পরিবেশ: হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য
আলী ফোরকান
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীব্যাপী জীববৈচিত্র্য দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের অসংখ্য প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। একাধিক সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে দেশে বর্তমানে বিভিন্ন জাতের অসংখ্য প্রজাতি জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণে বিলুপ্তির পথে। এসব প্রজাতির বিলুপ্তি রোধে এখনই পদক্ষেপ নেয়ার আহবান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ‘জীববৈচিত্র্য’ শব্দটিই সাধারণ মানুষের কাছে অনেকটা অপরিচিত। যে কারণে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দেশের মানুষ এখন পর্যন্ত তেমন সচেতন নয়। এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ‘জীববৈচিত্র্যের বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, সকল ধরনের জীবের জীবন ধারণের জন্য একটি স্বাভাবিক পরিবেশ প্রয়োজন। যেখানে জীবকুলের প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহ সঠিকমাত্রায় বিদ্যমান থাকে। এই অবস্থায় জীবকুলের জীবনধারণের সমাগ্রিক প্রক্রিয়ায়ই হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। প্রাকৃতিক অথবা মানুষের সৃষ্ট কারণে এই অবস্থা ধ্বংস বা ব্যাহত হলেই জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গণসচেতনতা ও গণসম্পৃক্ততা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতিসংঘ ২০১০ সালকে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্যবর্ষ ঘোষণা করেছে। ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ ‘বাইয়োডাইভার্সিটি ন্যাশনাল এসেসমেন্ট এন্ড প্রোগ্রাম অব এ্যাকশন ২০২০’ তৈরি করেছে। বিশ্বের গুটি কয়েক দেশ যারা এ এ্যাকশন প্লান করেছে বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। এই এ্যকশন প্লানের আওতায় দেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। দেশের প্রখ্যাত পরিবেশ বিষেশজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য বর্তমানে হুমকির মুখে। পশুপাখি, বন্যপ্রাণী মৎস সম্পদসহ অনেক প্রাণী ইতিমধ্যে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। নির্বিকারে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস করা, জমিতে রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যবহার, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, খরার কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশগতভাবে বিভিন্ন এলাকা সংকটাপন্ন ঘোষণা করে সকল ধরনের ইকোসিস্টেম বাচিয়ে রাখার পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি। এদিকে গবেষকরা আশংকা করছেন জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের কারণে দেশে প্রথম বলি হতে পারে বিশ্বের একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইতিমধ্যে ৪০ প্রজাতির দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্ত হয়েছে ২০ প্রজাতির পাখি। এছাড়া পরিবেশের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারার কারণে দেশে ৯শ’ প্রজাতির বন্য প্রাণী আজ বিলুপ্তির পথে। অনেক বন্য প্রাণী বিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত তালিকায় স্থান নিয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে এক সময় দেশে ১৬৬ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ এবং ৪৪২ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যেত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব মিঠা ও সামুদ্রিক মাছ অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। এর পাশাপাশি দেড়শ’ বন্য প্রাণী আজ বিলুপ্তির পথে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব বন্য প্রাণী টিকে আছে তাদের অর্ধেকই কোন না কোন হুমকির মুখে রয়েছে। আগামী ৫০ বছরের মধ্যে অতি বিপন্ন প্রাণীর সবই বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর নেচার কনজারভেশন সোসাইটির তথ্য মতে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে গন্ডার, বনগরু, নেকড়ে, দুই জাতের হরিণ, হায়েনা, বনমহিষ, নীল গাই, কয়েক প্রজাতির পাখি ও সরীসৃপ। বিপন্ন পর্যায়ে রয়েছে ৪৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৪৭ প্রজাতির পাখি, ৮ প্রজাতির উভচর ও ৬৩ প্রজাতির সরীসৃপ। ডব্লিউটিবির তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৯০৩ প্রজাতির বন্য প্রাণীর মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫টি উভচর, ১২৬টি সরীসৃপ, ৬৫০টি পাখি এবং ১১৩টি স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। সুন্দরবনে ৩১৫ জাতির প্রাণীর মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ ৪৯টি স্তন্যপায়ী, অর্ধ শতাধিক সরীসৃপ ও ৮ প্রজাতির উভচর রয়েছে। দেশের হাওর-বাঁওড়ে রয়েছে দেড়শ’ প্রজাতির জলচর পাখি। যার ৭০ ভাগ বিরল। দেশের স্তন্যপায়ী প্রাণীর ১০টি জাতি চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এছাড়া ৪৩ প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। আমরা আশাকরি জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকার, বেসরকারি পরিবেশবাদী সংগঠন এগিয়ে আসবে।
0 comments:
Post a Comment