মাদক এক বিষবৃক্ষ
আলী ফোরকান
বলা হচ্ছে আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটির ঊর্ধ্বে। তার মধ্যে তরুণ-তরুণী অর্ধেক ধরে নিলে দাঁড়ায় ৮ কোটি। এ এক বিপুল জনগোষ্ঠী। এর সঙ্গে আমাদের দেশের উন্নয়ন তো বটেই পাশাপাশি জনগণের আর্থিক উন্নয়নও জড়িত বলে মনে করি। অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, এই বিপুল জনগোষ্ঠীর যখন লেখাপড়া, খেলাধুলা এবং উন্নত চিন্তায় বিভোর থাকার কথা তখন সেখানে দেখি কালো মেঘের নির্মম গর্জন। এ কালো মেঘে বৃষ্টি হয় না, শুধুই ঝড় বইয়ে দেয়। ফলে উঠতি সব সুন্দর এবং মানসম্পন্ন চিন্তাচেতনা ধুলায় লুণ্ঠিত হয়। তরুণ সমাজ আমাদের ভবিষ্যৎ বলেই বলছি না, বলছি বর্তমান প্রজন্ম হিসেবেও এরা যদি ‘নেশা নামক বিষবৃক্ষ’ থেকে মুক্তি না পায় তবে আমাদের সব সম্ভাবনার সোনার তরী ডুবে যাবে অথৈ সাগরে। প্রশ্ন উঠেছে, কেন তরুণরা নেশাগ্রস্ত হয়? তরুণদের নেশাগ্রস্ত হওয়ার পেছনে অনেক কারণ নিহিত। তার মধ্যে প্রধানত তাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে আমরা গুরুজনরা ব্যর্থ। অন্যদিকে লেখাপড়ার যে মান বর্তমানে দেশে চলছে তাও তরুণদের উন্নত চেতনা সৃষ্টিতে যথাযথ ভূমিকা রাখছে না। আমরা সরাসরি বলতে চাই, লেখাপড়ার যে ব্যয়ভার তা অভিভাবক শ্রেণী চালাতে ব্যর্থ হয়। ছাত্রছাত্রীরা সঠিকভাবে চলতে পারে না। তাদের বন্ধু-বান্ধবরা ভালো নেই, শিক্ষক শ্রেণী উন্নত চিন্তারও ধারক নন। এখন কথা হলো, যখন তরুণদের বিনোদনের ব্যবস্থা হিসেবে খেলাধুলা দেয়া দরকার ছিল তখন তা আমরা দিতে পারিনি। ফলে তারা অন্ধকারময় খাবার ইয়াবা, ফেনসিডিল, মদ, তাড়ি, ভাং, জুয়া প্রভৃতিতে আকৃষ্ট হয়েছে। এ পথ থেকে আমরা তাদের ফেরাতেও সুন্দর কোনো পথ দেখাতে পারিনি। তরুণদের অতিরিক্ত টিভিপ্রেম, কম্পিউটার ঝোঁক, পর্নো ছবির প্রতি আকর্ষণ আমাদের ভয়ার্ত করে। ইদানীং লক্ষ করছি, শহরে যে ধরনের অন্যায় অপরাধ কুকর্ম সংঘটিত হচ্ছে সে ধরনের কর্মকা- গ্রামেও নিত্যদিন ঘটে চলে, যা আদৌ কাম্য নয়। ইভটিজিং শুধু শহরে শুনতাম, এখন গাঁয়েও ঘটছে; যা থেকে বাঁচতে আমাদের বোনরা আত্মাহুতি দিচ্ছে, যা আমাদের দারুণভাবে আহত করে। তরুণদের নেশার জগৎ থেকে ফেরাতে প্রথমত প্রশাসনকে খুবই কঠিন হাতে সব ধরনের অপরাধ দমন করতে হবে। অন্যায়কারী যে-ই হোক তাকে কোনো অবস্থায়ই ছাড় দেয়া যাবে না। ফেনসিডিল যাতে সীমান্ত পার হয়ে আসতে না পারে তার প্রতি যথেষ্ট শক্তিশালী নজর রাখতে হবে। মনে রাখা দরকার, এই তরুণ সমাজ যদি ধ্বংস হয়ে যায় তবে এ দেশ আর আগামীতে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। এখনই আমাদের নিজেদের স্বার্থে অবশ্যই তরুণদের নেশা থেকে মুক্ত রাখতে হবে। অভিভাবকদের হতে হবে আরো অধিক যতœশীল। কারন, নেশা বিশেষ করে মাদকের নেশা বাংলাদেশে এখন স্বাভাবিক সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে। দেশের তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ, শিশুসহ সব বয়সের মানুষ ধূমপানে আসক্ত। শতভাগ না হলেও যে পরিমাণ লোক ধূমপানের নেশায় আসক্ত সেটা বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা পরিবেশ তৈরি হয়, একটা সার্কেল গড়ে ওঠে যেখানে ধূমপান না করাটা মানানসই দেখায় না। এভাবেই একজন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর তাগিদে আস্তে আস্তে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অনেকে আছে অল্প অল্প ধূমপান আজীবন করে আসে; কিন্তু মারাত্মক নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে না কখনো। আবার অনেকে একটু একটু শুরু করতে করতে এমন অবস্থার মধ্যে চলে আসে, তার জীবন একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়। আর তরুণদের মাঝে নেশাগ্রস্ত হওয়ার ঘটনাটা বেশি পরিমাণে। এ সময় জীবনে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করতেই তরুণরা উচ্ছৃঙ্খল জীবনের দিকে দ্রুত পতিত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটা অপরাধীর জীবনের প্রথম অপরাধকর্মের সূচনা চুরি করে সবার অগোচরে বিড়ি বা সিগারেট খাওয়া। বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থাকে শিক্ষা, পেশা ও সভ্যতার দিক থেকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। গ্রামীণ সমাজ ও শহুরে সমাজ। তরুণদের নেশাগ্রস্ত হওয়ার প্রবণতা দুই সমাজে প্রাথমিকভাবে দুই রকম। প্রথমে আসি গ্রামের তরুণরা কিভাবে ধূমপানে আসক্ত হয়। গ্রামের অধিকাংশ অভিভাবক অশিক্ষিত, কিছু আছে স্বল্প শিক্ষিত। তারা নিজেরা বিড়ি-সিগারেটে ভয়ানকভাবে আসক্ত। যারা একদিনে ৫০টির মতো বিড়ি খায়। এরা স্বাস্থ্য ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে মোটেই সচেতন নয়। যার ফলে গ্রামের যানবহন, পাবলিক স্থানে ধূমপান চলে দেদারছে। ছোট শিশু ধূমপানের দৃশ্য দেখে জন্মের কয়েকদিন পর বাবার কোলে। এরপর ধীরে ধীরে বাবার মুখে বিড়ি বা সিগারেট দেখে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। যখন সে কোনো রকমে হাত নাড়াতে পারে তখনই বাবার মুখের বিড়ি নিজে মুখে দেয়ার চেষ্টা করে। এমন অনেক বাবা আছেন যারা বিড়িতে আগুন ধরানোর আগে সন্তানের মুখে মজা করার জন্য দেয়। এভাবে সন্তান একটু বড় হলে তাকে দিয়ে বিড়ি ও ম্যাচ কেনার কাজ করায় পিতা। আর এ সময় দাদা সম্পর্কের প্রতিবেশীরা মজা করার জন্য বিড়ি টানতে দেয়। এক সময় যখন শিশুরা আড্ডা দিতে শেখে, একসঙ্গে খেলাধুলা করে, তখন তারা লাউ, মিষ্টি কুমড়ার শুকনো লতা, শুকনো পাটকাঠি বিড়ির মতো কেটে বিড়ি খাওয়ার বিশেষ এক প্রকার খেলার আয়োজন করে। খেলাচ্ছলে করে বলে এতে কেউ বাধা দেয় না। এ বয়সে যখন সে বাবার জন্য বিড়ির প্যাকেট কিনে আনে তখন একটা বিড়ি এমনভাবে বের করে যে ধরা যায় না। মোটমুটি ১৪/১৫ বছর এভাবে লুকিয়ে বিড়ি খাওয়ার পর্ব চলে। এমন কোনো গ্রামের শিশু পাওয়া যাবে না যে এভাবে একদিনের জন্য হলেও বিড়ি খায়নি। এরপর বাবার সঙ্গে যারা মাঠে কাজ করে তাদের বিড়ির ব্যবস্থা স্বয়ং অভিভাবক করে থাকে। আর যারা লেখাপড়া বা অন্য কোনো কাজে শহরে চলে আসে তারা তো শহরের তরুণদের মতো করে অভ্যস্ত হয়। তবে গ্রামের তরুণদের বিড়ি, সিগারেট ছাড়া মদ, গাজায় আসক্ত হওয়ার ঘটনা খুবই কম। আর হেরোইন, ফেনসিডিল, ইয়াবার দিকে গ্রামের তরুণদের কখনোই আকৃষ্ট হতে দেখা যায় না। একটা কথা ঠিক, গ্রামের কোনো তরুণীকে কোনো প্রকার নেশায় আসক্ত হতে দেখা যায় না এ কথা বলা যাবে না। ইদানিং গ্রামের তরুনীরা ও মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। পরিবারে কিছু বখে যাওয়া তরুনীর উপর চালানো এক সমীক্ষায় দেখা যায়, এর সংখ্যা ও কম নয়। সমীক্ষার সুত্র মতে সহজলভ্যতাই আসক্তির বড় কারন। এবার আসি শহুরে তরুণদের নেশাগ্রস্ত হওয়ার দিকে। শহুরে তরুণ বলতে মূলত শিক্ষার্থী তরুণদের নিয়েই আলোচনা করা হবে। শিক্ষার্থীরা গ্রামের ও শহরের উভয়ই হয়। মেস এবং হল জীবনে তারা প্রথম সিগারেটে আসক্ত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের আবাসিক হলসমূহে সাধারণত বড় ভাইদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ধূমপানের প্রশিক্ষণ চলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জোরপূর্বক ধূমপান করতে বাধ্য করা হয়। আর বন্ধুদের মাঝে এমন একটা চক্র থাকে যেখানে ধূমপান না করাটা ‘আনস্মার্ট’। ‘গেঁয়োভূত’, ‘ক্ষেত’, ‘আবুল’ প্রভৃতি দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শিক্ষার্থী হল ও মেস জীবনের প্রথমেই ধূমপানে আসক্ত হয়। আর এ শব্দগুলো ব্যবহার করে বড় ভাইয়ের দল। মেস ও হল জীবনে গাঁজা সেবন স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিণত হয়। প্রতি মাসে বা প্রতি সপ্তাহে চলে মদের আসর। বিশেষ করে মেস ও হলের ছাদে বসে এ আসর। এছাড়া আবাসিক ক্যাম্পাসের ফাঁকা জায়গায় ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে মদ, গাঁজা খাওয়ার আয়োজন করে। ক্যাম্পাসের শিক্ষা সফরগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মদ খেয়ে মাতলামি করার বিষয়টি এখন আর দৃষ্টিকটু বলে মনে হয় না। এটা ছাড়া যেন সফরের আয়োজন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এভাবে একজন তরুণ নানা দিক থেকে মাদকের নেশায় আসক্ত হয়। শেষ পর্যন্ত হেরোইন, ইয়াবা ও ফেনসিডিলের তীব্র নেশা শিক্ষার্থীর জীবনকে ধ্বংস করে দেয়। এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ার কারণে শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারেনি। রোগগ্রস্ত হয়ে বেঁচে আছেÑ এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কম নয়। শহরে নিয়ন্ত্রণহীন জীবনযাপন করার সুযোগ পাওয়ার কারণে খুব সহজেই একজন তরুণ নেশায় নিজের জীবন ডুবিয়ে দিতে পারে। গ্রাম ও শহরের তরুণদের নেশাগ্রস্ত হওয়ার ঘটনাটি জাতির জন্য অভিশাপ হয়ে আসে। তারা পরবর্তীকালে যে প্রজন্ম গঠন করে তা আবার এ অস্বাভাবিক পরিবেশেরই সৃষ্টি করে। একটি দেশের চালিকাশক্তি বলতে গেলে তরুণ সমাজ। এই তরুণ সমাজকে রক্ষা করতে পারলেই সম্পূর্ণ জাতিকে রক্ষা করা যাবে। যদি শুধু একটি তরুণ প্রজন্মকে নেশার হাত থেকে রক্ষা করা যায় তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম স্বয়ংক্রিয়ভাবে নেশা ও মাদকমুক্ত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
0 comments:
Post a Comment