Wednesday, April 27, 2016

নোবেল পুরস্কার ও রবীন্দ্রনাথ

নোবেল পুরস্কার ও রবীন্দ্রনাথ
আলী ফোরকান 
ছোট্ট বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয় নোবেল পুরস্কারের নাম শুনেছ। ১৯১৩ সালে বিশ্বের সব চেয়ে মর্যাদাশীল এই পুরস্কার লাভ করেছিলেন আমাদের বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সে খবরও হয়তো তোমাদের অজানা নয়। রবীন্দ্রনাথের নোবেল-বিজয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তথা বাঙালি জাতিকেই এনে দিয়েছে বিশ্ব পরিচিতি ও বিরল সম্মান। এই সূত্র ধরেই আজো আমরা সারা পৃথিবীর মানুষের সামনে গর্ব করে বলতে পারি- আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, এই ভাষাতেই রচিত হয়েছে বিশ্বসাহিত্যের সমকক্ষ সেরা সাহিত্য। কিন্তু তোমরা কি এই নোবেল পুরস্কারের গোড়ার ইতিহাস জানো? কখন, কোথায়, কীভাবে নোবেল পুরস্কারের জš§, কিংবা মনে কর আমাদের রবীন্দ্রনাথইবা কোন বইয়ের জন্যে, কীভাবে এই পুরস্কার অর্জন করলেন, পুরস্কারের অর্থ কীভাবে খরচ করলেন- এসব টুকিটাকি খবরও তো জানা দরকার। এসো প্রথমেই সংক্ষেপে জেনে নিই নোবেল পুরস্কারের জš§কথা। নোবেল পুরস্কারের জনক আলফ্রেড বার্নাড নোবেল (১৮৩৩-৯৬) সুইডেনের মানুষ। সত্যিকারের অর্থে বড় মাপের মানুষ। তিনি ছিলেন রসায়ন বিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, বহু ভাষাবিদ এবং সফল ব্যবসায়ী। আরো একটা খবর জেনে রাখো, তিনি কবিতাও লিখতেন। তার মানে, তিনি কবিও বটে। তবে তাঁর বিজ্ঞানী পরিচয়টাই সব চেয়ে বড় হয়ে আছে। আজীবন মানব কল্যাণে বিজ্ঞান সাধনা করেছেন। তাঁর সেরা আবিষ্কার হচ্ছে ডিনামাইট। তাই অনেকে তাকে ডিনামাইটের জনকও বলে। আলফ্রেড বার্নাড নোবেলের সারা জীবনের ব্রত ছিল বিশ্বমানবতার কল্যাণ ও উন্নয়ন। এই মহান লক্ষ্য নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের যেসব মহৎ মানুষেরা জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা, সাহিত্য সাধনা, শান্তি প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন, তাঁদের মূল্যবান কাজের স্বীকৃতি প্রদানের উদ্দেশ্যে তিনি প্রবর্তন করেন নোবেল পুরস্কার। ১৮৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর এক উইলের মাধ্যমে আলফ্রেড নোবেল তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সমুদয় সম্পত্তি সুইডিশ একাডেমীকে দান করেন এবং উক্ত সম্পত্তির বাৎসরিক সুদের টাকায় নির্দিষ্ট পাঁচটি ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার প্রদানের সুপারিশ করেন। সেই পাঁচটি ক্ষেত্র হচ্ছেঃ ১. পদার্থবিদ্যা ২. রসায়নবিদ্যা ৩. শরীরবিদ্যা ও চিকিৎসা শাস্ত্র ৪. সাহিত্য এবং ৫. আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরস্ত্রীকরণ উদ্যোগ। মানবজাতির উন্নয়নের লক্ষ্যে এই পাঁচটি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতি। হিসেবে সুইডিশ একাডেমী ১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরস্কার প্রদান শুরু করে। এই পুরস্কারের বর্তমান মূল্য প্রায় পাঁচ কোটি টাকার কাছাকাছি। একেবারে শুরু থেকেই নোবেল পুরস্কার ধনে ও মানে সারা দুনিয়ার সেরা পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। গোড়াতে পাঁচটি ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার প্রদানের প্রচলন হলেও নোবেল ফাউন্ডেশন ১৯৬৮ সাল থেকে নিজ দায়িত্বে অর্থনীতি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে নোবেল পুরস্কার চালু করে। ফলে এখন মোট ছয়টি ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। আনন্দের কথা হচ্ছে, এই নতুন ক্ষেত্রে অর্থাৎ অর্থনীতিতে অত্যন্ত তাৎপর্যময় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ইতিমধ্যেই আরো এক বাঙালি সন্তান অমর্ত্য সেন অর্জন করেছেন নোবেল পুরস্কার, বাঙালি জাতি পুনর্বার হেসেছে বিজয়ের হাসি। এবার আসি নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথের কথায়। তোমাদের হয়তো জানা আছে রবি ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তাঁর গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্যে। এ কাব্য তো বাংলা ভাষায় রচিত। তবে কি সুইডিশ একাডেমীর বিচারকেরাও বাংলা জানেন? নইলে গীতাঞ্জলিতে কী লেখা আছে সে কথা জানলেন কী করে? কিছু না জেনে না বুঝে তো পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি! তাহলে! এসব নিয়ে প্রশ্ন জাগে না তোমাদের? না, সোজা কথা জানিয়ে দিই, বিদেশী সাহেবরা বাংলা ভাষায় গীতাঞ্জলি পড়েননি। পড়েছেন ইংরেজিতে। অর্থাৎ চর্বিত চর্বণ। মানে বুঝলে না তো! কারো চিবিয়ে দেয়া খাবারে আসল মজা পাওয়া যায়, বলো! অনুবাদও ওই রকম। যত ভালো অনুবাদই হোক, তাতে কিছুতেই মূলের স্বাদ মেলে না। অনেকে তো বলেন- কবিতার আসলে অনুবাদই হয় না। তবু আমাদের সৌভাগ্য যে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ পড়েই সেদিন অবাঙালি সাহেবরা মুগ্ধ হয়েছিলেন। যদি তাঁরা বাংলা ভাষা জানতেন এবং বাংলায় লেখা গীতাঞ্জলি সরাসরি পড়তেন, ভাবতে পারো কতটা উচ্ছ্বসিত হতেন! তবে হ্যাঁ, ইংরেজি অনুবাদটি করেছিলেন কবি নিজেই। নাম দিয়েছিলেন ঝড়হম-ঙভভবৎরহমং। পদ্যের অনুবাদ করলেন কবি গদ্যে, কবিতায় কী বলতে চেয়েছেন, সেটাই কোনো রকমে ইংরেজিতে তুলে ধরা। তাতেই সাহেবদের মাথা খারাপ- একজন বাঙালি এমন উন্নত ভাবনা ভাবতে পারেন! সত্যিই তারা অভিভূত। গীতাঞ্জলির এই অনুবাদের একটুখানি ইতিহাস আছে। রবীন্দ্রনাথ ১৯১২ সালে যাচ্ছেন বিলেতে। সঙ্গে পুত্র রথীন্দ্রনাথ এবং পুত্রবধু প্রতিমা দেবীও আছে। কবি এর আগেও বিলেতে গেছেন দু’বার। একবার লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে। আরেকবার মধ্য যৌবনে, বেড়াতে। কিন্তু এবার? এবারও বেড়ানোই বলা যায়। পরিণত বয়সে মুক্ত মনে এবং পূর্ণ দৃষ্টিতে ইউরোপকে দেখবেন। বেড়াতে যাবেন, খালি হাতে? তাই কখনো হয়! বাঙালির শিষ্টতা বলেও একটা ব্যাপার আছে। কী নেবেন কবি বিলেতের জন্যে? জাহাজে বসে গান লিখছেন, দু’চারটি কবিতাও আসছে। গীতাঞ্জলি থেকে দু’দশপাতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন নিজের মত করে; সেগুলো নাড়াচাড়া করতে গিয়ে মনে হলো- কেমন হয় এগুলোই যদি ওদের হাতে দিই! লন্ডনে কবির পরিচিতদের মধ্যে আছে এক ভক্ত রোডেনস্টাইন। ভালো ছবি আঁকে, সাহিত্য রসিক। মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের কাবুলিঅলা নামক গল্পের অনুবাদ পড়ে এতই মুগ্ধ হয় যে, বছর দুই আগে জোড়া সাঁকোর বাড়িতে এসে কবির সঙ্গে পরিচিত হয়ে যায় এবং চিঠিপত্রে বারবার বিলেত ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানায়। এবার কবি লন্ডনে পৌঁছে প্রথমে সেই ভক্ত রোডেনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করেন এবং গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের খাতা তুলে দেন তার হাতে। কবিতাগুলো পাঠ করে অভিভূত রোডেনস্টাইন সেই খাতা দিয়ে আসে ইংরেজি ভাষার বিখ্যাত কবি ইয়েট্সের কাছে। ব্যাস্! আর পেছনে তাকাতে হয়নি। অনুবাদ পাঠে মুগ্ধ ইয়েট্স নিজে ছুটে এসে রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানালেন। জর্জ বার্নাড শ, রবার্ট ব্রিজেস, এজ্রা পাউন্ড, জন মেসফিল্ডসহ কত যে গুণীজনের সঙ্গে পরিচয় হলো। কবি ইয়েটসের সভাপতিত্বে একদিন সংবর্ধনা সভাও হয়ে গেল। সেখানে গীতাঞ্জলির ওই অনুবাদের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। মাস চারেক ইংল্যান্ডে কাটিয়ে কবি চললেন আমেরিকা। এখানকার মানুষ বক্তৃতাবিলাসী। বক্তৃতা শুনতে এবং শোনাতে ভালোবাসে। রবীন্দ্রনাথ আর্বানা, শিখাগো, রচেস্টার প্রভৃতি স্থানে বক্তৃতা করে সবাইকে মুগ্ধ করলেন। এরপর বোস্টন, কেমব্রিজ ঘুরে প্রায় মাস ছয়েক পরে আবার বিলেতে ফিরলেন। এরই মাঝে ইংল্যান্ডের ইন্ডিয়া সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয়েছে গীতাঞ্জলির ইংরজি অনুবাদ। অসাধারণ ভূমিকা লিখেছেন কবি ইয়েট্স। ইংল্যান্ডে ফিরে রবীন্দ্রনাথ দেখলেন বিভিন্ন কাগজে গীতাঞ্জলির সপ্রশংস আলোচনা। সেবার প্রায় এক বছর চার মাস ইংল্যান্ড-আমেরিকা ঘুরে দেশে ফিরলেন রবীন্দ্রনাথ। এর মধ্যে দেশের রাজনীতিতে নানান পরিবর্তন ঘটেছে। এসব পরিবর্তন কবির মনেও প্রভাব ফেলছে। মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কবি গিয়ে উঠলেন শান্তি নিকেতনে। পুজোর ছুটির পর স্কুল খুলেছে, এখানেই কবির স্বস্তি। দূরে বসেও সারাক্ষণ এই স্কুলের কথা ভেবেছেন। এখন সময় কাটছে স্কুল নিয়েই। এরই মাঝে ১৯১৩ সালের ১৫ নভেম্বর টেলিগ্রাম পেয়ে কবি জানলেন যে এ বছর সাহিত্যে নোবেল প্রাইজের জন্যে দু’দিন আগে তাঁরই নাম ঘোষিত হয়েছে। এবং সেটা ওই গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের সূত্রেই ঘটেছে। ভেবে দেখ তো, কত বড় সম্মান! গোটা এশিয়া মহাদেশে তখন এই এক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া আর কেউ আজ পর্যন্ত সাহিত্যের নোবেল পাননি। বাঙালি কবির নোবেলপ্রাপ্তি বাঙালিজাতি এবং বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদাপূর্ণ আসনে বসিয়েছে। নোবেল পুরস্কারের সম্মান যেমন সুউচ্চ, অর্থমূল্যও কম নয়। শ’ খানেক বছর আগেই এই পরিমাণ ছিল প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা। রবীন্দ্রনাথ এই টাকা খরচ করেন শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় এবং অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কাজে। মানবকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ আলফ্রেড বার্নাড নোবেলের প্রবর্তিত পুরস্কার এভাবেই বাঙালির মহত্তম কবি রবীন্দ্রনাথের হাতে এসে সার্থক হয়।
০১৭১১৫৭৯২৬৭


0 comments:

Post a Comment