Tuesday, May 24, 2016

হতদরিদ্রদের ভাগ্যোন্নয়নের উদ্যোগ বাস্তবায়ন হউক

হতদরিদ্রদের ভাগ্যোন্নয়নের উদ্যোগ বাস্তবায়ন হউক
আলী ফোরকান 
দারিদ্র্য মানবজীবনের এক অভিশপ্ত যন্ত্রণা। দারিদ্রের দুঃসহ দহনে মানুষের স্বভাবসুন্দর জীবন ধারা ব্যাহত হয়ে পড়ে। দারিদ্র্যের দৌরাত্ম্যে মানুষের স্বপ্ন ও আশা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যায়। দারিদ্র্য মানুষকে হতাশাগ্রস্থ করে তোলে। তাই পৃথিবীব্যাপী মানুষ দারিদ্র্য বিমোচনের প্রাণান্তকার সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। দারিদ্র্য ব্যক্তিজীবন বিকাশে যেমন চরম বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি জাতীয় সমৃদ্ধির ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। দারিদ্র্যের কারণে মানুষ অনেক সময় মৃত্যুর মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ায়। মোট কথায়, দারিদ্র্য একটি জাতিকে বির্পযস্ত এবং বিধ্বস্ত করার পেছনে চরম অভিশাপ হিসেবে কাজ করে। এ চরম দারিদ্র্যতা থেকে মুক্ত হতে স্বাধীন হয়েছি আমরা। কিন্তু স্বাধীনতার পর পার হয়ে গেছে ৪৫ বছর। কতগুলো পঞ্চবাষির্কী পরিকল্পনা শেষ হলো, পোভাটি রিডাকশন স্টেটেজি হলো, কিন্তুু দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হলো না কাঙ্খিত হারে। এদিকে কত আধুনিক ভোগ্য পণ্য, বিপনন ব্যবস্থা দেশে দেখা যাচ্ছে। হাইরাইজ ভবন উঠছে। তবু এখনও এতো ভিক্ষুক এতো কাঙাল এতো উপোস, এতো ন্যূনতম উপকরণ বর্জিত মানুষ কেন চারিদিকে ঘোরাফেরা করে। স্বাধীনতার পর দেশে বড় লোকের সংখ্যাও বাড়ছে। বেশির ভাগ মানুষই নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং অতি দরিদ্র। বিগত সময়ে ধনী -দরিদ্র্য বৈষম্য্টাও প্রকট হয়েছে। দারিদ্র্যরেখার নীচে যারা ছিল তারা আবহমান কাল থেকেই ট্রাডিশন বহন করে চলেছে । ফলে বৈষম্য্টা বড় বেশি চোখে পড়ে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় তৈরি পোশাক খাতে কাজ করা শ্রমিক, রংপুর এলাকায় প্রান্তিক চাষী , বরিশালের উপকূলের মানুষ কিন্তুু দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এদের সংখ্যা ঠিক কত হবে ? তার সঠিক কোন ধারণা কেউ দিতে পারে না। এই শ্রেণীর কয়েক কোটি মানুষ এখনও উদরপূর্তির স্বপ্ন দেখে দিন কাটায় । পরিসংখ্যান বুরে‌্যার রিপোর্ট অনুসারে দারিদ্র্যরেখার নিচে বাস করে দেশের মোট জনসংখ্যার দুই কোটি মানুষ। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরে‌্যার ওয়েল ফেয়ার মনিটরিং সার্ভেতে বলা হয়েছে, দেশের ৭৭ শতাংশ পরিবারের জীবন যাত্রা দারিদ্র্যের সীমা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ পরিারের অবস্থার উন্নতি হয়নি এবং ৩৭ শতাংশের অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। এই দারিদ্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে সরকার সম্প্রতি দেশের ৫ লাখ হতদরিদ্র পরিবারকে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ গ্রহণ  করেছে। এতে সারাদেশের ৯ হাজার ৬৪০টি গ্রামের ৫ লক্ষ ৭৮ হাজার চারশত পরিবার উপকৃত হবে বলে জানা যায়। প্রকল্প পরিকল্পনার আওতায় ২০ হাজার সোলার প্যানেল, একশত গভীর নলকূপ, ৯৬ হাজার গাছের চারা, ৯০ হাজার উন্নত জাতের গাভী ও এক লাখ হাঁস-মুরগি প্রদান করা হবে। সেই সাথে স্থাপন করা হবে ৪৮২টি দুগ্ধ খামার ও এক হাজার ৯২৮টি নার্সারি। প্রকল্পের আওতায় ল্যাট্রিন স্থাপন ও উন্নত মানের সবজি বীজ সরবরাহের বিষয়টিও অর্ন্তভুক্ত রয়েছে। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ বিআরডিবি (বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড), মিলিটারি ফার্ম, বিডিআর-আনসার ডেইরি ফার্ম, প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড) কুমিলা, পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (আরডিএ) বগুড়া, বন বিভাগ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর প্রভৃতি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হবে। বস্তুত এই উদ্যোগের কেতাবি নাম ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প। ১৯৯৬ সালে প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর শেখ হাসিনার সরকার এ রূপ কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। সে সময় একে গ্রামীণ অর্থনীতির রোল মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। একই সময়ে বলা হয়েছিল এটি সৃজনশীল চিন্তাপ্রসূত। কিন্তু চারদলীয় জোট সরকারের সময় এই প্রকল্পের কার্যক্রম স্থবির হয়ে যায়। প্রকল্পে অর্থ সরবরাহকারী দাতাসংস্থার ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হউক এই কার্যক্রম আর দেখা যায়নি। দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে এসে বর্তমান সরকার প্রথম বাজেটেই (২০০৯-১০) এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ১২শত কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ করে। আবার নূতন অর্থ বছরে বরাদ্দের অর্থ এই প্রকল্প এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর হতে অদ্যাবধি হতদরিদ্রদের ভাগ্যোন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন শ্লোগান যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছে। এ ব্যাপারে গ্রহণ করা হয়েছে নানা প্রকল্প ও কর্মসূচি। এতে কারও যে লাভ হয়নি সে কথা বলা সমীচীন হবে না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এর ফলে সার্বিকভাবে গরিবি হালাতের কোন পরিবর্তন আসেনি। বরং দিন দিন দারিদ্র্যতা বাড়ছে । এ কথার স^পক্ষে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘মৌলিক সুযোগ-সুবিধা পরীক্ষণ জরিপ:২০০৯’-এর প্রতিবেদনের সারাংশ উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ৭৫ শতাংশ এখনও কাঁচাঘর ও ঝুপড়িতে বসবাস করে । রাতের বেলা প্রায় অর্ধেক পরিবারের আলোর ব্যবস্থা হয় কেরোসিনের প্রদীপে। বিনোদনের জন্য ৬০ শতাংশ পরিবারের নাই কোন রেডিও বা টেলিভিশন। দারিদ্র্যের হার ৪১ দশমিক ২ শতাংশ। তš§ধ্যে হতদরিদ্রের সংখ্যা ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। ধনী লোকের সংখ্যা মাত্র ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এই জরিপ বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত হয় এবং জরিপকালে বিদেশী পরামর্শকও দায়িত্ব পালন করেন। যারা কোন না কোনভাবে আমাদের দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে জড়িত তাদের দ্বারা দারিদ্র্য বৃদ্ধির এই সরল স্বীকারোক্তি বেমানান এবং একইসঙ্গে উদ্বেগ ও হতাশাজনক। মূলত দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পের নামে এভাবে মানুষের আর্থিক দুর্দশা দূর করার চেষ্টা হাস্যকর ও রসিকতা মাত্র। একমাত্র তৃতীয় বিশ্বেই এরূপ প্রবণতা বিরাজমান। এতে মন্ত্রী, নেতা-কর্মী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিকট সাহায্য প্রত্যাশী এক শ্রেণীর লোকের সাময়িক উন্নতি হলেও এর মাধ্যমে সারাদেশের দারিদ্র্য দূর করা মোটেই সম্ভব নয়। ভিজিএফ কার্ড, ন্যায্যমূল্যের দোকান, যাকাতের কাপড় বিতরণ, কাঙালি ভোজ প্রভৃতি উদ্যোগে হতদরিদ্রের অবস্থার পরিবর্তন হবে না। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে সাময়িকভাবে জনমত প্রভাবিত করা যেতে পারে। কিন্তু ব্যক্তি ও জাতীয় পর্যায়ে সম্পদ ও আয়-ইনকাম না বাড়ানো পর্যন্ত অর্থনৈতিক মুক্তি অসম্ভব। বাজেট সারপ্লাস বা উদ্বৃত্ত না হলে ভর্তুকি বা অনুদান দেওয়া একেবারেই বৃথা। তাই সার্বিক অবস্থার পরিবর্তন ও কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণে ছোট-বড়-মাঝারি সব প্রকার শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি সঞ্চারিত করা বাঞ্ছনীয়। এজন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অব্যাহত গণতন্ত্র চর্চা, স্বাধীন অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন, বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন, জ্বালানি খাতের বিকাশ ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার কোন বিকল্প নাই। অপরদিকে আইএলও’র এক রির্পোটে বলা হয়েছে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এ বছর এশিয়ায় ১৪ কোটিরও বেশি লোক দারিদ্র্যের শিকার হবে। আর ২ কোটি ৩০ লাখ লোক চাকুরী হারাতে পারে। আর্ন্তজাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সমীক্ষা রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, এই সংকটের কারণে নতুন করে লোকজন গ্রাম থেকে শহরে পাড়ি জমাবে। শিল্প কলকারখানা থেকে ছাঁটাইয়ের কারণে অনেকেই কম মজুরির কৃষিখাতে ফিরে যাবে। সমীক্ষায় আরো বলা হয়, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দরিদ্র কর্মজীবী পরিবারের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পাবে এবং ১৪ কোটি লোক দারিদ্র্যের শিকার হতে পারে। সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়, এ সমস্যা কেবল সংখ্যাগত নয়, এটি তাদের জন্যে প্রকৃতই ঝুঁকি তৈরি করবে এবং এ কারণে ছেলেমেয়েরা পরিবারকে সাহায্য করতে স্কুল ছাড়তে বাধ্য হতে পারে। এছাড়া অতীতে এ অঞ্চলে বিশাল প্রবৃদ্ধির বিপরীতে প্রকৃত মজুরীর ক্ষেত্রে ব্যাপক ভিত্তিক অর্জন ঘটেনি বলে তা বহু দেশে তীব্র বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে। এ অঞ্চলে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেতে থাকায় তা স্থবিরতা সৃষ্টি অথবা প্রকৃত মজুরী কমিয়ে দেবে। ফলে মুজুরী কেন্দ্রিক সংঘাত বৃদ্ধি পেতে পারে। আইএলও’র আঞ্চলিক এ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে বলেন, এ সংকট দ্রুতই চাকরি ও সামাজিক সংকটের ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ছে। ম্যানিলায় এশিয়ার ১১টি দেশের সিনিয়র নীতি নির্ধারকদের বৈঠকে তিনি আরো বলেন, এশিয়ার শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় দেশে সংকটের প্রভাব গভীরভাবে পড়বে। এতে বলা হয়, উদ্ধার পরিকল্পনা হিসেবে এশিয়া তার জিডিপি’র প্রায় তিন দশমিক নয় শতাংশ ব্যয় করতে যাচ্ছে। কিন্তু চাকরির বাজার রক্ষা এবং পরিবারগুলোর ক্রয়ক্ষমতায় সহযোগিতা করাও প্রয়োজন। এছাড়া অবকাঠামোখাতে উদ্ধার পরিকল্পনা কাজে লাগানো হলে তা সরাসরি কাজের সুযোগ এবং প্রবৃদ্ধির ভবিষ্যৎ ভিত তৈরি করবে। আমরা আশা করি, আমার দেশে দারিদ্র্য দূরীকরণে এরূপ আন্তরিক ও স্বত:স্ফূর্ত “উদ্যোগ” একদিন বাস্তব রূপ নেবে।
০১৭১১৫৭৯২৬৭

0 comments:

Post a Comment