Saturday, July 2, 2016

পরিবেশ বাচান পৃথিবী বাচবে

 পরিবেশ বাচান পৃথিবী বাচবে 
 আলী ফোরকান
 পরিবেশ দূষণ নিয়ে চলছে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচনা। চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। পরিবেশ বিপর্যয় থেকে বাচার উপায় নিয়ে চলছে গবেষণা। বিশ্বের পরিবেশ দূষণ বর্তমানে প্রাণিকুলের অস্তিত্বের জন্য মস্ত বড় হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। পরিবেশের ওপর মানুষের জীবন নির্ভরশীল। দীর্ঘদিন ধরে মানুষ প্রকৃতির যে ক্ষতি করেছে, প্রকৃতি এখন তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ায় পৃথিবী আজ বিপদগ্রস্ত। নানা ধরনের দূষণের ফলে গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল, মালদ্বীপ, মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু অঞ্চল সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। পরিবেশ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় উদ্ভিদের কোনো বিকল্প নেই। পরিবেশ দূষণের কারণে উদ্ভিদের অস্তিত্বও আজ প্রশ্নের সম্মুখীন।
দূষণ : মানুষ ও অন্যান্য জীব দ্বারা পরিবেশের ক্ষতিকর পরিবর্তনকে সংক্ষেপে দূষণ বলে। প্রধানত তিনভাবে দূষণ হয়ে থাকে। ১. বায়ু দূষণ ২. পানি দূষণ ৩. শব্দ দূষণ। নিচে বিভিন্ন প্রকার দূষণের উৎস সম্পর্কে ধারণা দেয়া হলো।
বায়ু দূষণের উৎসগুলো : যদি কোনো কারণে বায়ুর অক্সিজেন ছাড়া অন্যান্য গ্যাসের ঘনত্বের পরিবর্তন হয় বা ক্ষতিকর গ্যাসের উপস্থিতি দেখা দেয় অথবা আশ, বালুকণা ইত্যাদির পরিমাণ বৃদ্ধি পায় তখন বাতাস দূষিত হয়। বাতাস দূষিত হওয়ার প্রধান উৎস হচ্ছেÑ
ক. ধোয়া : জ্বালানির অসম্পূর্ণ দহন, বাড়ির অগ্নিকু-, শিল্পকারখানার চিমনি ইত্যাদি থেকে নির্গত গ্যাস বায়ু দূষিত করে। এসব গ্যাসের মধ্যে কার্বন, হাইড্রোজেন, কার্বন মনো-অক্সাইড, কার্বন-ডাইঅক্সাইড, বেঞ্জোপাইরিন ইত্যাদি অবস্থান করে যা জীবদেহের ক্ষতিকর।
খ. নির্গত গ্যাস : তেলজাতীয় জ্বালানি দহনের ফলে এ অদৃশ্য গ্যাস ধোয়ার সঙ্গে কারখানার চিমনি, অটোমোবাইল, মোটরগাড়ি ইত্যাদি থেকে নির্গত হয়। এ গ্যাসে সিসা, তামা, দস্তা, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি ভারি ধাতু থাকে যা জীবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
গ. আয়নাইজিং রেডিয়েশন : পারমাণবিক বিস্ফোরণ, পারমাণবিক পরীক্ষা ইত্যাদির সময় আলফা, বিটা, গামা, নিউট্রন ইত্যাদি থেকে ক্ষতিকর রশ্মি বের হয়ে আসে।
ঘ. তেজস্ক্রিয় পদার্থ : পারমাণবিক বিস্ফোরণ থেকে তেজস্ক্রিয় পদার্থ বায়ুম-লে (পানি ও মাটিতে) ছড়িয়ে পড়ে এবং বায়ু দূষিত হয়।
ঙ. কীটনাশক, ছত্রাক ও আগাছা নিবারক : কৃষি ক্ষেত্রে পোকামাকড়, ছত্রাক, আগাছা ইত্যাদি মারার এবং মশা নিধনের জন্য নানা রকম বিষাক্ত পদার্থ ছিটানো হয়। এগুলো জীবদেহের ওপর নানাপ্রকার বিষক্রিয়া করে থাকে।
চ. আবর্জনা পচনের দ্বারা : আবর্জনা, মৃতদেহ ইত্যাদি পচনের ফলে দুর্গন্ধ গ্যাস নিঃসৃত হয়ে বায়ু দূষিত হয়।
পানি দূষণের উৎসগুলো : নানা কারণে পানি দূষিত হয়। পানি দূষিত হওয়ার উৎসগুলো নিম্নরূপÑ
ক. নর্দমার ময়লা : নর্দমার দ্বারা শহরাঞ্চলের মলমূত্র ও অন্যান্য ময়লা-আবর্জনা, ডিটারজেন্ট ইত্যাদি বাহিত হয়ে নদী ও অন্যান্য জলাশয়ে পতিত হয়। এতে পানি দূষিত হয়।
খ. শিল্পকারখানার আবর্জনা : শিল্পকারখানা থেকে নির্গত ময়লা-আবর্জনা, বিভিন্ন রকম রাসায়নিক পদার্থ পানি দূষণের প্রধান কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কাগজ, বস্তু, সার, লৌহ, চামড়া, রাবার, ইলেক্ট্রোপ্লেন্টিং ইত্যাদি শিল্পকারখানা থেকে নির্গত আবর্জনা বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানে গঠিত। এগুলো নদী ও জলাশয়ের পানিতে মিশে পানিকে বিশেষভাবে দূষিত করে - যা জীবের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাড়ায়।
গ. কীটপতঙ্গ দমনকারী রাসায়নিক পদার্থ : মশক ও ক্ষেতের কীটপতঙ্গ দমনের জন্য বিভিন্ন রকম বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ছিটানো হয়। এগুলো পানির সঙ্গে মিশে পানিকে দূষিত করে থাকে। এগুলো অন্য জীবেরও অনেক ক্ষতি করে।
ঘ. তেল : জাহাজ, লঞ্চ ইত্যাদি জলযান ও কলকারখানা থেকে নির্গত তেল পানিতে মিশ্রিত হয়। তেলবাহী জাহাজের ক্ষতিসাধনের ফলে প্রচুর তেল পানিতে মিশে এবং পানির ওপর তেলের আবরণ সৃষ্টি করে, যা জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের ক্ষতি করে।
শব্দ দূষণ : অবাঞ্ছিত শব্দও এক ধরনের পরিবেশ দূষণ। এ অবাঞ্ছিত শব্দ মানুষের শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক ভাবধারার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। মোটর গাড়ি হর্ন, কলকারখানা ও বিমানের শব্দ ইত্যাদি মানুষকে বিরক্ত করে ও শ্রবণ শক্তি কমিয়ে দেয়।
উদ্ভিদের ওপর পরিবেশ দূষণের প্রভাব : পরিবেশ দূষণ উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিস্তারে বিশেষ প্রভাব ফেলে। পরিবেশের দূষিত গ্যাস, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, তেজস্ক্রিয় বর্জ্য, রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি উদ্ভিদের ওপর বিশেষ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
দূষিত গ্যাসের প্রভাব : সালফার অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, ওজোন গ্যাস এবং হাইড্রোজেন ক্লোরাইড উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে বাধার সৃষ্টি করে। সালফার অক্সাইড আঙুর, তুলা, আতা ফল ইত্যাদি উদ্ভিদের বিশেষ ক্ষতি সাধন করে। এমনকি এসব উদ্ভিদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটিয়ে থাকে। ওজোন গ্যাস শাকসবজি, রবিশস্য, ফল ও বনাঞ্চলের ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার ও ক্ষতি করে। এছাড়া তামাক গাছের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা গেছে। কোনো কোনো বিজ্ঞানীর মতে ধোয়া, বালুকণা, কার্বন-ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড ইত্যাদি বায়ুম-লে উচ্চহারে উপস্থিত হয়ে আলোর বিচ্ছুরণ ও আবহাওয়া পরিবর্তন করে। এর ফলে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিস্তারে নানা রকম প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। 
এসিড বৃষ্টি : বিভিন্ন গ্যাস, বিশেষ করে নাইট্রোজেন, সালফার অক্সাইড বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে এসিড বৃষ্টি হিসেবে গাছপালার ওপর পতিত হয়। এছাড়া মৃত্তিকা ও জলাশয়ের পানিতে মিশ্রিত হয়। এ এসিড বৃষ্টি উদ্ভিদ ও বনাঞ্চলের বিশেষ ক্ষতি সাধন করে। গ্যাস ও নাইট্রোজেন অক্সাইড বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে এসিড বৃষ্টি সৃষ্টি করে। শিল্পোন্নত দেশে এসিড বৃষ্টি বর্তমানে একটি প্রকট সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এক জরিপে দেখা যায়, আমেরিকা ও কানাডার বনাঞ্চলে এসিড বৃষ্টির কারণে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এসিড বৃষ্টি ক্ষেতের শস্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এছাড়া এসিড বৃষ্টি মৃত্তিকা ও জলাশয়ের পরিবর্তন সাধন করে। ফলে কোনো কোনো অঞ্চলের ও জলাশয়ের উদ্ভিদ এবং প্রাণীর সার্বিক পরিবর্তন ঘটায়। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের বিলুপ্তিও ঘটে। তবে কোনো কোনো স্থানে নতুন ধরনের উদ্ভিদ গড়ে উঠতে পারে। এসিড বৃষ্টি বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। কারণ শিল্পোন্নত দেশের বর্জ্য গ্যাস বায়ু প্রবাহের মাধ্যমে শত শত মাইল দূরে প্রবাহিত হয়ে অন্য দেশেও এসিড বৃষ্টি হচ্ছে।
পারমাণবিক বর্জ্য পদার্থের প্রভাব : তেজস্ক্রিয় বর্জ্য বায়ুম-লে, পানি বা মাটিতে পড়লে তাও একইভাবে উদ্ভিদের ওপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
দূষিত পানির প্রভাব : নানা রকম ডিটারজেন্ট, কলকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থ, কীটনাশক ইত্যাদি পানিতে মিশে পানি দূষিত হয়। এতে জলাশয়ের  রাসায়নিক পরিবেশের পরিবর্তন তথা পানির পরিবর্তন হয়। ফলে জলজ উদ্ভিদের নানা রকম প্রতিক্রিয়া ও পরিবর্তন দেখা দেয়। কোনো কোনো উদ্ভিদ এ পরিবর্তিত পরিবেশে টিকে থাকতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ পানির দ্রবীভূত অক্সিজেন কমিয়ে দেয়। পানিতে ভাসমান তেল ডায়াটোম ও প্ল্যাংকটন উদ্ভিদের ক্ষতি সাধন করে। এভাবে দূষিত পরিবেশ উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিস্তারে বিভিন্ন রকম প্রভাব সৃষ্টি করে। এ পৃথিবী বাচাতে হলে আগে পরিবেশ বাচাতে হবে। পরিবেশ বাচলে পৃথিবী বাচবে। 

0 comments:

Post a Comment