মাদকাসক্তিঃ সর্বাগ্রে চাই পারিবারিক উদ্যোগ
আলী ফোরকান
আমাদের স্বভাবজাত। যে কোনো অভিব্যক্তির প্রাথমিক অনুশীলন ঘটে নিজ নিজ পরিবার থেকে। মূলত পরিবারের প্রেরণায় আমরা মানবীয় গুণাবলি, উন্নত আদর্শ, নির্মল নৈতিকতা ইত্যাদি চরিত্রের অধিকারী হই। নানাবিধ অপরাধকে পদদলিত করে সামাজিক সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠায় পরিবারের অনন্য ভূমিকার কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এ বিশ্বাস থেকে আমাদের এই মন্তব্য অত্যুক্তি হবে না যে, মাদকাসক্তির মতো ভয়ঙ্কর প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবচেয়ে কার্যকর ময়দান হচ্ছে একটা পরিবার। এই লড়াইয়ে পরিবারের নিয়ন্তা যারা, তারা যদি অনুজপ্রতীমদের প্রতি যুদ্ধংদেহী মনোভাবের পরিবর্তে দায়িত্বশীল আচরণ, নৈতিক গুণাবলি, স্নেহ-বাৎসল্য ইত্যাদি মানবিক পরিচয়ের প্রতিফলন ঘটান তাহলে নিশ্চয়ই বিপথগামী সন্তানদের যে কোনো বদভ্যাস থেকে বিরত রাখা যাবে। মাদকাসক্তির মতো গুরুতর বদভ্যাসকে প্রশ্রয় না দেয়ার লক্ষ্যে বা এর প্রভাব প্রতিহত করতে অভিভাবকগণ বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কৌশল প্রয়োগ করে নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ফল পেতে পারেন। যেমন
১। ধূমপান নিবৃত্ত করা। কারণ ধূমপান এমন একটি সহজ মাধ্যম, যার সাহায্যে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে অন্যান্য নেশার হাতেখড়ি ঘটে। গাঁজা, চরস, হেরোইন, ফেনসিডিল, মদ, পিসিপি এঞ্জেল ডাস্ট সবগুলোই এরকম আসক্তি। ছোটদের ধূমপান নিবৃত্ত করার জন্য পরিবারে বড়দের যে কোনো বদাসক্তি পরিহারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
২। মাদকবিরোধী শিক্ষা দেয়া। কারণ নেশাকর ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে ধারণা না থাকায় শিশুরা নিয়মিতভাবে ঐ ধরনের ওষুধ সেবনে উৎসাহী হয়ে ওঠে। এজন্য শিশুদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে শিক্ষাদান ও বর্জনীয় ওষুধের তালিকা তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। অভিভাবক ও শিক্ষককের অনুমতি ছাড়া কারো কাছ থেকে ওষুধপত্র গ্রহণ না করার ব্যাপারে সন্তানদের সতর্ক করতে হবে।
৩। মাদকবিরোধী কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা। কারণ মাদকদ্রব্যের অপকারিতা ও ঐ জাতীয় নেশা পরিত্যাগের শুভ দিক সম্পর্কে অভিভাবকদের পরিমিত জ্ঞান পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সহজে সঞ্চালন করা যায়। ফলে এগুলোর আসক্তি ঘটার আগেই সবাইকে সচেতন করে তোলা সম্ভব হবে।
৪। মাদকাসক্তি থেকে নিবৃত্ত করার পর পারিবারিক বন্ধন গভীর করা। কারণ মাদকাসক্তির কুফল সত্যি সত্যি বুঝতে পারলে যে কোন সন্তান সেসব ব্যবহার থেকে বিরত হবে। এ সময় তার মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়ন ঘটিয়ে পারিবারিক সুসম্পর্কের বন্ধনে ফিরিয়ে নিতে পরিবারের অন্যান্য সদস্যের আন্তরিক হতে হবে।
৫। মাদক সেবনে প্রশান্তি আনয়নের ধারণাকে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করা। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিষণœতা, পারিবারিক বিশৃংখলা ও হতাশাগ্রস্ততা থেকে মাদকাসক্তির মধ্যে এক ধরনের বিকৃত প্রশান্তি লাভের আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তাই সংসার জীবনে সন্তানদের সুখ-শান্তি, নিরাপত্তা ও উচ্চকাঙক্ষা পূরণের প্রতি অভিভাবকদের কাছ থেকে উদার মনোভাব দেখাতে হবে।
৬। পারিবারিক সংস্রব প্রতিষ্ঠা করা। কারণ অভিভাবকের অবহেলা থাকলে সন্তানের খারাপ দিকে ঝোঁকের প্রতি প্রবণতা বাড়ে। সেজন্য সযতœ দৃষ্টি রেখে পারিবারিক পরিবেশকে উন্নত করে গড়ে তোলা অপরিহার্য।
৭। শিক্ষকমন্ডলির মাদকমুক্ত থাকা। কারণ নিজ পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই দুই অঙ্গন হচ্ছে শিক্ষার্থীদের গড়ে ওঠার যথার্থ স্থান। শিশুদের মধ্যে নেশার ব্যাপারে নিগ্রহ বোধের জন্য মাদক প্রভাবমুক্ত ধীরস্থির, স্নেহপ্রবণ, শিক্ষার্থী সমাজের আবেগ-অনুভূতি ও মানসিক দ্বন্দ্বকে উপলব্ধি করার মতো ক্ষমতাধারী শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিবর্গের শিক্ষকতা পেশায় অনুপ্রবেশ ঘটলে শিক্ষার্থী সমাজ কখনও মাদকপ্রবণ হতে পারবে না। সর্বোপরি সমাজ-সংসারের মাদকাসক্তির দুষ্ট ক্ষত চিকিৎসায় পারিবারিক ভূমিকার পাশাপাশি আশু প্রয়োজন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে নৈতিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে জাগিয়ে তোলা। এ ব্যাপারে সকল মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
0 comments:
Post a Comment