পরিবেশ:দূষণ রোধে চাই সচেতনতা
আলী ফোরকান
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চাহিদা। এই চাহিদার প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপর ফলে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এর সঙ্গে আছে মানুষের সীমাহীন লোভ-লালসা। এই লোভ-লালসার ফলে মানুষ দখল করছে নদী। ভরাট করছে খাল, কাটছে পাহাড়। উজাড় করছে বনভূমি, ধ্বংস করছে জীববৈচিত্র্য। যার প্রভাবে বারবার হানা দিচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ঘটছে জীবনহানি, সংকট হচ্ছে খাদ্যের। দিশেহারা হচ্ছে মানুষ। ধনী রাষ্ট্রগুলোর ভোগবিলাসী জীবনযাপনের কারণে বায়ুম-লে বাড়ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড। ফলে বাড়ছে ভূম-লীয় তাপমাত্রা। ঘটছে আবহাওয়ার পরিবর্তন। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওজন স্তরের ক্ষয়, সুপেয় পানির সংকট। মরুময়তা ইত্যাদির কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ধনিক রাষ্ট্রগুলোর পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে আমরাও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের জন্য কম দায়ী নই। স্বীকার করছি কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপাদনের মাধ্যমে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে আমরা প্রত্যক্ষ ভূমিকা না রাখলেও অযাচিতভাবে এর ক্ষতির শিকার। কিন্তু নদীদূষণ-দখল, পাহাড় কাটা, আইন লঙ্ঘন করে ইটভাটার জ্বালানি জোগানোর জন্য নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের মাধ্যমে পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে। তার ফলে দেশের উত্তরাঞ্চল দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে মরুময়তার দিকে। সেচ কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ফলে দেশের মানুষ রয়েছে আর্সেনিক ঝুঁকিতে। অধিক জনসংখ্যার জন্য অতিরিক্ত খাদ্য চাহিদা মেটাতে জমিতে ব্যবহার করা হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। দীর্ঘদিন ধরে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে মাটি হারাচ্ছে উর্বরতা, ফসল হয়ে উঠছে পুষ্টিহীন ও বিষাক্ত। আর এসব ফসল খাদ্য হিসেবে গ্রহণের পর মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ নানা ধরনের নিত্যনতুন রোগ-ব্যাধিতে। জন্ম নিচ্ছে বিকলাঙ্গ শিশু কিংবা মায়ের গর্ভ থেকেই জটিল রোগ সঙ্গে নিয়ে আসছে পৃথিবীতে। ঢাকা শহরের চারপাশের নদীগুলো দখল করছে লোভী মানুষ। হাইকোর্ট রুল জারির পরও দখলদারদের কবল থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না এসব নদী, বন্ধ হচ্ছে না বুড়িগঙ্গা দূষণ। রাজধানীর ভেতরের খালগুলো দখলের কারণে যেমন সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধ হচ্ছে রাজধানী ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশের নদীগুলো দখল ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে স্বাভাবিক প্রবাহ হারাচ্ছে। অনেক নদী মরে গেছে, যা অবশিষ্ট আছে তাও হারিয়েছে নাব্যতা। ফলে সামান্য বৃষ্টি কিংবা পাহাড়ি ঢল নামলেই সৃষ্টি হয় বন্যা।
মাটি ও পানি পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। জীবতাত্ত্বিক পরিবেশ এবং প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবনাচারের ওপর মাটি গভীর প্রভাব ফেলে। সুস্থ পরিবেশের জন্য সুষম মাটি অপরিহার্য। কিন্তু একদিকে রাসায়নিক সারের যাচ্ছেতাই ব্যবহার মাটিকে করছে পুষ্টিহীন, বিষাক্ত ও উষর। নদীর নাব্যতা হ্রাস, উপকূলীয় দুর্বল বাঁধ, চিংড়ি চাষের জন্য অবৈজ্ঞানিক ঘের তৈরি কিংবা অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট তৈরির কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মাটিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশের নাম মুছে যাবে মানুষের মন থেকে। আর যদি তাই হয় তবে একদিকে বাড়বে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, হ্রাস পাবে ফসল উৎপাদন, বাড়বে রোগব্যাধি, মানুষের জীবনে নেমে আসবে সীমাহীন দুর্ভোগ, যা থেকে উত্তরণের কোনো পথ আমাদের থাকবে না।
এরকম দুঃস্বপ্নময় দুর্দিন আসার আগেই আমাদের সতর্ক হতে হবে, গ্রহণ করতে হবে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা, সচেতন করতে হবে সাধারণ মানুষকে। দেশে পরিবেশ রক্ষার জন্য আইন আছে; কিন্তু কথা হলো এসব আইনের বাস্তব প্রয়োগ খুবই কম। বিভিন্ন সময় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে কিছু কিছু শাস্তির ব্যবস্থা করলেও প্রকৃতপক্ষে তা জনমনে তেমন সাড়া ফেলতে পারছে না ফলে পরিবেশ দূষণের মাত্রা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। একাজ সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এর জন্য গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন। আমাদের পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী, রাজনীতিক, সুশীল সমাজ, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মসজিদের ইমাম প্রত্যেকের মধ্যে যদি পরিবেশের বিষয়ে সচেতনাবোধ জাগিয়ে তোলা যায় তবেই দূষণ রোধ সম্ভব। প্রত্যেকের স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে যদি পরিবেশ দূষণের বিষয়ে সক্রিয় প্রচার প্রচারণা চালানো যায় তবেই বাড়বে জনসচেতনতা। এ ক্ষেত্রে দেশের সব কৃষককে সংঘবদ্ধ করে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। পরিবেশ দূষণ সত্যিকারার্থে মানুষের জন্য কতটা ভয়াবহ, কিভাবে পরিবেশ দূষণ রোধ করা যায়, কিভাবে নিজেদের তৈরি কম্পোস্ট, ভার্মি কম্পোস্ট বা জৈবসার ব্যবহারের মাধ্যমে মাটির জৈব-রাসায়নিক উপাদান ঠিক রাখা যায়। শেখাতে হবে কীটনাশকবিহীন ফসলের বালাই দমন পদ্ধতি। তেমনিভাবে যারা পরিবেশ নষ্টের জন্য দায়ী তাদের জন্য থাকতে হবে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। তাদের জন্য বন্ধ করতে হবে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা। তবে এক্ষেত্রে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো সরকারকে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দসহ যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে কঠোর শস্তির বিধান রেখে পরিবেশ আইন যুগোপযোগী করতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতিসহ সব অনিয়মের ঊর্ধ্বে উঠে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
0 comments:
Post a Comment