Saturday, July 2, 2016

পরিবেশ: দূষণের দায়ভার কার


পরিবেশ: দূষণের দায়ভার কার
আলী ফোরকান
পৃথিবীর পরিবেশ দূষণের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বিপুল শিল্পোৎপাদনের ফলে বৈশ্বিক পরিবেশে একটি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন শুধু যে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক গতিশীলতা সৃষ্টি করেছে তাই নয়, একই সঙ্গে সৃষ্টি করেছে প্রবল বৈষম্যও। আজ শিল্পোন্নত দেশগুলোর এক-চতুর্থাংশ মানুষ পৃথিবীর উৎপাদিত সামগ্রীর তিন-চতুর্থাংশ ভোগ করছে। এই বৈষম্য পরিবেশের ওপরও চাপ সৃষ্টি করেছে। কারণ পরিবেশ দূষণ যেমন অত্যধিক উৎপাদন বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিগত সাফল্যের জন্য হতে পরে আবার দরিদ্র ও অনুন্নয়নের জন্যও হতে পারে। তবে তা নেহায়েতই সামান্য। যেমন বাংলাদেশে যেখানে মাথাপিছু গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের হার ১৩৫ কেজি সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই হার ২০ হাজার টন। বোঝাই যাচ্ছে, পরিবেশ দূষণের জন্য বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর দায় খুব সামান্য। তারপরও পরিবেশ দূষণের কারণে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে স্বল্পোন্নত নামধারী দরিদ্র দেশগুলোই। সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। 
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থা ইনভারমেন্টাল প্রট্কেশন এজেন্সী এস টি ডি ১৯৭০ এর মতে, পরিবেশ দূষণ বলতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বোঝায় : ১. বাতাস, মাটি বা পানির স্বাভাবিক উপাদানগুলোকে সুবিন্যস্ত অবস্থা থেকে অবিন্যস্ত অবস্থায় রূপান্তর করা, ২. সাধারণ প্রজাতিসহ বিরল প্রজাতির কোনো প্রাণী বা গাছ-পালার জীবনযাত্রার পরিবর্তন করা, ৩. পৃথিবীর সম্পদ বা উপরিভাগের এমন কোনো ব্যবহার যাতে গঠনগত ভারসাম্য নষ্ট হয়, ৪. এমন কোনো রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা কিংবা কোনো বর্জ্য বা আবর্জনা এমনভাবে ফেলা, যা পরিবেশের ক্রিয়ারত কোনো চেইনকে ধ্বংস করে বা করার হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। পরিবেশ ও তার উপাদানগুলোর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় পারস্পরিক সম্পর্ক বিদ্যমান। একে পরিবেশের ভারসাম্য বা ইকোলজিক্যাল সিস্টেম বলা হয়। কোনো কারণে এ পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি বা জীবনপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি হলেই পরিবেশ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তখনই ঘটে পরিবেশ দূষণ। পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী মূলত শিল্পোন্নত দেশগুলো। পরিবেশ দূষণের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এর অন্যতম প্রধান হলোÑ বায়ুম-লে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ। সেই সঙ্গে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের অপরিণামদর্শী যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ার কারণে বায়ুম-ল উত্তপ্ত হয়ে ওঠছে। উত্তপ্ত হয়ে উঠছে সমগ্র বিশ্ব। ক্রমশ জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। ফলে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বাড়ছে, মেরু অঞ্চল ও পর্বতমালার বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, দ্বীপাঞ্চল তলিয়ে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে শীতকালের স্থায়িত্ব, দীর্ঘায়িত হচ্ছে খরা, বিশ্বজুড়ে চলছে মরুকরণ প্রক্রিয়া, ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অজ্ঞাত রোগ। এছাড়া বাড়ছে ভূমি ও পাহাড় ধস, ঘন ঘন ভূমিকম্প এবং আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত। একই সঙ্গে বন্যা, টর্নেডো ও সাইক্লোনের মাত্রা আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৫ সালে আমেরিকায় যে রেকর্ডসংখ্যক ১৩টি হারিকেনের আঘাতে বিপর্যস্ত হয়েছিল, বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ুর পরিবর্তনই এর জন্য দায়ী। গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে প্রকৃতির রুদ্ররোষ থেকে বাঁচতে বিশ্বের ধনী দেশগুলো সতর্ক হয়ে ওঠে। এ লক্ষ্যে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিশ্বনেতাদের নিয়ে বিভিন্ন সময় বেশকিছু আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উদ্দেশ্য, পরিবেশ দূষণরোধে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা কার্যকর করা। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্মেলনগুলো ছিল আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ, অকার্যকর ও অপ্রায়োগিক। ১৯৯২ সালে রিওডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ‘এজেন্ডা-২১’ নামে যেসব এজেন্ডা নির্ধারণ করা হয়েছিল তার কতটুকু অংশগ্রহণকারী দেশগুলো বাস্তবায়ন করেছে সে প্রশ্ন রয়েই গেছে। পরে জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল রীতিমতো লজ্জাকর। মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ব্রিটিশ পরিবেশ ও জ্বালানিমন্ত্রী বিশ্বের কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গতকারী বিশ্বের প্রধান ২০টি দেশ নিয়ে এই ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমনকে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় রাখার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সারির পরিবেশ বিজ্ঞানী আমেরিকান এসোসিয়েশন ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্সের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক জন হোলড্রেন অবশ্য এ চুক্তি বাস্তবায়নে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, মার্কিন প্রশাসনই এ চুক্তি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছে। উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনকারী দেশ। এদিকে প্যারিসে প্রকাশিত জাতিসংঘের আবহাওয়া রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে মহাসচিব বান কি মুন বলেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের বিষয়ে বিজ্ঞানীদের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে প্যারিস রিপোর্টে। এখন যত শিগগির সম্ভব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ রিপোর্ট বাস্তবায়নে বিশ্বে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। জাতিসংঘের রিপোর্টটি পর্যালোচনা করে বুশ প্রশাসনের পক্ষে বলা হয়, রিপোর্টটি খুবই মূল্যবান। কিন্তু গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর বাধ্যবাধকতায় রাজি নয় যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি সেক্রেটারি স্যাম রোডম্যান বলেছেন, রিপোর্টের সঙ্গে তাদের দ্বিমত নেই। তবে গ্রিন হাউস নির্গমন কমানোর বিষয়টি তার দেশের ওপর চাপানো চলবে না। তাতে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের খুব ক্ষতি হবে। কোম্পানিগুলো দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যাবে। স্মরণযোগ্য, বিশ্ব প্রকৃতিতে বার্ষিক যে পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গত হয় তার ৪ ভাগের ১ ভাগই আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এরপর চীনের অবস্থান। শিল্পোন্নত দেশ কর্তৃক বিপর্যস্ত পরিবেশের ভয়াল থাবায় আক্রান্ত বাংলাদেশ। স্থানীয়ভাবে পরিবেশ দূষণ রোধে বাংলাদেশেও বিভিন্ন সময় বেশকিছু আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যে আইনগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরিবেশ সংরক্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পরিবেশ সংক্রান্ত সব আন্তর্জাতিক উদ্যোগের সঙ্গে যথাসম্ভব দেশকে যুক্ত রাখাও এসব আইন প্রণয়নের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। এরই ফলে বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিকভাবে পরিবেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন সম্মেলনে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করে এবং পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সব চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশের পরিবেশ বিষয়ক আইনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ-১৯৭৩, বাংলাদেশ ওয়াইল্ড লাইফ প্রিজারভেশন অ্যাক্ট-১৯৭৪, দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ-১৯৭৭, ফ্যাক্টরি রুলস-১৯৭৯, এগ্রিকালচারাল পেস্টিসাইড (অ্যামেন্ডমেন্ট)-১৯৮০, এগ্রিকালচারাল পেস্টিসাইড অর্ডিন্যান্স-১৯৮৩, পরিবেশনীতি-১৯৯২, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫, পরিবেশ বিধিমালা-১৯৯৭ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ, পরিবেশগত মান উন্নয়ন ও পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রশমনকল্পে পরিবেশ আদালত আইন-১৯৯৯ প্রণয়ন করা হয়। এতগুলো আইন থাকার পরও শুধু কার্যকর না করার কারণে পরিবেশ দূষণ রোধে তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। বরং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিদিন জ্যামিতিক হারে বাড়ছে দূষণের মাত্রা। বাংলাদেশের মতো একটি হতদরিদ্র দেশে অশিক্ষা, কুসংস্কার আর পরিবেশ দূষণের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতার অভাব পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে। এছাড়া দেশের বেশিরভাগ মানুষই জানে না যে, পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য দেশে আইন আছে। আবার অনেকেই আছেন, আইন আছে জেনেও পরিবেশ দূষণে লিপ্ত রয়েছেন। গায়ের জোরে আইন অমান্য করছেন। শুধু আইন প্রণয়ন কিংবা আইনের ধারা সংশোধন করলেই চলবে না, আইনের যথাযথ প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে দেশে অথবা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে। পরিবেশ দূষণ শুধু প্রকৃতির জন্যই নয়, আন্তর্জাতিক শান্তি, অগ্রগতি ও উন্নয়নের জন্যও মারাত্মক হুমকি। সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ ছাড়া এ থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই। সচেতনতা বৃদ্ধি, পরিবেশ-বিরুদ্ধ কর্মকা- রোধ, পারমাণবিক প্রতিযোগিতা বন্ধ করাও জরুরি। এখন বিশ্বব্যাপী সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি কার্যকর সমঝোতায় উপনীত হওয়া আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির যে অভাব রয়েছে তা এখন নিরসন হওয়া জরুরি। দক্ষিণ আফ্রিকার পরিবেশমন্ত্রী মারথিনাস ভ্যান শালকিক বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃষ্টি তথা পরিবেশ দূষণরোধে বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টায় শামিল হওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতা গ্রহণযোগ্য হবে না। 





0 comments:

Post a Comment