Thursday, June 23, 2016

আতংক নিয়ে রাত কাটে পথশিশুদের



আতংক নিয়ে রাত কাটে পথশিশুদের
আলী ফোরকান
নাম শাবনুর বেগম। বয়স এগার-বার বছর। নতুন বাজার এলাকায় মাছের ঘরে কাজ করে। বছর দু’য়েক আগেও তার জীবনটা একেবারে ফুটপাতে এসে দাঁড়ায়নি। হোক দরিদ্র, তবু বাবা-মায়ের আদরেই বড় হচ্ছিল সে । শাবনুরের মা সন্তান জম্ম দিতে গিয়ে মারা যান। আর বাবা অন্য কাউকে বিয়ে করে অন্য কোথাও চলে গেছেন শাবনুরকে ফেলে। ক্ষুধার জ্বালায় শাবনুর ঘুরতে ঘুরতে খুলনায় চলে আসে। ভিক্ষা করতে ঘেন্না লাগে। তাই অন্যের দেখাদেখি মাছের ঘরে কাজ করতে শুরু করে সে। শাবনুরের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কথা হয় মমতাজ বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, খুলনা আসার দুই দিনের মাথায় যৌন নির্যাতনের শিকার হয় শাবনুর। এরপর এই ‘মমতাজ খালাই’ তাকে নরপশুদের হাত থেকে বাঁচিয়ে তার সঙ্গে রেখেছেন। তখন থেকে এই খালার কাছে রাত্রিযাপন করে শাবনুর। দেশে বর্তমানে প্রায় ৮ লাখ ৫০ হাজার পথশিশু রয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক পথশিশুর বেশির ভাগকেই ঘুমাতে হয় ফুটপাতে। আর এ কারণেই পথশিশুদের অধিকাংশকেই শিকার হতে হয় শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতনের । অনিরাপদ পরিবেশে রাত্রিযাপনের ফলে এরা সমাজের নানা অসঙ্গতির সঙ্গে পরিচিত হয়। যা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত করে, নষ্ট করে দেয় তার সুন্দরের স্বপ্ন আর কোমল অনুভূতিগুলোকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত এবং সরকারের অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও পথশিশুদের রাত্রিকালীন আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় পথশিশুরা প্রতিমুহূর্তে যে সকল পাশবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তা আমাদের উদ্বিগ্ন করে। তারা বলেন, আমাদের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের একটা বিরাট অংশকে অবহেলায় রেখে দেশের কোন উন্নয়ন প্রচেষ্টা অর্থপূর্ণ ও মানবিক হতে পারে না। সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস-এর হিসাব অনুযায়ী দেশে বর্তমানে প্রায় ৮ লাখ ৫০ হাজার পথশিশু রয়েছে। সামাজিক নানা অসঙ্গতির শিকার এসব শিশু বেড়ে উঠছে চরম হতাশা ও আশংকার মধ্য দিয়ে। অথচ সরকারের ইতিবাচক মনোভাব ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ পথশিশুদের এই হতাশা ও আশংকা কমিয়ে আনতে পারে। আর তা নিশ্চিত করতে পথশিশুদের প্রয়োজন রাত্রিকালীন নিরাপদ আশ্রয় সমস্যার সমাধান করা। শুধু রাত্রিকালীন আশ্রয় একজন শিশুর জীবনে হয়তো তেমন কোন কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না; যদি না শিশুটির শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। তারপরও পথশিশুদের রাত্রিকালীন নিরাপদ আশ্রয়ের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমান সরকার তার নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী জাতীয় বাজেটে পথশিশুদের রাত্রিকালীন আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছে। বর্তমান সরকারের এ ঐতিহাসিক উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে তা কিছুটা হলেও সমাজের সবচাইতে অবহেলিত ও নিপীড়িত মানুষের দুর্দশা লাঘবে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তবে সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও বাজেট বরাদ্দের পরও পথশিশুদের জন্য রাত্রিকালীন আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের কাঙ্খিত কাজটি এখনো বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। মনোবিজ্ঞানি ডা. মোহিত কামাল বলেন, উঠতি বয়সি এসব পথশিশুর মধ্যে ছেলে-মেয়ে উভয়েই নির্যাতনের শিকার হয়। এর মধ্যে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়নে যে শিশুরা শিকার হয় তাদের মনোজগতে একটা ভীতির সৃষ্টি হয়ে যায়। এখান থেকে অনেকে সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে। কেউ কেউ পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে। এসব শিশু স্নেহ মায়া মমতা বঞ্চিত বলে এরা পরবর্তী জীবনে নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয়ে থাকে। এরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অনেকে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। এদের জীবনে আগ্রহ, চাহিদা, উৎসাহ, আকাঙ্খা বলে কিছু থাকে না। ইনসিডিন বাংলাদেশের পরিচালক নাসিমুল হাসান বলেন, পথশিশুদের উন্নয়নের প্রধান শর্ত হচ্ছে রাত্রিকালীন নিরাপদ আশ্রয়। তাদের শারীরিক ও মানসিক সুরক্ষা, উপযুক্ত পরিবেশ, শিক্ষা ও উন্নয়নের অধিকার, ব্যক্তিগত সম্পদ সুরক্ষার অধিকার এবং সর্বোপরি বিকাশের অধিকার, সবকিছু নির্ভর করে পথশিশুর রাত্রিকালীন নিরাপদ আশ্রয়ের উপর। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে বিশেষ করে প্রকল্প ভিত্তিক উদ্যোগে কেবল গুটিকয়েক পথশিশুর রাত্রিকালীন নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা সম্ভব হলেও মোট পথশিশুর অধিকাংশই রাত কাটায় নিরাপত্তাহীনতা ও চরম উৎকণ্ঠায়- যা আমাদের কারো কাম্য নয়। 

0 comments:

Post a Comment