Monday, July 11, 2016

সাবধান : মাদক ও জঙ্গি

সাবধান : মাদক ও জঙ্গি
আলী ফোরকান
 হাত বাড়ালেই মাদক। শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। জীবন ধ্বংসকারী মাদক। বিক্রি হচ্ছে শক্তিশালী চক্রের মাধ্যমে। অতিরিক্ত নেশা করায় অনেকে মারাও যাচ্ছে। মাদককে কেন্দ্র করে সারাদেশে ঘটেছে না না বিপত্তি। যে কোন অপরাধের পিছনে রয়েছে মাদকের সম্পৃক্তা। সম্প্রতি একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। যা রীতিমতো আৎকে উঠার মতো। ভয়ঙ্কর ড্রাগ আসক্তিতে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে কথিত জঙ্গিরা। ইসলাম রক্ষা, শান্তিময় পৃথিবী গড়ে তোলার নীতিবাক্য নিজেরাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে না পথভ্রষ্টরা। তারা নেশায় বুঁদ হয়েই যাবতীয় নৃশংসতা ঘটিয়ে নিজেদের কাল্পনিক স্বপ্ন বাস্তবায়নে মেতে উঠেছে। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের আদলে দেশে জঙ্গি নিরাময় কেন্দ্র গড়ে তোলার মাধ্যমে এসব পথভ্রষ্টকে সুপথে ফিরিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছেন অনেকেই। আইএস (ইসলামিক স্টেট অব ইরাক সিরিয়া) জঙ্গিদের নিয়ে গবেষণাধর্মী নানা প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা যায়, ক্যাপ্টাগন অ্যাম্ফিটামিন নামের বড়ি উচ্চ ক্ষমতার নেশায় আসক্ত হয়েই জঙ্গিরা বিবেক বিবেচনা বর্জিত নানা নৃশংসতায় মেতে উঠছে। এই নেশাজাত দ্রব্যটি গ্রহণের কারণে জঙ্গিদের উন্মত্ততা আরও বেড়ে যায়। যে আসক্তিতে মৃত্যুর পরোয়া না করেই তারা যে কারও ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। মনোচিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ‘ওষুধটি খেলে মানুষের দেহমনে এক ধরনের উদ্দাম ও সুখ সুখ ভাব সৃষ্টি হয়। ওষুধটি খাওয়ার পর লোকে বেশি কথা বলা শুরু করে। ঘুম হারাম হয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়ার রুচি কমে গেলেও শরীরে ব্যাপক শক্তি অনুভূত হয়।’ জাতিসংঘের মাদক এবং অপরাধ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৭ সাল থেকেই অ্যাম্ফিটামিন নামের এই ওষুধটির উৎপাদন বেআইনি ঘোষণা করা হয়। এরপরও মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে অ্যাম্ফিটামিনের প্রসার ঘটেই চলছে। সৌদি আরব, সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন ও তুরস্কের ল্যাবগুলোতে এ ট্যাবলেটের উৎপাদন ও সরবরাহ হচ্ছে। আইএসের মাধ্যমে এসব নেশাজাত ট্যাবলেট এখন বাংলাদেশেও জঙ্গিদের হাতে হাতে পৌঁছেছে। এসব ট্যাবলেটের ভয়ঙ্কর নেশাতেই একশ্রেণির যুবক জঙ্গিবাদিত্বের নানা অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট তথা আইএস ইস্যুতে এখন খুবই উদ্বিগ্ন। প্রিয়জনরা যেমন ভীত, তেমনি শঙ্কিত তরুণ-তরুণীরাও। শঙ্কার ভয় বাসা বুনেছে সর্বস্তরে। সবার মনে একটা ভয়ঙ্কর বিভীষিকাময় প্রশ্ন! কেন মানুষ আইএসে যোগ দেয়? কী লোভনীয়তা লুকিয়ে আছে আইএসে? একাকীত্ব, বেকারত্ব ও চরম হতাশা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় তরুণ-তরুণীরা নতুন কিছু করতে চায়। জীবনে চায় অ্যাডভেঞ্চার। কোনো কিছু না পারার যন্ত্রণায় হতাশাগ্রস্ততার সুযোগ নেয় চারপাশে ওত পেতে থাকা দুষ্ট মনের মানুষগুলো। ‘দেখো ছেলে, তুমি খারাপদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। আমাদের সঙ্গে এসো। জীবনে বৈচিত্র্য পাবে। হিরোর মতো বাঁচার সাধ পাবে। সবার উপরে থাকবে তোমার ইচ্ছার প্রাধান্য। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা।’ এমন সব প্রলোভনের কারণেই একশ্রেণির তরুণ জড়িয়ে পড়ে উগ্রপন্থি দলে। ধর্ম তাদের কাছে কোনো বিষয় নয়।মাদকাসক্তিই তাদের কাছে মুখ্য। ধর্মের কথা বলেও আইএস জঙ্গিরা মেয়েদের অপহরণ ও ধর্ষণের জন্য উদ্বুদ্ধ করে তারও আড়ালে আছে এই ক্যাপ্টাগন সেবনের ভয়ঙ্কর নেশা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেমন সৈন্যরা ইয়াবা সেবন করত যুদ্ধের ভয়াবহতা ও হত্যাযজ্ঞের একঘেয়েমি কাটানোর জন্য। বর্তমানে আইএস জঙ্গিরা সেভাবেই ক্যাপ্টাগন ট্যাবলেটকে বেছে নিয়েছে। বিকৃত যৌনতার সঙ্গে মাদকাসক্ত আর ধর্মীয় বিভ্রান্তির কবলে পড়ে বিভিন্ন দেশ থেকে তরুণ-তরুণীদের সংগ্রহ করে আইএস জঙ্গি সৃষ্টি করা হচ্ছে। ইরাক, সিরিয়ায় সম্মুখযুদ্ধে মৃত আইএস যোদ্ধাদের পকেটে ক্যাপ্টাগন পাওয়া যায়। সুইসাইড মিশনগুলোর আগে দীর্ঘ কয়েক মাস তাদের প্রস্তুতি নিতে হয়। এ সময়ে তাদের নিয়মিত ক্যাপ্টাগন পিল খাওয়ানো হয়। ঢাকায় মৃত জঙ্গিদের পূর্বেকার ছবি ও কয়েক মাস পরে হামলা করে নিহত ছবির চেহারা বা অবয়বগত কিছু পার্থক্যের মূল কারণ এই ক্যাপ্টাগন। মাদকদ্রব্য সেবন ও মদ্যপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন সতর্কবাণী প্রায়ই শোনা যায়। আবার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মদ্যপানে কিছু উপকারের পক্ষেও যুক্তি রয়েছে। তবে পাঁড় মাতালদের সম্পর্কে ভয়ংকর তথ্য জানিয়েছেন একদল ব্রিটিশ বিজ্ঞানী। তাদের মতে বিশেষ করে উঠতি বয়সের তরুণ বা টিন এজাররা অতিরিক্ত মাদকে অভ্যস্ত হলে তাদের অন্যমনস্কতা ভাব ও স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। সম্প্রতি ব্রিটিশ সাইক্লোজিক্যাল সোসাইটির কনফারেন্সে নর্দামব্রিয়া ও কিলি ইউনিভার্সিটির প্রফেসরদের সমন্বয়ে গঠিত গবেষক দল ভয়ংকর তথ্য উপস্থাপন করেন। তাদের ভাষায়, ১৭ থেকে ১৯ বছর বয়সী ২৬ মাদকাসক্ত তরুণের সঙ্গে ৩৪ জন সাধারণ তরুণের স্মৃতি পরীক্ষা নেয়া হয়। মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হয় একটি ভিডিও চিত্র। সময় বেছে নেয়া হয় সর্বশেষ মাদকসেবনের ৩/৪ দিন পর। কারণ এ সময় শরীরে মাদকের কোন আলামতই থাকে না। পরীক্ষায় দেখা গেছে, ভিডিও চিত্র প্রদর্শনের পর একই প্রশ্ন উভয় গ্রুপের কাছে করা হলেও সাধারণ তরুণদের চেয়ে গড়ে এক তৃতীয়াংশ কম সঠিক জবাব দিয়েছে মাদতাসক্ত তরুণরা। যা উল্লেখ্যযোগ্য পার্থক্য।গবেষক দলের প্রধান এবং নর্দামব্রিয়া ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. থমাস হেফারনান বলেন, নিজের থেকে কোন বিষয় ভিত্তিক বর্ণনায় মাদকাসক্ত ও সাধারণ তরুণদের স্মৃতিশক্তির বেলায় খুব একটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়নি। তবে ভিডিও চিত্র প্রদর্শন শেষে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কুইজ প্রতিযোগিতায় মাদকাসক্ত গ্রুপের চেয়ে অধিক সঠিক জবাব দিয়েছে সাধারণ গ্রুপের সদস্যরা। তার মতে, তরুণ বয়স ব্রেন বা মস্তিষ্ক সুগঠিত হওয়ার সময়। এ সময় অতিরিক্ত মাদকসেবনে  ব্রেনের এক প্রকার সাদা পদার্থ তথা মেমোরি অঞ্চলের দারুণ ক্ষতি হয়ে থাকে। নিয়মিত মাত্রাতিরিক্ত মাদকসেবনে প্রতিদিনই ব্রেনের অল্প অল্প ক্ষয়ের পাশাপাশি স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে থাকে। তিনি একই সঙ্গে বলেন, উঠতি বয়সে মাদক গ্রহণে ব্রেনের ক্ষতি হয় এটা যেমন সত্য তেমনি পরিণত বয়সের মানুষেরও ধীরে ধীরে ব্রেন ক্ষয়ে আসে। লোপ পেতে থাকে স্মৃতিশক্তি। যুক্তরাজ্যের দাতব্য সংস্থা এডাকশনের একজন মুখপাত্র বলেন, সরকারি হিসাব মতে যদিও মোটের ওপর মাদকাসক্ত যুবক বয়সীদের সংখ্যা নগণ্য তথাপি এরাই বেশি ঝুঁকির মধ্যে। এদের স্বাস্থ্যহানি এবং চূড়ান্ত ক্ষতির নজির বেশি। তাই মাদকসেবন বিশেষ করে কিশোর যুবা বয়সে একেবারে না করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গুলশান হামলার পর আমাদের দেশে এ প্রথম প্রকাশ পেলো,জঙ্গিরা মাদকাসক্ত। কেমিক্যালে ব্রেইন-ওয়াশ করে দলে ভেড়ায় জঙ্গিরা : সাম্প্রতিক সময়ের বহুল আলোচিত ঘটনা গুলশান ট্র্যাজেডি। এটা নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। চলছে জঙ্গিদের নিয়ে বিস্তর গবেষণাও। গবেষণা চলছে সেসব যুবক ছেলেকে নিয়েও যারা তাদের বুদ্ধি-বিবেচনা হারিয়ে এরকম একটা ধ্বংসাত্মক কাজে নিজেদের জড়িয়েছে। তাহলে প্রশ্ন হলো তারা কীভাবে মানুষের ব্রেইন ওয়াশ করে? আদৌ কি কারও ব্রেইন ওয়াশ করা সম্ভব? কথাবার্তায় মোটিভেশন করার মাধ্যমে ব্রেইন ওয়াশ সম্ভব না হলেও কেমিক্যালের মাধ্যমে ব্রেইন ওয়াশ করা সম্ভব বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। ক্যাপ্টাগন ও অ্যাম্ফিটামিন জাতীয় বিভিন্ন ধরনের সিডেটিভ ড্রাগ রয়েছে যা দিয়ে অনেক কিছুই করা হয়। জঙ্গিদের কাছে এগুলো খুব সহজলভ্য আর তারা এভাবেই গাছের উপাদান দিয়ে তৈরি ড্রাগ দিয়ে মিশ্র পদার্থ তৈরি করে তাদেরকে হিপনোটাইজ বা পরিচালিত করে। জঙ্গিরা যে কোনোভাবে এসব ছেলেকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে যায়। এরপর এসব ড্রাগ প্রয়োগ করে যা করতে বলে, তাই তারা করে। কারণ, তাদের তেমন কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। আর এত সংক্ষিপ্ত সময়ে কাউকে বুঝিয়ে ব্রেইন ওয়াশ করা সম্ভব নয়। কারণ, তার পরিবারের প্রতি ভালোবাসা থাকার কথা, আত্মীয়স্বজনদের কথা চিন্তা করার কথা। কিন্তু এসব ড্রাগ তাদের মস্তিষ্ককে নষ্ট করে দেয়। আর যে কোনো কিছু করার জন্য বাধ্য করে। আর সেসব হত্যাযজ্ঞের পর আমরা শুধু অবাকই হই যে এরকম একটা ছেলে এসব কাজ কেন করবে! কারণ, শুধু কথাতে ব্রেইন ওয়াশ হলে তাদের বিবেচনাবোধ অন্তত থাকত। ক্যাপ্টাগন, ধর্মীয় বিভ্রান্তি ও যৌনতা : ইসলাম সম্পর্কে মনগড়া বিভ্রান্তি আর মারণাস্ত্র ছাড়াও আইএসের আরেক গোপন অস্ত্র আছে। তার নাম হলো এই ‘ক্যাপ্টাগন’। ক্যাপ্টাগন হলো উচ্চমাত্রার যৌন উত্তেজক পিল, যা সৌদি আরব, সিরিয়া, ইরাকে সবচেয়ে জনপ্রিয়। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গোপন স্থানে এ ধরনের উত্তেজক ওষুধ তৈরির পর চোরাচালানের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৩ সালে লেবানন-সিরিয়া সীমান্তে ১২ মিলিয়ন ক্যাপ্টাগন পিলের বড় একটি চালান আটক করে। একই বছর তুরস্ক ৭ মিলিয়ন পিল আটক করে। গত বছরের ডিসেম্বরে দুবাই সরকার সাড়ে চার মিলিয়ন পিল আটক করে। সৌদি আরবে ৪০ ভাগ মানুষ ক্যাপ্টাগন ও অন্যান্য ধরনের মাদকে আসক্ত। জিহাদিরা সারা বিশ্বে এ ক্যাপ্টাগন পিল সেবন করছে। যে কারণে তারা মুত্যুর ভয় করছে না। এ ছাড়া ধর্ম সম্পর্কে এক ধরনের বিভ্রান্তির মধ্যে উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা সহজেই জঙ্গিদের খপ্পরে পড়ার এক গোপন কারণ হচ্ছে ক্যাপটাগন সেবন। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট তথা আইএস ক্যাপ্টাগন নামের একটি অ্যাম্ফিটামিন বড়ির নির্বিচার ব্যবহার করছে বলে জানা গেছে। এর আগে, ২০১৪ সালে এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও ফুটেজ প্রচার করেছে সিএনএন। এতে এক আইএস জঙ্গিকে একটি বড়ি সম্পর্কে বিবরণ দিতে দেখা যায়। বড়িটি সম্ভবত ক্যাপ্টাগন। ওই ভিডিওতে কারিম নামের এক জঙ্গিকে বলতে শোনা যায়, তারা আমাদেরকে ওষুধ দেয়; যা খেয়ে আমাদের মস্তিষ্কে বিভ্রম তৈরি হয়। এরপরই আমরা আমাদের নিজের জীবনের পরোয়া না করেই যুদ্ধের ময়দানে চলে যাই। এ ব্যাপারে অভিভাবক পালন করতে পারেন ডাক্তারের ভূমিকা। অর্থাৎ প্রত্যেক অভিভাবকের উচিত তাদের সন্তানদের মাদকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে আগেভাগেই জানিয়ে দেয়া। একই সঙ্গে যাতে করে কোন অসৎ সংশ্রবে পড়ে মাদকাসক্ত হয়ে না পড়ে সেদিক দৃষ্টি রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক শৃঙ্খলা, সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। সর্বোপরি মানসিক বিকাশের উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। তাহলেই কেবল সম্ভব আমাদের দেশকে কথিত জঙ্গি মুক্ত রাখা।

0 comments:

Post a Comment