Monday, May 16, 2016

৫ দিন আগে সাপ ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে সক্ষম

৫ দিন আগে সাপ ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে সক্ষম 

আলী ফোরকান
বনাঞ্চলে খাদ্যাভাবে লোকালয়ে ছুটছে বন্যপ্রাণী। ক্ষুুধার জ্বালায় বনের রাজাও লোকালয়ে এসে মারা পড়ছে তাড়া খেয়ে। সুন্দরবনসহ বিভিন্ন বনাঞ্চলে পানীয় জল ও খাদ্যের অভাবে মারা যাচ্ছে এসব বন্যপ্রাণী। ক্ষুধার জ্বালায় বন্যপ্রাণীগুলো প্রায়ই লোকালয়ে এসে দিগি¦দিক ছোটাছুটি করে। স্থানীয় বাসিন্দাদের তাড়া খেয়ে এসব ক্ষুধার্ত ও দুর্বল বন্যপ্রাণীর মধ্যে বেশ কিছু পালাতে না পেরে মারা পড়ছে। সাধারণত নভেম্বরের প্রথম থেকে এপ্রিল-মে পর্যন্ত উপকূলীয় নদীগুলোতে লোনা পানি থাকে। বন্যপ্রাণীরা এই তীব্র লবণাক্ত পানি পান করতে না পেরে লোকালয়ে এসে পুকুরের পানি পান করে। অন্যদিকে আছে খাদ্য সংকট। এ ছাড়া বন উজাড় হয়ে যাওয়ায় বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল সংকুচিত হয়েছে। দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকটও। খাদ্যের সন্ধানে এসে গত এক যুগে গণপিটুনি ও বন্দুকের গুলিতে লোকালয়ে ঢুকেপড়া ১২টি বাঘ মারা পড়েছে। একই সময়ে বাঘের আক্রমণে সুন্দরবন সংলগ্ন জনপদের ৬ জন নারী-পুরুষ নিহত হয়েছেন। ঠিক এমন পরিস্থিতিতে খুব শিগগিরই সুন্দরবনে শুরু হচ্ছে বাঘশুমারি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে ৩৩ জনকে নিয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। সাতক্ষীরা বাঘ-বিধবাদের সংগঠন লিডারের পরিচালক মোহন ম-ল জানান, গত ১১ বছরে কেবল সাতক্ষীরার সুন্দরবন সংলগ্ন জনপদে কমপক্ষে ২৮টি বাঘ নদী সাঁতরে লোকালয়ে প্রবেশ করে। এর মধ্যে ১২টি বাঘ গণপিটুনি ও বন্দুকের গুলিতে মারা যায়। বন বিভাগের হিসেবে, ১৯৮৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মোট ৬৩টি বাঘ হত্যার শিকার হয়। ২০০৯ সালের শেষের দিকে দুটি বাঘ গণপিটুনিতে মারা যায়। ১৯৯৭ সালে সবচেয়ে বেশি ৮টি বাঘ প্রাণ হারায়। এর মধ্যে বেশি মারা পড়ে চাঁদপাই রেঞ্জে। সুন্দরবনে চোরা শিকারি, কাঠ পাচারকারীদের উৎপাত তথা পেশাজীবীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বাঘের আবাসস্থলের প্রকৃতি পরিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন সুন্দরবনের সমুদ্র উপকূলবর্তী গভীর জঙ্গলে উচ্চ পানির চাপ হওয়ায় উপযোগী মিঠা পানির অভাবে বাঘ সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। এ ছাড়া সুন্দরবনের পেশাজীবীরা অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে বনজসম্পদ সংগ্রহের জন্য প্রান্তসীমায় চলে আসার কারণে বাঘের সঙ্গে মানুষের ঘন 
ঘন দেখা হয়ে যায়। সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক রাজেশ চাকমা বলেন, চোরা শিকারিদের কারণে যে পরিমাণ হরিণ মারা পড়ছে সে পরিমাণ জন্ম নিচ্ছে না। অব্যাহত প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবনের পরিবেশের ক্ষতি হয়ে শিকার কমে যাওয়ায় বনের পাশ দিয়ে প্রবাহিত শুকিয়ে যাওয়া নদী বা খাল পার হয়ে খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে প্রবেশ করছে বাঘ। এদিকে গণআন্দোলনের মুখে সুন্দরবনে এসবিসিপি প্রকল্পের কালো অধ্যায় শেষে এবার বাস্তবায়ন হচ্ছে মার্কিন অর্থায়নে আইপ্যাক প্রকল্প। এ প্রকল্পে বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসনের পাশাপাশি সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য বিপন্ন ও তেল-গ্যাস লুণ্ঠনের শঙ্কা আরো প্রকট হয়েছে। এ প্রকল্প নিয়ে কর্তৃপক্ষ বারবার রহস্যময় আচরণ করছে। আইপ্যাক প্রকল্প সম্পর্কে জানার জন্য বন সংলগ্ন মানুষ ও পরিবেশবাদী সংগঠনের কর্মীরা প্রথম থেকেই দাবি জানিয়ে আসছেন। সঙ্গে সঙ্গে তারা সেখানে জন অংশগ্রহণ নিশ্চিত করারও দাবি তুলেছেন। সুন্দরবন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ প্রকল্প (এসবিসিপি) আন্দোলনের মুখে বন্ধ রয়েছে। ঘটনার ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে মার্কিন সাহায্য সংস্থা (ইউএসএআইডি) পরামর্শক সংস্থা (আইআরজি) বন ও পরিবেশ পর্যটনকে উৎসাহ দিতে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ডরমেটোরি, ট্রেইল, হাঁটার পথ এবং ব্রিজ তৈরির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এখানেও দেশের প্রচলিত বন আইন উপেক্ষার অভিযোগ উঠেছে। গহিন জঙ্গলে পর্যটকদের চাহিদা ঘটাতে রঙিন সাইন বোর্ড ও তথ্য বিলবোর্ড বাঘ-হরিণের চলাচল ও প্রজননকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করে। যা বণ্যপ্রাণী বিলুপ্তিতে ভয়ানক ভূমিকা পালন করে। ঠিক এমন অবস্থায় শিগগিরই সুন্দরবনে বাঘশুমারি শুরু হচ্ছে। ইউএনডিপির ২০০৬ সালের পরিসংখ্যানে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪২টি, ২০০৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত তথ্যমতে, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪০। এর আগে ১৯৯৩-৯৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৬২। অন্য একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, খাদ্যাভাবে মৌলভীবাজার জেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বন্যপ্রাণীরা খাদ্যের জন্য লোকালয়ে আসছে। আর লোকালয়ে আসার কারণে এসব দুর্লভ বন্যপ্রাণী কখনো মানুষের হাতে, কখনো গাড়ি চাপা পড়ে, আবার কখনো কুকুরের হাতে পড়ে মারা যাচ্ছে। একইভাবে গত বছর ওই জেলায় ১১টি বন্যপ্রাণী মারা
পড়ে। এইসব বন্যপ্রাণীর বিলুপ্তি বা মৃত্যুর কোনো পরিসংখ্যান নেই। যতদূর জানা যায়, গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে কুলাউড়া বড়লেখা সড়কে গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে একটি চিতাবাঘ মারা পড়ে। এপ্রিল মাসে রাজনগর কুলাউড়া সড়কে গাড়িচাপায় মারা পড়ে প্রায় তিন ফুট লম্বা ও দুই ফুট উঁচু একটি বনবিড়াল। সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে শ্রীমঙ্গলের পাহাড়ি এলাকায় মারা পড়ে আরেকটি ছোট বাঘ। জানুয়ারিতে লাউয়াছড়ায় প্রায় ১৩ ফুট লম্বা ও প্রায় ১০০ কেজি ওজনের একটি অজগর সাপ মারা পড়ে পাহাড়িদের হাতে। প্রায় একই সময়ে কমলগঞ্জের উপজাতীয়দের হাতে ধরা পড়ে ‘ধূমকল’ নামক একটি বিরল প্রজাতির প্রাণী। একই মাসে শ্রীমঙ্গলে মারা পড়ে একটি মেছো বাঘ। আগস্ট মাসে সদর উপজেলার রায়পুর গ্রামে ধরা পড়ে আরো একটি মেছোবাঘ। ডিসেম্বর মাসে শ্রীমঙ্গলে একটি উল্লুক মারাত্মক আহত অবস্থায় ধরা পড়ে। আগেই বলেছি, বন্যপ্রাণীদের হতাহতের কোন হিসাব বা পরিসংখ্যান সংশ্লিষ্ট দফতরে নেই। আবার পত্র-পত্রিকায় বন্যপ্রাণীর হতাহতের সব ঘটনাও প্রকাশ পায় না; কিন্তু বাস্তব অবস্থা হচ্ছে, দেশে বন্যপ্রাণী, বিরল প্রজাতির প্রাণী অহরহ হতাহত হচ্ছে। চিড়িয়াখানার তত্ত্বাবধানে থেকেও মারা পড়ছে অনেক বিরল প্রজাতির প্রাণী। বনাঞ্চল উজাড় হওয়ায় ওইসব বন্য ও বিরল প্রজাতির প্রাণী কখনো খাবারের খোঁজে আবার কখনো আশ্রয়ের আশায় লোকালয়ে ছুটে আসে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদ্রা অনন্তপুরের চিতাবাঘটি ধরা পড়ে স্থানীয় খালের পাইপের ভেতর। যার থাকার কথা গহীন অরণ্যে সে এখন আশ্রয় খুঁজছে পাইপের ভেতর। বনাঞ্চলের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে সুন্দরবনের কথা। সুন্দরবনে রয়েছে ৩৩৪ প্রজাতির গাছ-গাছালি। ৫ হাজার ৭৭২ বর্গমাইলের সুন্দরবন। এটি বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৪ দশমিক দুই শতাংশ। সুন্দরবনে তিনটি অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হয়েছে; কিন্তু রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি সুন্দরবনের আয়তন ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। নির্বিচারভাবে উজাড় হয়ে যাচ্ছে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত সুন্দরবন। অথচ এখানে রয়েছে ৪৪২টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এছাড়াও এখানে রয়েছে প্রচুর চিত্রল হরিণ, বানর, বন্য শূকর, উদ, অজগর ও বন বিড়ালসহ নানা জাতের প্রাণী। রয়েছে নানা জাতের সরীসৃপ ও বহু ধরনের হাঙ্গর ও কুমির। ১৯৮৭ সালে সুন্দরবন উপকূলে মোট ম্যানগ্রোভ অরণ্যের আয়তন ছিল ৪২০ হাজার হেক্টর। পরবর্তী দশ বছরে এর আয়তন হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ২১২ দশমিক ৩ হাজার হেক্টর। এই অবস্থায় বিশেষত মানুষের নির্বিচার বন নিধনে দেশের শত শত বনাঞ্চল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সুন্দরবনও হ্রাস পাচ্ছে। দুই-চারটা অভয়ারণ্যে বন্যপ্রাণীদের স্থান সংকুলান হচ্ছে না। বাধ্য হয়েই বন্যপ্রাণীদের লোকালয়ে যেতে হচ্ছে। তাদের মারা পড়ার এটাও অন্যতম কারণ। গোখরো সাপের বিষ থেকে পাওয়া গেছে হার্টের মারাত্মক ব্যাধির ওষুধ।
অতি সম্প্রতি চীনা বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় ১২টি শহরের ১৪৩ প্রজাতির প্রাণী মনিটরিং করে দেখতে পায় যে, সাপ ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে সক্ষম। ভূমিকম্প সংঘটনের ৫ দিন আগে ১২০ কিলোমিটার দূরে থেকেও সাপ আসন্ন ভূমিকম্পের দুর্যোগের আভাস পায় এবং অদ্ভুত আচরণ শুরু করে দেয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, খামারে সাপের এই আচরণ থেকে সংকেত পেয়ে মানুষ যদি আগে থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করে, তাহলে ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা থেকে লাখ লাখ প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হবে। মানুষের খাদ্য যে ফসল এর ক্ষতিকারক হচ্ছে পোকামাকড়। এ পোকামাকড় খায় ব্যাঙ আর ব্যাঙ হচ্ছে সাপের খাদ্য। আবার গোসাপ যদি সাপের ডিম না খায় তাহলে সাপের অত্যধিক প্রাদুর্ভাবে ভূপৃষ্ঠে মানবজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ত। এভাবেই পরম স্রষ্টার ‘চেইন অব কমান্ড’ বিশ্বের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে চলছে। আজ যে আমরা বন-জঙ্গল উজাড় করে মেছো বাঘ, চিতাবাঘ, বন বিড়ালের মতো বন্যপ্রাণীর জীবন ধারণ অসম্ভব করে তুলেছি, তারাও নিশ্চয়ই কোনো না কোনোভাবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অবদান রেখে চলছে। সব বিষয় এখনো সম্যকভাবে উদ্ঘাটিত হয়নি। কিন্তু ইতিমধ্যে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী হকিং হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, পরিবেশের ভারসাম্যহীনতায় অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবী মনুষ্য বাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। পরিবেশের এই ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলে মানুষকে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অন্য কোনো গ্রহে আবাসস্থল খুঁজতে হবে। বন্যপ্রাণীর জন্য বন-জঙ্গল সৃষ্টি ও সংরক্ষণের গুরুত্ব এখানেই। তথ্যসূত্র : গার্ডিয়ান  পত্রিকা অবলম্বনে (অক্টোবর ২০১০) 

0 comments:

Post a Comment