Thursday, June 23, 2016

শিশুর অপরাধ দমনে পরিবারের কর্তব্য

শিশুর অপরাধ দমনে পরিবারের কর্তব্য
আলী ফোরকান
সব যুগেই শিশুরা নানা অপরাধ করেছে। কিন্তু বর্তমান যুগের আগে এ নিয়ে কেউ এত বেশি মাথা ঘামায়নি। কালের পরিবর্তনে মানুষের মতের পরিবর্তন হচ্ছে এবং শিশুর অপরাধের প্রবণতাও জটিলতর হয়ে দেখা দিচ্ছে। অপরাধের সংজ্ঞা যুগে যুগে ও দেশে দেশে বদলে যাচ্ছে।
একজন শিশু বড়দের মত সব অপরাধই করতে পারে। কিন্তু বড়রা শিশুদের অপরাধগুলো সাধারণতঃ করতে পারে  না। যেমন স্কুল পালানো। প্রায় দেশেই শিশু ও বড়দের অপরাধের শাস্তির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যদিও বলা হয়ে থাকে আইনের চোখে সবাই সমান। শিশুর অপরাধের প্রতি এই পক্ষপাতিত্বের কারণ হচ্ছে শিশুর অপরাধকে ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখা হয়। শিশুর সমস্ত জীবন তার সম্মুখে সে যেন ভাল হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সে জন্য বড়দের মানদন্ডে তাকে শাস্তি না দিয়ে সংশোধনী প্রতিষ্ঠানে দেওয়া হয়।
এখন কথা হচ্ছেÑশিশু বলতে আপনি কত বয়স পর্যন্ত ধরে নেবেন? সাধারণভাবে এ বয়স ধরা হয় সাত থেকে আঠার বছর পর্যন্ত। আমাদের দন্ডবিধি আইনের ৮২ ধারা অনুযায়ী সাত বছরের নিচের বয়সের শিশুর কাজকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যায় না। ৮৩ ধারায় বলা হয়েছে যে, সাত থেকে বার বছরের শিশুর কাজকে অপরাধ বলা চলে না, কারণ এ বয়স পর্যন্ত তার যথেষ্ট পরিমাণে বুদ্ধিবৃত্তি বিকশিত হয় না। এছাড়া আরও নানাবিধ আইন আছে।
বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের অপরাধ অনেক বেশি জটিল বিষয়। শিশুর অপরাধ প্রবণতা বিভন্ন দেশে বিভিন্ন রুপে দেখা দেয়। এই প্রবণতাগুলো কী কী তা তলিয়ে দেখা যাক।
দেশের প্রচলিত আইনকে অমান্য করা, কোন নিয়ম নিষ্ঠা না মেনে চলা, অবাধ্য হওয়া এবং অভিভাবকের সামনে আওতার বাইরে চলে যাওয়া, স্কুল বা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া, ভিক্ষা করে জীবনযাপন করা, দুশ্চরিত্র  লোকের সাথে মেলামেশা করা, অশ্লীল ও কদর্য ভাষা ব্যবহার করা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে আমরা অনেকেই জানি না যে অপরাধী শিশু ও অবহেলিত শিশুর মধ্যে পার্থক্য আছে। অবহেলিত শিশুর সঠিক অভিভাবক নেই। সে পিতামাতা বা অভিভাবকের দ্বারা বর্জিত। তাকে পিতামাতা ভালভাবে দেখাশুনা করে না, ঠিক বয়সে স্কুলে পাঠায় না, অসুখের সময় ঠিকমত ডাক্তার ও ঔষধ পথ্যের ব্যবস্থা করে না এবং এমন অভাব অনটনে তার জীবন শুরু হয় যার ফলে নৈতিক চরিত্রেরও অবনতি ঘটে।
সাধানণভাবে আমরা মনে করি যে পশ্চাদপদ, দরিদ্র ও অস্বাস্থ্যকর দেশের শিশুর অপরাধ প্রবণতা বেশি। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। সেকেন্ড ইউনাইটেড ন্যাশন কনগ্রেস অন দি প্রিভিশন অফ ক্্রাইম এন্ড দি ট্রিটমেন্ট অফ অফেন্ডারস, ১৯৬১ সালে লন্ডন অধিবেশনে ঘোষণা করেছে যে, প্রায় সব দেশেই শিশুর অপরাধ প্রবণতা আগের চেয়ে অনেক পরিমাণে বেড়ে গেছে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও সুইডেনে যেখানে জীবনযাত্রার মান উচ্চ এবং সমাজ উন্নতির ব্যবস্থাগুলো উন্নত ধরনের সেখানেই এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।
শিশুর অপরাধ প্রবণতার জন্য তার পরিবেশ অনেকটা দায়ী। এ পরিবেশ তার ঘরোয়া, সামাজিক ও নানাবিধ হতে পারে। গৃহের পরিবেশের দায়িত্ব মাতাÑপিতার। বাড়িতে সে শিখবে খারাপ ও ভালর পার্থক্য, আত্মদমন, অপরের প্রতি মঙ্গলবোধ ইত্যাদি। বাড়িতে না শিখলে এ সব পরে শেখা হয় না।
অপরাধী শিশুর জীবনীতে অনেক সময় দেখা যায়, মাতাÑপিতার কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে তার জীবন কেটেছে। দেখা যায় শিশুর শৃঙ্খলা কখনও খুব কঠোর আবার কখনও বা অত্যধিক আহ্লাদ দেয়া হয়েছে। মাতাÑপিতার বিপরীত ধর্মী মতবাদের জন্য শিশুর জীবনে বেশি আহ্লাদ  ও কঠোর শান্তি শৃঙ্খলা দুটোই দেখা গেছে। প্রখ্যাত  শিশু অপরাধী বিজ্ঞানী  বার্ট তার দি ইয়ং ডেলিনকুইন্ট বই এ বলেছেন যে, মাতাÑপিতার বিপরীত ধর্মী মতবাদই শিশুর জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। যেমন ধরা যাক বাবা খুবই গোড়া এবং মা উগ্র আধুনিকা অথবা বিপরীত, তাহলে ছেলেÑমেয়েরা বুঝতে পারে না তারা কাকে অনুসরণ  করবে। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে শিশুর মানসিক গঠন বা গড়ে ওঠা নির্ভর করে শিশু ও মাতাÑপিতার বিশেষ করে শিশু ও মাসহ পরিবারের ভালবাসার উপর। কেননা শিশুর স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই হল অন্যদের সাথে একই তালে চলার চেষ্টা করা। শিশু অনুকরণ প্রিয়। বাড়িতে সে যা করতে দেখে তাই সে অনুকরণ করে। বিশেষ করে ছেলে অনুকরণ করে তার পিতাকে এবং মেয়ে মাতাকে। ছেলেÑমেয়ের অপরাধ দমন করতে গেলে প্রথমেই মাতাÑপিতাকে অপরাধমুক্ত হতে হবে। তাদের নিজেদের ব্যবহার সংযত, শোভন ও মার্জিত হতে হবে। পিতাÑমাতার নিজেদের সম্পর্ক মধুর না হলে ছেলেÑমেয়ের জীবনে তার প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে।
শিশু ও মায়ের মধ্যে গভীর ভালবাসার সম্পর্ক থাকলে মা যে সকল কাজ পছন্দ করে না শিশু তা থেকে বিরত থাকে। পরবর্তী জীবনে এটা তাকে অনেক অপরাধ থেকে রক্ষা করে। শিশু ভালবাসা পেলে পরবর্তী জীবনে এটা তাকে অনেক অপরাধ থেকে রক্ষা করে। শিশু ভালবাসা না পেলে পরবর্তী জীবনে কাউকে ভালবাসতে  পারে না। ড:বাউলবে তার তার  ফোর জোবেনীল থিবস বইতে মন্তব্য করেছেন যে, এ ধরনের শিশু যদি অপরাধী হয় তাকে শোধরান খুবই কষ্ট কর।
অনেক সময় দেখা যায় যে মাতাÑপিতার সাতটি মেয়ে ও একটি ছেলে অথবা তার উল্টো। তখন মাতা সেই একমাত্র ছেলে বা মেয়েকে অতিরিক্ত আদর দিয়ে নষ্ট করে এবং অপর সাতজনকেও অনাদর করে নষ্ট করে। প্রতিটি শিশুর প্রতিই যথেষ্ট পরিমাণে মনোযোগ দেয়া দরকার। তাদের ভালবাসতে হবে এবং সহানুভূতিশীল মন নিয়ে তাদের সুবিধা-অসুবিধা আলোচনা করতে হবে। সব সময় তাদের সাথে অভিভাবকের মত আচরণ না করে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করলে ভাল হয়। শিশুদের সব সময় বাড়ির কাজের লোকদের হেফাজতে রেখে মাতাÑপিতার বাইরে যাওয়া উচিত নয়। কারণ অনেক সময় কাজের লোকের কাছে থেকে তারা খারাপ ধরনের কার্যকলাপ ও কথাবার্তা শেখে। বিশেষ করে মেয়েদের কখনই বাড়িতে আয়া ও অন্য কোন মেয়েদের না থাকলে পুরুষ কাজের লোকদের কাছে রেখে যাওয়া উচিত নয়।
আজকাল প্রায়ই দেখা যায় আহ্লাদ করে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের সাইকেল, গাড়ি ইত্যাদি কিনে দেয়া হয়। এসব নিয়ে  তারা কোথায় বা কার সাথে ঘুরে বেড়ায় তার কোন খবর রাখেন না মাতাÑপিতা। শিশুরা বাড়ি থেকে টাকা পয়সা চুরি করে সিনেমা দেখে, বিড়িÑসিগারেট খায়, রাস্তাঘাটে হৈ চৈ করে বেড়ায়। দুঃখের বিষয় শিশুরা বিনা টিকেটে ট্রেনে,বাসে ভ্রমন করে, শিক্ষকে মারে। আর সর্বোপরি পরীক্ষায় নকল করে পাস করে। এ বিষয়ে বড়রা পরোক্ষভাবে যে প্রশ্রয় দিচ্ছে না  তা বলা যাবে না। নৈতিক চরিত্রের এত অধঃপতন যেখানে সেখানে সমবেতভাবে একটা কিছু করা উচিত।
শিশুদের জন্য নানা রকম নির্দোষ আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা থাকা দরকার। শিশুর অপরাধ দমন করতে পারলে ভবিষ্যতে অপরাধীর সংখ্যা অনেক কমে যাবে। কারণ শিশুই হচ্ছে আগামী দিনের নাগরিক।


0 comments:

Post a Comment