Saturday, July 16, 2016

মাদকের নেশায় শিক্ষার্থী : চিন্তিত পরিবার

মাদকের নেশায় শিক্ষার্থী : চিন্তিত পরিবার
আলী ফোরকান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজধানীর নামিদামি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্রীদের মধ্যে মাদক ছড়িয়ে পড়ছে। মাদক সেবনের পাশাপাশি ছাত্রীরা মাত্রাতিরিক্ত ধূমপায়ী হয়ে গেছে। ছাত্রী হলে প্রতিদিনই প্রচুর পরিমাণে সিগারেটের গোড়ার অংশ পাওয়া যাচ্ছে। মাদকাসক্ত ও ধূমপায়ীদের মেজাজ সব সময় ক্ষিপ্ত থাকে এবং মাস্তান স্টাইলে তারা চলাফেলা করে। ভয়ে সাধারণ ছাত্রীরা কথা বলতে সাহস পায় না। মাদকাসক্ত ও ধূমপায়ী ছাত্রীদের মধ্যে সিংহভাগ ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মী বলে জানা গেছে। এক শ্রেণীর ছাত্রী ফেনসিডিল, হেরোইন ও ইয়াবা ট্যাবলেটও ঐ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত বেচাকেনা করছে।  বেশ কয়েকদিন আগে মাদকাসক্ত প্রেমিকের গুলিতে গুলশান কালাচাঁদপুরে প্রেমিকার পিতা মাতা নিহত এবং কলাবাগানে মাদকাসক্ত বান্ধবীর প্রেমিকের চাপাতির আঘাতে অপর বান্ধবীসহ তার পিতামাতা গুরুতর আহত হয়। এই দুটি ঘটনার পর একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ এবং বনানী, ধানমন্ডি ও উত্তরার ১০টি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইংলিশ মিডিয়ামের অর্ধ শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক ও শিক্ষকের উপর জরিপ করে। তাদের প্রতিবেদনে সর্বনাশা মাদকে ছাত্রীদের আসক্ত হওয়ার কথা প্রকাশ পায়। তারা বলেন, ছাত্রীরা শুধু সেবন করছে তা নয়, কৌশলে প্রথমে বিনামূল্যে সেবন করিয়ে আসক্ত বানাচ্ছে। অপরদিকে, আসক্ত ছাত্রীদের দিয়ে এক শ্রেণীর মাদক ব্যবসায়ী মাদক বিক্রি করাচ্ছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপকহারে মাদক বেচাকেনা ও সেবন চলছে। এই চাঞ্চল্যকর তথ্য ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক ও শিক্ষকরা জানিয়েছেন। আসক্তদের মধ্যে সর্বাধিক শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, সরকারি শীর্ষ প্রশাসনের কর্মকর্তা ও ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান বলেও তারা জানিয়েছেন। অভিভাবকদের ছাত্রীর প্রতি লেখাপড়ার পাশাপাশি অন্যান্য বিষয় প্রতিদিন মনিটর করা উচিত বলে শিক্ষকরা জানান। ধনীর দুলালীদের বিরুদ্ধে স্কুল কর্তৃপক্ষ মাদক নিয়ে কোন ব্যবস্থা নিতে গেলে উল্টা অভিভাবক কর্তৃক হয়রানির শিকার হয়। এ কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুল কর্তৃপক্ষ ছাত্রীর মাদকাসক্ত এবং ধূমপান করার বিষয় জেনেও না জানার ভান করে থাকেন বলে কয়েকজন শিক্ষক জানান।
ঢাবিতে ছাত্রীদের মাদক সেবনঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। প্রকাশ্য ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্ট এদেরকে মাদক সেবন করতে দেখা যায়। মাদক সেবনকারী বেশিরভাগই বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের অনুগত কর্মী। মেয়েরা মূলত কৌতূহল বশতঃ মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রেমে ব্যর্থতা ও উদাসীনতা থেকে মেয়েরা ইদানিং মাদক গ্রহণ করছেন। পড়াশোনা করতে এসে মাদক গ্রহণ অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। এ বিষয়ে ছাত্রীদের কাউন্সিলিং এর প্রয়োজন রয়েছে। তাদের জরিপ অনুসাওে,  বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, টিএসসির ডাস, আইবিএ’র ভিতরে, মধুর ক্যান্টিন, হাকিম চত্বর, মল চত্বর, ফুলার রোড, মুহসীন হলের মাঠ, জিমনেসিয়াম মাঠ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীরা মাদক গ্রহণ করছে। মেয়েদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ সিগারেটে আসক্ত হয়ে পড়েছে। মাদক গ্রহণকারীদের আবার একটি বড় অংশ বহিরাগত। এসব বহিরাগত ছোট ভ্যানিটি ব্যাগে করে বিভিন্ন ধরনের মাদক ক্যাম্পাসে বেচাকেনা করে থাকে। কোনভাবেই এদেরকে সিগারেট থেকে মুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। সন্ধ্যার পর এদের মাদক গ্রহণের হার বেড়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের চারটি হলের ভিতরে তারা প্রকাশ্য মাদক গ্রহণ করছেন। রাজনৈতিক পরিচয়ে মাদক গ্রহণের কারণে সাধারণ ছাত্রীরা তাদের কিছুই বলতে পারেন না। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী হলের ছাদ থেকে বেশ কয়েকটি ফেনসিডিল-এর বোতল উদ্ধার করা হয়। এটি নিয়ে হলের আবাসিক শিক্ষকরা সাধারণ ছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। কিন্তু প্রকৃত ঘটনায় জড়িতদের সনাক্ত করা সম্ভব হয় নি। হলের এক ছাত্রী বলেন, ‘প্রায়ই তার হলের ভিতরে সিগারেটের গোড়া পাওয়া যায়। কারা এ সিগারেট সেবন করে তা জানা অত্যন্ত কঠিন কাজ। কারণ অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে তারা মাদক গ্রহণ করে থাকেন।’ ইডেন কলেজে একশ্রেণীর ছাত্রী মাদক সেবনের পাশাপাশি প্রকাশ্যে আজিমপুর কলোনীর অভ্যন্তরে ধুমপান করতে দেখা যায়। সঙ্গে তাদের প্রেমিকও থাকে।
গুলশানের চিত্রঃ গুলশান এলাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল রয়েছে। এই সকল বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের মধ্যে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী ইয়াবায় আসক্ত। তারা ইয়াবা বিক্রি করে থাকে। ফেনসিডিল সেবন ও হেরোইনে আসক্ত রয়েছে কম। এই মাদকাসক্ত ছাত্রীদের মধ্যে ধূমপায়ীর সংখ্যাও বেশি। কয়েকজন আসক্ত ছাত্রী পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানান যে, একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদকাসক্ত ছাত্রের সঙ্গে না জেনে প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। প্রেমিক কৌশলে তার প্রেমিকাকে ধূমপানে আসক্ত করে। এই ধূমপানের মাধ্যমে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও হেরোইনে প্রেমিকা আসক্ত হয়ে পড়ে। আসক্ত অনেকে প্রেমিকের প্রতি গভীর ভালবাসার টানে প্রেমিকাও এক সময় মাদকাসক্ত হয়ে যায়। প্রেমিক যা করে প্রেমিকাও তা করে থাকে। অন্ধ প্রেমের কারণে মাদকাসক্ত প্রেমিকের পাল্লায় পড়ে মেধাবী ছাত্রীরা মাদকাসক্ত হয় বলে উক্ত ছাত্রীরা জানান। তাদের জানামতে মাদকাসক্ত প্রেমিকের মাধ্যমে গুলশান ও বনানী এলাকার নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতাধিক ছাত্রী মাদকাসক্ত হয়েছে। এই অভিজাত এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছাত্রীদের পিতা-মাতা বেশির ভাগ সমাজের স্বনামধন্য ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি। পাশাপাশি অগাধ টাকা ও ধনসম্পদের মালিক। ধনসম্পদের পাহাড়ের নিচে আলো নেই, আছে শুধু অন্ধকার। গুলশান ও বনানী এলাকায় ইয়াবার ব্যাপক হারে বেচাকেনা চলছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে এই তথ্য জানা যায়।শেরে বাংলা নগর মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও বিশিষ্ট মনোরোগ বিজ্ঞানি বলেন, প্রতিমাসে অনেক মাদকাসক্ত ছাত্রী তার কাছে চিকিৎসা নিতে আসে। এই ছাত্রীরা নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত। এই সকল মাদক সেবনে বেশিরভাগ ছাত্রীর ব্রেন, লিভার ও কিডনির মারাত্মক ক্ষতির প্রমাণ মিলেছে। মাদকাসক্ত ছাত্রীর দাম্পত্য জীবন সুখের হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, মাদকাসক্ত ছাত্রীরা জীবিত থেকে মৃত। তিনি বলেন, অভিভাবকদের ছাত্রীর প্রতি সঠিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতাই এ জন্য দায়ী। উত্তরা ও ধানমন্ডি এলাকার অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের মাদক সেবনের অনুরূপ তথ্য পাওয়া যায়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগীয় প্রধান বলেন, প্রতিমাসে তিনি বিপুল সংখ্যক মাদকাসক্ত ছাত্রীর চিকিৎসা করছেন। মাদকাসক্ত ছাত্রী কিংবা তরুণীদের যৌন ক্ষমতা থাকে না। বিশেষ করে ইয়াবা আসক্ত মেয়েরা স্থায়ীভাবে যৌন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তাদের বিয়ে হলে কয়েক মাসের মধ্যে সংসার ভেঙ্গে যায়। তাদের চেহারা এক সময় কুৎসিত অবস্থা ধারণ করে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা মেট্রো উপাঞ্চলের উপ-পরিচালক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের মাদকমুক্ত রাখতে নানা কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদক সেবন ও বেচাকেনার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। সর্বনাশা মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে এই কার্যক্রম। ছাত্র-ছাত্রী ছাড়া শিক্ষক ও অভিভাবকদের এই কার্যক্রমে রাখা হয়েছে বলে তিনি জানান। আমরা আশাকরি কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। তাহলেই মাদকমুক্ত সমাজ তথা দেশ গড়া সম্ভব হবে।

0 comments:

Post a Comment