মাদকাসক্তি : প্রতিকার ও প্রতিরোধ দুই-ই প্রয়োজন
আলী ফোরকান
‘মাদক আসছে সীমান্তপথে’। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পত্রিকার অন্যতম শিরোনাম। ইদানীং মাদকাসক্তদের প্রিয় তালিকায় ইয়াবা, সিনথেটিক মরফিন গ্রুপের প্যাথেডিন জাতীয় নেশার ইনজেকশন জায়গা দখল করেছে। হেরোইন ও ফেনসিডিলের চাইতেও ইয়াবা মাদকাসক্তদের পেয়ে বসেছে অধিকহারে। প্রতিদিন সীমান্ত হতে আসছে বিভিন্ন মাদক। সময় সময় মাদক ব্যবসায়ী ঢাকায় গ্রেফতার ও হয়। মাদকদ্রব্য ও নেশার উপকরণ বহনকারীদের মধ্যে মহিলার সংখ্যাই সর্বাধিক। ঢাকার তরুণ-তরুণীরা ইয়াবার পাশাপাশি এই ধরনের ইনজেকশন আসক্তিতে অধিকহারে ঝুঁকে পড়েছে। অনেকে একই নিডেল ও সিরিঞ্জ ব্যবহার করছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। কেউবা আবার লুপিজেসিক ইনজেকশনের সাথে ফেনারগান ও সিডিল ইনজেকশন মিশিয়ে ব্যবহার করছে, যা আরও ক্ষতিকর। সাধারণত এই ধরনের ইনজেকশন ব্যবহারে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস, মরণব্যাধি এইডস, কিডনি ও লিভারের জটিল সমস্যা এবং দেহের ধমনী ব্লকসহ নানা ধরনের রোগ-ব্যাধি দেখা দিতে পারে। বিষয়টি উদ্বেগজনক বিধায় নেশার ইনজেকশনের চোরাচালান ও ব্যবহার প্রতিরোধে প্রশাসনিক নজরদারি বৃদ্ধি করা আবশ্যক। শুধু নেশার ইনজেকশনই নয়, দেশে আরও নানা প্রকার মাদকের বিস্তার সার্বিকভাবে নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। মাদক ও মাদক ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পেয়েছে মারাত্মকভাবে। একারনে অনেকে অল্পবয়সে লেখাপড়াও ছেড়ে দিচেছ। মাদকাসক্তির কারণে সমাজে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধকর্ম বৃদ্ধি পাচেছ। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের বহু পরিবার ও সংসারে মনোমালিন্য ও ভাঙন সৃষ্টি করছে। মাদক এক সামাজিক সংকটের জন্ম দিয়েছে। যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া খুবই জরুরি। কিন্তু যে সমাজে মাদকের চাহিদা ব্যাপক সেই সমাজে এর চোরাচালান ও সরবরাহ বন্ধ করা সহজসাধ্য নয়। এর জন্য মাদকের প্রতিকার ও প্রতিরোধ দুই-ই প্রয়োজন। যারা ইতিমধ্যেই মাদকাসক্ত হয়ে কলুষতা ছড়াচ্ছে, তাদের নিরাময়ের দায়িত্বটি আমরা এড়িয়ে চলতে পারি না। একই সাথে এর প্রতিরোধ করতে হলে ব্যাপক গণসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। অভিভাবক ও মুরুব্বীদের নিয়া প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় গঠন করতে হবে প্রতিরোধ কমিটি। আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে এ ব্যাপারে জোরালো ভূমিকা পালন করলে দেশ মাদকমুক্ত হবে নিঃসন্দেহে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে বর্তমানে মাদকাসক্ত লোকের সংখ্যা অর্ধকোটিতে পরিণত হয়েছে। ইউনাইটেড ন্যাশনস ড্রাগ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের (ইউএনডিসিপি) দাবি, এই সংখ্যা অন্তত ৬৫ লক্ষ। এর ৯১ শতাংশই কিশোর ও যুবক। কৌতূহল, পারিবারিক অশান্তি, বেকারত্ব, প্রেমে ব্যর্থতা, বন্ধুদের কুপ্রচারণা, অসৎসঙ্গ, নানারকম হতাশা ও আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার মূল কারণ। মাদক অধিদফতরের সূত্রানুযায়ী মাদকসেবীরা প্রতিদিন গড়ে ১৫০০ হইতে ২০০০ টাকা ব্যয় করছে। এভাবে মাদকের ব্যবহার ও মাদকাসক্তের সংখ্যা কেবলই বাড়ছে। এ জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ব্যর্থতাও রয়েছে। তাই এই প্রতিষ্ঠানটিতে পর্যাপ্ত জনবল, পরিবহন, প্রশিক্ষণ ও নানা প্রকার সরঞ্জামের সংকট দূর করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী কয়েকটি দেশের খুব কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে। যেমন-এশিয়ায় মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও লাওস মাদক উৎপাদনকারী সোনালি ত্রিভুজ এলাকা হিসাবে পরিচিত। এছাড়া আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ইরানের সোনালি অর্ধচন্দ্রাকৃত অঞ্চল পপি চাষের উবর প্রাণকেন্দ্র। এই কারণেও বাংলাদেশ মাদক চোরাচালানের আন্তর্জাতিক রুট হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রেখে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের মধ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা আবশ্যক। তবে শুধু বাংলাদেশেই নয়, বলতে গেলে ড্রাগস বা মাদকাসক্তি এখন সারা বিশ্বেরই অন্যতম প্রধান সমস্যা। ল্যাটিন আমেরিকার কলম্বিয়া ও মেক্সিকো দীর্ঘদিন ধরে এই সমস্যায় জর্জরিত। হালে এর সাথে বিশ্বের সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদও জড়িত হয়ে পড়ছে। ফলে বিশ্বের সকল দেশের সম্মিলিত উদ্যোগ ব্যতীত এ সমস্যা রাতারাতি সমাধান করা যাবে না।মাদকের চাহিদায় আঘাত হানতে হলে দেশব্যাপী ব্যাপক মোটিভেশন শুরু করতে হবে। কেবল তাত্ত্বিক কথা-বার্তায় কাজ হবে না। বাস্তবোচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মাদক ব্যবসায়ীদের সহিত পুলিশ ও প্রভাবশালী মহলের সংস্রব ছিন্ন করতে হবে। সমাজের মৌলিক রূপান্তর ব্যতীত এর কতটা সম্ভব তাও একটি প্রশ্ন। যে দেশে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার নামে উল্টো মাদক ব্যবসার পসরা সাজানো হয়। জেলখানায় অপরাধীদের জন্য মাদকদ্রব্য সহজলভ্য হয়। সে দেশে এই প্রবণতা দূর করা কঠিনই বটে। তবু দেশের মঙ্গলের জন্য ও নূতন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ রক্ষায় গ্রহণ করতে হবে কার্যকরী উদ্যোগ। আমরা এতটুকু আশা করতে পারি।
0 comments:
Post a Comment