রয়েছে, ঠিক তেমনি দেশকে উদ্ধারে ততৎপর শ্রেণী রয়েছে। এক্ষেত্রে দেশ ধ্বংস প্রত্যক্ষ করা যায় যত সহজে। দেশ উদ্ধার প্রত্যক্ষ করা যায় না অতসহজে। সেই অর্থে উদ্ধার কাজটুকু ভাবে, স্বার্থেই বেশি মেলে। ফলে দেশ ধ্বংসের মত দেশ উদ্ধার কাজটুকু বাস্তবিক হয়ে উঠে না। হয়ে উঠতে পারে না। এক অর্থে দু'পক্ষই নেশায় আসক্ত। কোনভাবেই তাদেরকে ক্ষান্ত করা যায় না। বোঝানো যায় না, দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয় কিংবা দেশের প্রকৃত রক্ষায় সততা জরুরি। এই নেশার ছোবলে বিপন্ন হচ্ছে দেশ, জাতি। কিন্তু দেশ জাতির তারও চাইতে বেশি বিপন্ন হবার সুযোগ রয়ে গেছে আরও একটি নেশায়। যে নেশার জন্ম এই মহানেশার গর্ভ থেকে। যে নেশায় জড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের শিশু কিশোররা। সামপ্রতিক সময়ে একটি দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে আমার আজকের এই লেখার কারণ। বাংলাদেশের শিশু কিশোররা কিভাবে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে সে সম্পর্কে একটি তথ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়। যা নিয়ে ভাবা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করছি। যদি প্রশ্ন করা হয়, কেন মানুষ নেশা করে ? নিঃসন্দেহে মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, বুদ্ধিবিজ্ঞানীগণ পুস্তক আর রেফারেন্স ঘেঁটে অনেক কথা বলার সুযোগ পাবেন। মনঃস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার পথ ধরে পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামোর দূর্বল দিকগুলো এলোপাথাড়িভাবে উপস্থাপনের চেষ্টাও চলবে। কিন্তু যিনি নেশায় আসক্ত তাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, কেন তিনি নেশা করেন, তাহলে বোধহয় উত্তরটা হবে সাদামাটা। বলবে, ভালোলাগে বা ভালো থাকি তাই। যাই হোক মাদক নেশাই বোধহয় মানুষের সেই আচরণ যার পেছনের কারনের সাথে সাথে পাশের এবং সামনের কারনও রয়ে যায়। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক কাঠামোর দুর্বলতা, বৈষম্য, মূল্যবোধ তৈরির উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানের অভাব ও প্রাতিষ্ঠানিক অদূরদর্শিতা, পুস্তককেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা, রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা, স্বার্থবাদিতা ইত্যাদি কারণগুলো একজন শিশুকে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার অন্যতম অন্তরায়। এই পরীক্ষিত সত্যটাই আজ চরম প্রত্যক্ষ সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবেদনের যে দিকটি আমাকে উৎকণ্ঠায় ফেলে দিয়েছে তা হলো আমাদের দেশে মাদক আসক্ত পথশিশুদের পরিসংখ্যান বিষয়ক। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম এর তথ্য মতে, শতকরা ৮৫ ভাগ পথশিশু কোন না কোন মাদকে আসক্ত। আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী , দেশের ৪৪ ভাগ পথশিশু মাদক গ্রহণ করে। সরকারের সাথে বেসরকারি সংগঠনের এই অমিল পরিসংখ্যাণ কি অর্থ বহন করে ? রীতিমত ৫০% অমিল ! নিঃসন্দেহে ভাবার সুযোগ আছে, আতংকিত হবার সুযোগ আছে, সংশয়ের সুযোগ আছে যে, জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আমরা কতটা খামখেয়ালীপনায় আসক্ত। নাকি এ সকল শিশুদের ঠিকানা পথে বলেই রাষ্ট্রের নৈতিক কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ? আমরা কোন আগামীর স্বপ্ন দেখি, আমরা কোন আগামীর পরিকল্পনা করি যেখানে এই সকল শিশুদের অস্তিত্ব নেই, ছায়া নেই ! যে দেশের বেশিরভাগ মানুষ দরিদ্র, সেই দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা কি করে হয় এ সকল শিশুদের প্রকৃত সংখ্যা ব্যতিত ! দুঃখজনকভাবে বলতে হয় বাংলাদেশে আজ শিশু শিক্ষা, শিশু স্বাস্থ্য, শিশু অধিকার ইত্যাদি শ্লোগানের অভাব নেই। অভাব নেই ব্যানার, ফেষ্টুন, সভা, সেমিনারের। অভাব নেই মানবতাবাদী মানুষের। অভাব শুধু জানার এ সকল শিশুর প্রকৃত সংখ্যা। তবে কি আমরা যারা সংশ্লিষ্ট, কর্মে তৎ্পর তারা সাদা কাগজে বসে অংক কষি ? ভেবে নেব সাদা খাতায় অংক কষে সঠিক ফল বের করবার হীন প্রচেষ্টা সর্বস্তরে ? কার, কাদের মনোতুষ্টির জন্য, স্বাথের্র জন্য তা সনাক্ত হওয়া জরুরি। অন্ততঃ শিশুর মত দেশের নিস্পাপ আগামী যেন ধ্বংস না হয়, পথভ্রষ্ট না হয়। প্রতিবেদনে প্রকাশিত সবচাইতে বিস্ময়কর বিষয় হলো, কেন্দ্রীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ভাষ্যমতে, দেশের মাদকাসক্তদের সঠিক কোন সংখ্যা তাদের জানা নেই। কারণ এ পর্যন্ত দেশে সরকারিভাবে কোন জরিপ বা সার্ভে করা হয়নি ! কারণ হিসেবে তাদের ভান্ডারে যে তথ্য রয়েছে তা হলো, মাদকাসক্তরা বা তাদের অভিভাবকগণ বিষয়টি চেপে যান। সহজ, সরল উত্তর, না কি দারুন দায়সাড়া তথ্য ! এ প্রসঙ্গের সূত্র ধরে একটি সত্য ঘটনা বলি। আমার এক মামা আছেন বাক প্রতিবন্ধী। কথা বলতে পারেন না। আমাদের বাসার গৃহকর্মী মাঝবয়সী। একদিন এই দুজনার মধ্যে চরম বেঁধে গেল। মামা তার মেজাজে চড়ে বসে অর্থহীন চিৎ্কার করছেন। আর গৃহকর্মী হাউমাউ করে কাঁদছেন। আমি এর কারণ জানতে চাইলাম গৃহকর্মীর কাছে যেহেতু মামা কথা বলতে পারেন না। গৃহকর্মী চিৎ্কার করে কাঁদতে কাঁদতে জানালো, টেলিফোনের রিং বেঁজে উঠায় সে মামাকে ফোন ধরতে বলেছে। এতে মামা রেগে গেছেন। আমি গৃহকর্মীকে বললাম, তুমি জানো না মামা বোবা ? গৃহকর্মী তার কান্নার শব্দ বাড়িয়ে দিয়ে বলল, সে জন্য তো ইশারায় তাকে ফোন ধরতে কইছি। ফোনে কথা কইতে কইছি ! আমি গৃহকর্মীর উত্তরে নির্বাক হয়ে পড়েছিলাম। তার সহজ, সরল উত্তর তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বাড়িয়েছিল। গৃহকর্মীর উত্তরের সাথে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণের অধিদপ্তরের উত্তরের মিলটা হল, সহজ। অমিলটা হল, নৈতিকতা, দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বশীলতার। কর্তৃপক্ষের এমন উত্তর মেনে নেয়া যায় কিনা ভেবে দেখা দরকার। অদৃশ্যের জন্য দৃশ্যমান পরিকল্পনা, কর্মপন্থা কি হয়, কেমন হয় জানতে ইচ্ছে করছে। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় প্রাচীণ মোড়ক কতটা আত্মরক্ষায় কাজে দেবে তা তাদের ভাবা উচিত। মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র নয়, মাদকমুক্ত দেশ চাই । মাদকমুক্ত সমাজ চাই। মাদকমুক্ত শিশু চাই। উন্নয়ন অগ্রগতির অর্জনে নিরাময়ের আধিক্য নয়, প্রতিরোধের সৎ্, বলিষ্ঠ উদ্যোগ চাই। পথশিশুদের মাদক আসক্তের কারন হিসেবে সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে পথশিশুদের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া ও মনঃস্তাত্ত্বিক বিষয়টিকে একতরফা দায়ী করলে চলবে না। উপরন্তু বলতে হয় গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রকে সামাজিকীকরণ ও মনঃস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় আনবার নৈতিক সামাজিক দায়িত্বও রয়েছে সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের।

0 comments:

Post a Comment