Friday, April 29, 2016

নারী শ্রমিক ঃ মজুরি বৈষম্যের শিকার

নারী শ্রমিক ঃ মজুরি বৈষম্যের শিকার 
আলী ফোরকান 
সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম বয়রা। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে। এক সময় এই এলাকায় ধান হত। কৃষকের ঘরে থাকতো খাবার। ফারাক্কার ছোবলে তছনছ হয়ে গেছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। কপোতাক্ষ ও ইছামতি নদী থেকে সরু খালের মতো ছোট শাখা নদী সাপমারা ও লাবণ্যবতী দিয়ে বয়ে যেত জলধারা। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের পলি এসে ভরাট করে দিল দেবহাটা গ্রামের সাপমারা আর লাবণ্যবতীর পানি প্রবাহ। এদিকে, আর্ন্তজাতিক বাজারে চিংড়ি রফতানির সুযোগ নিয়ে এই এলাকায় শুরু হল চিংড়ির চাষ। কৃষক জমি হারালো। হয়ে গেল বেকার। ঘরে ধান না এলে কিষানীর ও একই হাল। সেও আঙিনা পেরিয়ে হয়ে গেল ঘের শ্রমিক। ভাগ্যের দুর্বিপাকে বয়রা গ্রামের অনেকের মত শেফালী (২০) ও নাসিমা (২৫) এভাবেই হয়ে গেল ঘের শ্রমিক। অষ্টম শ্রেণীর পর খাদেজার আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। হয়ে গেল ঘের শ্রমিক। সকাল ৭টায় ঘর থেকে খেয়ে বের হয়। বেলা ১টা পর্যন্ত বিলে কাজ করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। মাটির চাপড়া কেটে সেটা ছুড়ে দিতে হয় অন্য শ্রমিকের হাতে। সে সেটা লুফে নেয়। এভাবে ঘেরের মাটি কেটে মেয়েরা ঘের বানায়। বর্ষার লবণাক্ত পানিতে দাঁড়িয়ে ঘেরের কাদা ঘেঁটে শ্যাওলা শামুক সাফ করে তারা। খাদেজা ৪ বছর ধরে চিংড়ি ঘেরে কাজ করছে। বলল, পুরুষের সমান কাজ করেও পুরুষের চেয়ে কম পারিশ্রমিক দেয়া হয় আমাদের। কিন্তু তারপরেও সাতদিন, দশদিনেও সেই মজুরি দেয়া হয় না। আধ পেটা খেয়ে থাকতে হয়। স্বামী পরিত্যক্তা এক কন্যা সন্তানের জননী নাসিমারও একই অভিযোগ। ঘেরে মেয়েদের জন্য পায়খানা নেই। পানি খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। প্রস্রাব করতে চাইলে যেতে দেয়া হয় না। পুরুষরা গালাগালি করে। তবে সিডব্লিউসিএস দেবহাটা গিয়ে মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে মটিভেশনাল ও সচেতনতামূলক বৈঠক করার পর পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে বলে খাদেজা ও নাসিমা জানান। তারা বলেন, ৯ মাস আগে আমাদের রোজ দেয়া হতো ১২০/১৩০ টাকা। এখন ১৮০ টাকা করে দিচ্ছে। তবে নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য এখনো বিদ্যমান। দেবহাটার পারুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম মাদ্রাসা পাস করে কলেজ থেকে বিএ পাস করেও কোনো চাকুরি পাননি। ফলে তিনি ৪ লাখ টাকা জোগাড় করে ২৪ বিঘার জমিতে চিংড়ি ঘের স্থাপন করেন। বললেন, চাঁদের শুক্ল পক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষ মিলিয়ে প্রতি মাসের মাত্র ১৫ দিন চিংড়ি ঘেরে শ্রমিকরা কাজ করে। প্রতিদিন গড়ে ২০/২৫ জন নারী শ্রমিকের সঙ্গে প্রায় একই সংখ্যক পুরুষ শ্রমিক কাজ করে। আগে নারীদের ১৬০ টাকা ও পুরুষদের ১৮০ টাকা মজুরি দেয়া হতো। এখন সেটা বাড়িয়ে যথাক্রমে ১৮০ টাকা ও ২০০ টাকা করা হয়েছে। মেয়েরা পুরুষের সমান কাজ করেও সম-পরিমাণ মজুরি পায় না কেন-এই প্রশ্নের উত্তরে ঘের মালিক নুরুল ইসলাম বলেনÑমেয়েরা পুরুষের সমান কাজ করে এটা ঠিক। তা সত্ত্বেও  মেয়েদের নিয়ে বেশ কিছু অসুবিধাও আছে। বিলের মধ্যে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট ও খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করা বেশ কঠিন। তবে যাদের ঘের বড় তাদের জন্য এসব সুবিধা দেয়া অনেক সহজ বলে আমি মনে করি। তার ঘেরে নারী শ্রমিকদের নিয়োগ দেয়ার কারণ সম্পর্কে তার অভিমত হচ্ছে, দারিদ্র্য- পীড়িত এলাকায় নারী-শ্রম অনেক সস্তা বলেই মেয়েদের কাজ দেয়া হয়। সিডব্লিউসিএস-এর প্রেসিডেন্ট জানান, অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশন-এর অর্থায়নে সাতক্ষীরা জেলার সদর, দেবহাটা ও কালিগঞ্জ থানার চিংড়ি ঘেরের মালিক-শ্রমিকদের সমঝোতার মাত্রা বাড়াতে তারা কাজ করছেন। ডিসেম্বর মাসে এই প্রকল্পের প্রথম অধ্যায় শেষ হয়ে যাবে। তবে তাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সাতক্ষীরা জেলার চিংড়ি ঘেরের সমস্যা চিহ্নিত করে একটি ‘হটলাইন’ স্থাপন করা, নারী-শিশু পাচার রোধ করতে, স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধি, এনজিও, স্থানীয় লোকজন এবং ঝুঁকিপূর্ণ নারী-শিশুদের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন স্থাপন করা। এলক্ষে তারা টারগেট গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা ও মতবিনিময় করছেন। তিনি বলেন, চিংড়ি ঘেরের মূল সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য, তেরিতে মজুরি দেয়া, নারী শ্রমিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, যৌনপীড়ন, চিকিৎসা সুবিধা না থাকা, কাজ হারানোর ভীতি, বিশ্রাম দেয়ার অবকাশ না থাকা ইত্যাদি। তিনি বলেন, গত ১ মাসে এই পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আশাকরি আগামীতে নারী শ্রমিকেরা পুরুষের সমপর্যায়ের বেতন ভাতা পাবেন।
০১৭১১৫৭৯২৬৭

0 comments:

Post a Comment