শিশুরা ক্ষুধামুক্ত হয়ে প্রকৃত শিক্ষায় আলোকিত হউক
আলী ফোরকান
শিক্ষার জন্য শিক্ষা উপকরণই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন পেটের ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থা করা। এ ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষা লাভ করা বা শিক্ষার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা দুটোই দুরূহ। দেশের দরিদ্র পরিবারের শিশুরা ক্ষুধা ও অপুষ্টির শিকার। একটি জরিপে দেখা যায়, এখনও দেশের ৯০ লাখ স্কুল বয়সী শিশু প্রাথমিক শিক্ষার বাইরে রয়েছে। প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ৪৮ শতাংশ ছেলেমেয়ে পঞ্চম শ্রেণী শেষ করতে না করতেই ঝরে পড়ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এরকম পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিশু আসে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। এসব শিশুর মধ্যে ৫৫ ভাগ শিশুই অপুষ্টির শিকার। অধিকাংশ পরিবারের সন্তানের বাড়তি পুষ্টি জোগানোর সামর্থ্য নেই। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিশুরা অভুক্ত ও অর্ধভুক্ত অবস্থায় স্কুলে আসে। এসব শিশুরা সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত দীর্ঘসময় স্কুলে থাকতে হয়। এই দীর্ঘ সময়ে না খাওয়ার ফলে তাদের একদিকে ক্লাস করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। অন্যদিকে বেশি সময় ক্ষুধার্ত থাকায় স্বাস্থ্যহানি ঘটছে। ফলে অপুষ্টির শিকার এসব শিশু ক্লাসে ও বাড়িতে পড়াশোনা করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছে। শিক্ষার মান রক্ষা করার প্রশ্ন তাই বাহুল্যমাত্র। এক গবেষণায় জানা গেছে, দরিদ্র পরিবারের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩৩ শতাংশ এবং ৪৩ শতাংশ শিশু পঞ্চম শ্রেণী শেষ করার আগেই ঝরে পড়ছে। শিশুরা পর্যাপ্ত আহার, আয়োডিন ও ভিটামিনের অভাবে পড়ালেখা ও খেলাধুলায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এতে করে সরকারের প্রাথমিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকারভিত্তিক সবার জন্য শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সফল হবে কী করে। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অঞ্চলের দরিদ্র শিশুদের একবেলার পূর্ণ আহার প্রদানের ব্যবস্থা করা দরকার। বিশ্বের বেশ কিছু দেশে এব্যবস্থা করে ফলপ্রসূও হয়েছে। এর আগে আমাদের দেশের স্কুলে বিস্কুট বা গুঁড়োদুধ সরবরাহ করা হয়েছিল। আর এতে কিছু ফলাফলও দেখা গিয়েছিল। বর্তমানে দরিদ্র শিশুদের স্কুলে অবস্থানকালীন সময়েই একবেলার পুষ্টিকর আহার সরবরাহ করা প্রয়োজন। যদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খাদ্য কার্যক্রম চালানো যায় তবে শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটবে। এ ছাড়া স্কুলগামী দরিদ্র শিশুদের পুষ্টি সমাধানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা হবে। প্রাথমিক স্কুলগামী শিশুদের মেধা, যোগ্যতা ও শারীরিক বিকাশ অবশ্যই দরকার। খাদ্য কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ওপরই নির্ভর করবে দরিদ্র শিশুদের শিক্ষা। এতে ঝরে পড়া শিশুর হারও কমে আসবে। জাতীয় শিক্ষাক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নয়নও সাধিত হবে। একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবরের তথ্য মতে, দেশের অধিকাংশ দরিদ্র পরিবারের শিশুরা, “কখনও পানি ভাত বা রুটি খেয়ে, কখনও না খেয়ে স্কুলে যায়। দুই ক্লাসের পরই তারা ক্ষুধার্থ হয়ে পড়ে। তখন শ্রেণীকক্ষে এসব শিশু অমনযোগী হয়ে পড়ে। তাদের শিক্ষকের কথা শুনতে ভালো লাগে না। পাশাপাশি লেখাপড়ায় মন বসে না ও ঘরে ফিরতে ইচ্ছা করে।” দেশের দরিদ্র পরিবারের শিশুদের অবস্থা এমনই।অপর একটি জরিপে জানা যায়, এখনও ৯০ লাখ স্কুল বয়সী শিশু প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে। আর প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ৪৮ শতাংশ ছেলেমেয়ে পঞ্চম শ্রেণী শেষ করতে পারে না। স্কুল টিফিন বা স্কুলে একবেলা খাবারের কার্যক্রম না থাকায় এ অবস্থা বিরাজ করছে। অভিভাবক, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষাবিদদের সাথে আলোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধিকাংশ শিক্ষার্থী আসে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। ওই সব শিশুদের মধ্যে ৫৫ ভাগ শিশু সরাসরি অপুষ্টির শিকার । এছাড়া ৫৬ শতাংশ শিশুর শরীরের ওজন প্রয়োজনের তুলনায় কম। এ পুষ্টিহীনতার কারণ ভিটামিন-এ, আয়রণ এবং আয়োডিনের অভাব। সকাল সাড়ে নয়টা থেকে বিকাল সাড়ে চারটা এই দীর্ঘ সময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের স্কুলে থাকতে হয়। এই দীর্ঘ সময়ে অভুক্ত থাকায় শিশুদের অপুষ্টিসহ স্বাস্থ্যহানি ঘটছে প্রতিনিয়ত। আবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দরিদ্র কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা এসব শিক্ষার্থীরা অভুক্ত বা অর্ধর্ভুক্ত অবস্থায় থাকে। এর ফলে দীর্ঘ সময়ে ক্লাসে আসা তাদের জন্য কষ্টকর। যারা ক্লাসে আসে তারা অপুষ্ঠিতে ভোগে। অপুষ্টির কারণে তাদের শেখার ও মনে রাখার ক্ষমতা দুটোই কমে যায়। এ কারণে শিক্ষার গুণগত মান অর্জনও সম্ভব হচ্ছে না। বেসরকারি এক গবেষণায় দেখা যায়, ক্ষুধা ও অপুষ্টির কারণে সুবিধা বঞ্চিত দরিদ্র পরিবারের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩৩ শতাংশ এবং ৪৩ শতাংশ এবতেদায়ী মাদ্রাসা থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই থেকে ঝরে পড়ে। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার উপযোগী শিশু দরিদ্রতার কারণে স্কুলে যায় না। অধিকাংশ শিশুই মওসুম ভিত্তিক শিশু শ্রম, রোজগারের মাধ্যমে পিতামাতাকে সংসার চালাতে সহায়তা করে। যা তাদের পরবর্তী পেশা হয়ে দাঁড়ায়। তাদের পেশা আর ভাগ্য কোনটিরই পরিবর্তন হয় না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই স্কুলে একবেলা খাবারের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে এ প্রকল্প চলছে। মালয়েশিয়ায় দরিদ্র পরিবারের জন্য স্কুল টিফিন বাবদ ভর্তুকি দেয়া হয়। ব্রাজিলে স্কুল ক্যাম্পাসে শাক-সবজি উৎপাদন করা হয়। যা খাদ্য কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্তমানে বিশ্বখাদ্য কর্মসূচির সহায়তায় বাংলাদেশের ৯টি দারিদ্র্যপ্রবণ জেলায় ৪ হাজার বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিস্কুট প্রদান করছে। ডব্লিউএফপি’র সাহায্যে বর্তমানে শুধু ১ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্কুল টিফিন কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড রিসার্স ইনস্টিটিউট এবং টাফট ইউনিভার্সিটি এইডের পৃথক দুটি গবেষণায় দেখা গেছে, এ খাদ্য গ্রহণের ফলে বিদ্যালয়ে ঝরে পড়ার হার কমে গেছে। বিশ্বখাদ্য কর্মসূচির আওতায় ২০০১ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত সাতক্ষীরা জেলায় যে কার্যক্রম চালানো হয়, তাতে ৭৫ গ্রাম ওজনের বিস্কুট প্রতিটি শিশুকে দেয়া হতো, যা তাদের দৈনিক খাদ্য চাহিদার ৭৫ ভাগ মেটাতো। এর ফলে স্কুলগুলোতে ভর্তির হার বেড়েছে ৮ দশমিক ৯ ভাগ। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির-২ এর হিসাব অনুযায়ী ২০০০ সালে শিশু শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার ৩৫ ভাগ থেকে কমে ৩০ ভাগে নেমেছে। পিপিআরসির এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, যেহেতু ওইসব স্থানে পুষ্টি যোগান দেয়া হয়েছে তাই ছাত্র-ছাত্রীরা বেশি মনোযোগী ছিল। শিশুরা ভিটামিন এ এবং আয়োডিনের অভাবে যেসব রোগে ভুগত তা দূর হয়েছে। পড়াশুনা ও খেলাধুলায় আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সাময়িক স্কুল ত্যাগের প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে এবং দরিদ্র পরিবারের ওপর থেকে আর্থিক চাপ কমছে। ২০০০ সালে ওই স্কুলগুলোর বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের হার ছিল ৩৮ দশমিক ২ ভাগ। ২০০৪ সালে এটি উন্নীত হয়েছে ৬০ দশমিক ৯৭ ভাগে। সরকার অনুমোদিত দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্রে (পিআরএসপি) স্কুল কার্যক্রমের একটি সম্ভাব্য হিসাব দিয়ে বলা হয়েছে, যদি প্রাথমিক শিক্ষায় খাদ্য কার্যক্রম ভালভাবে চালানো যায় তাহলে শিক্ষার মান উন্নয়ন তো বটেই, একই সঙ্গে তা পুষ্টি সমাধানে গুরুত্বপূর্র্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিভিন্ন শিক্ষাবিদরা বলেন, স্কুল টিফিন অনিবার্যভাবে দরকার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্কুল টিফিন ব্যবস্থা চালু আছে। শিশুরা সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত স্কুলে থাকে। এই দীর্ঘ সময়ে তাদের জন্য খাবার দরকার। শিক্ষা বিশেষজ্ঞদেও মতে, দেশের দরিদ্র পরিবারের শিশুরা এমনিতেই ঠিকমত খাবার পায় না। কেউ কেউ দিনে একবার খাবার খেতে পারে। তাদের জন্য স্কুলে খাবার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ওই খাবারটুকুর জন্য তারা হয়তো স্কুলে আসতে আগ্রহী হবে। স্কুল টিফিন কার্যক্রমের ফলে শিশুর শারীরিক বিকাশ এবং মেধা ও যোগ্যতা বাড়বে। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পের যুগ্ম পরিচালক চৌধুরী মুফাদ আহমদ বলেন, প্রাইমারি স্কুলে টিফিন কার্যক্রম চালু করা জরুরি। এ খাতে প্রাথমিকভাবে আর্থিক খরচ বেশি হলেও তা দেশের ভবিষ্যতের জন্য বড় ধরনের বিনিয়োগ হবে। তাই শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ প্রাথমিক শিক্ষার মান্নোয়নে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। কারণ শিক্ষাসহ দেশের যে কোনো অগ্রগতি ও উন্নয়ন ঘটাতে সবার আগে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষাকে নিশ্চিত করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়নে দেশের শিক্ষাবিদসহ সকলকে পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতি গঠনে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। জাতিকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে না পারলে কোন উন্নয়ন কার্যক্রমই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এমন কি জাতিকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর কথা ভাবাই যায় না। আমরা আশাকরি মাদ্রাসাসহ দেশের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে উঠুক। শিশুরা ক্ষুধামুক্ত হয়ে প্রকৃত শিক্ষার আলোয় আলোকিত হউকÑ ইহাই সকলের কাম্য।
লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ
মোবাইল:০১৭১১৫৭৯২৬৭
0 comments:
Post a Comment