Friday, April 29, 2016

অধিকারবঞ্চিত নারী শ্রমিক




অধিকারবঞ্চিত নারী শ্রমিক
 আলী ফোরকান
কুলসুম নারী শ্রমিক। দিনমজুরের কাজ করেন। রাজধানীর পোস্তগোলা সেতুর পাশে পাড় গেন্ডারিয়া এলাকায় । নদীপথে আসা কার্গো থেকে বালি বহন করেন তিনি। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। বিনিময়ে পান ২২০ টাকা। অথচ একই কাজ করে একজন পুরুষ শ্রমিক পান ৩২০ টাকা। ঘাটে বসে থাকা মহাজন আবার আছিয়ার কাছ থেকে ১৫ টাকা কেটে নেন। কুলসুম জানান, তার মতো সব নারী শ্রমিক মজুরির ক্ষেত্রে এমন বৈষম্যের শিকার। তবে শুধু বালি বহন নয়, অন্য কাজেও রয়েছে নারী-পুরুষ মজুরি বৈষম্য। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ইট ভাঙার কাজ করেন নাছিমন আক্তার। দিনভর কাজ করে তিনি পান২২০টাকা। অথচ একই কাজ করে তার পুরুষ সহকর্মীরা পান ৩৫০ টাকা।
কুলসুম ও নাছিমন মতো বৈষম্যের শিকার আমাদের দেশের হাজার হাজার নারী শ্রমিক। তারা শ্রম দিয়ে তাদের ন্যায্য পাওনা পান না। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ (২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনে সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করবেন।’
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বাংলাদেশ এপারেল সেক্টর ইন পোস্ট ফাইবার এরেঞ্জমেন্ট শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায়, একজন পুরুষ শ্রমিক গড়ে মাসে ৪ হাজার ৬৫৮ টাকা আয় করেন। আর একজন নারী শ্রমিকের মাসে গড় আয় ৩ হাজার ৫৩৫ টাকা। আর মাত্র ৩ দশমিক ৭ শতাংশ নারী মাসে ৫ হাজার টাকার ওপরে আয় করেন। পুরুষের ক্ষেত্রে এই হার ২৫ শতাংশ। বেসরকারি সংস্থা ‘কর্মজীবী নারী’ ২০০৯ সালের মার্চে টঙ্গী, ঢাকা, সাভার ও নারায়ণগঞ্জের ৪৪০টি পোশাক কারখানায় একটি জরিপ চালায়। ওই জরিপে দেখা যায়, ৪১ শতাংশ নারী শ্রমিক একই কাজ করে পুরুষদের তুলনায় মজুরি পান কম। আর ৬০ শতাংশ কারখানার পদোন্নতির সময় নারীরা বৈষম্যের শিকার হন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘বর্তমানে পোশাক শিল্পে কর্মরত প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী। অথচ নারী শ্রমিকদের পদোন্নতি দিতে চায় না কর্তৃপক্ষ। উচ্চপদে তাদের নিয়োগও দিতে চান না তারা। মেয়েরা ছেলেদের মতো দক্ষ নয় এবং সবকিছু ওইভাবে সামাল দিতে পারে না বলে অজুহাত দেখিয়ে তাদেরকে পদোন্নতিবঞ্চিত করা হয়।’
তবে দেশের নারী শ্রমিকদের অন্য বঞ্চনাও রয়েছে। যেমন, সোনিয়া খাতুনের বয়স ১৫। চার বোন দুই ভাই তারা। বাবা রিকশা চালান। তার স্বল্প আয়ে সংসার চলে না। তাই বাধ্য হয়ে সোনিয়াকে কাজ করতে হয় পোশাক কারখানায়। এক বছর ধরে তিনি কাজ করছেন আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায়; কিন্তু এখনো নিয়োগপত্র পাননি। সাভারে একটি জুতা কারখানায় চার বছর ধরে কাজ করেন হালিমা। তাকেও এখন পর্যন্ত নিয়োগপত্র দেয়া হয়নি। শ্রমিক নেত্রীরা বলেন, ‘এটি অন্যায়। শ্রমিকদের অবশ্যই নিয়োগপত্র দেয়া উচিত। সে নারী বা পুরুষ সেটা বড় কথা নয়।’ তাছাড়া শ্রম আইন-২০০৬ এ স্পষ্ট বলা আছে, ‘মালিক প্রত্যেক শ্রমিককে নিয়োগপত্র দিতে বাধ্য থাকবে। পাশাপাশি মালিক নিজ খরচে শ্রমিককে ছবিসহ পরিচয়পত্র দিবেন।’ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী বিপ্লব সাহা বলেন, ‘শ্রম আইন অনুযায়ী কোন মালিক নিয়োগপত্র না দিলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যাবে। এ ক্ষেত্রে ৩ মাস কারাদন্ড বা ১ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় সাজা হতে পারে।’ ২০০৯ সালে ‘কর্মজীবী নারী’র এক সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশের মাত্র ২৫ শতাংশ কারখানায় নিয়োগপত্র দেয়া হয়।
শ্রমআইন অনুযায়ী প্রত্যেক শ্রমিকের শিক্ষানবিস কাল ৩ মাস। তবে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে মূল্যায়নের জন্য এই সময় সর্বোচ্চ ৬ মাস হতে পারে। শিক্ষানবিসকালের পর একজন শ্রমিক স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে বিবেচিত হবেন। কিন্তু আমাদের দেশে শ্রমিকরা এই অধিকার থেকে বঞ্চিত। নারীদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও বেশি। যেমন রাজধানীর অদূরে সাভারে একটি স্ক্রিন প্রিন্টের কারখানায় দুই বছর ধরে কাজ করেন চুমকি। তাকে মাস শেষে দেয়া হয় ২ হাজার ২০০ টাকা। কোন নিয়োগপত্র দেয়া হয়নি। তিনি জানান, যখন কাজের চাপ বেশি থাকে তখন তাকে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। নইলে মালিক পক্ষের বকাঝকা শুনতে হয়। অতিরিক্ত কাজের জন্য বাড়তি কোন টাকা দেয়া হয় না। আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে একটি তৈরি পোশাক কারখানায় এক বছর ধরে কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর হিসেবে কাজ করছেন শিল্পী। প্রতিদিন তাকে কাজ করতে হয় সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। অনেক সময় গভীর রাত পর্যন্ত কারখানায় থাকতে হয়। সাপ্তাহিক ছুটিও নেই তার। আইনজীবী বিপ্লব সাহা বলেন, ‘সাপ্তাহিক ছুটি ভোগ করা একজন শ্রমিকের অধিকার। তাই ছুটির দিনে কাউকে কাজ করতে বাধ্য করা ঠিক নয়। আর বাধ্য করা হলে সেটি আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ হবে।’
তাছাড়া স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে আমাদের দেশের নারী শ্রমিকরা। বিশেষ করে যেসব কারখানায় রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার হয় সেখানে ঝুঁকি বেশি। পুরান ঢাকার ‘মডার্ন স্টিকার হাউজে’ কাজ করেন প্রায় ৫০ জন শ্রমিক। তাদের বেশির ভাগই নারী। সম্প্রতি কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, স্টিকার তৈরির জন্য সেখানে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়। অথচ শ্রমিকরা সবাই কাজ করেন খালি হাতে। তাদের কারও হাতে মোজা নেই। সেখানে নারী শ্রমিকদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থাও নেই। গার্মেন্ট শ্রমিক নেত্রী জাহানারা বেগম বলেন, ‘শ্রমআইন অনুযায়ী মালিক কারখানায় স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখতে বাধ্য। কারখানায় পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকবে। পুরুষ ও নারী শ্রমিকদের জন্য আলাদা গোসলখানা এবং টয়লেট থাকবে। যেসব প্রতিষ্ঠানে ২৫ জনের বেশি নারী শ্রমিক থাকবে সেখানে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য পৃথক বিশ্রাম করার ব্যবস্থা এবং যেসব প্রতিষ্ঠানে ২৫ জনের কম নারী শ্রমিক থাকবে সেখানে বিশ্রাম করে মহিলাদের জন্য পর্দাঘেরা জায়গা রাখার কথা আইনে বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। দেশের অধিকাংশ কারখানায় এসব নির্দেশনা মানা হয় না।
সিপিডির গবেষণা অনুযায়ী, কারখানায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে ২১ দশমিক ৮ শতাংশ নারী শ্রমিক একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঢাকার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক আশরাফ হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে কাজ করার ফলে নারী শ্রমিকদের পায়ের শিরা ফুলে যায়। আর মোটা মহিলাদের হাড়ে ক্ষয় দেখা দেয়। যেসব নারী রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে কাজ করে তাদের চর্মরোগ ও ফুসফুসে সমস্যা দেখা দেয়। যেসব শ্রমিক চামড়া কারখানা বা পোল্ট্রি খাবার তৈরি কারখানায় কাজ করেন তাদের ত্বকে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা দেখা দেয়ার আশঙ্কা থাকে। এমনকি তাদের ক্যান্সারও হতে পারে।’ আশরাফ হোসেন বলেন, ‘যেসব নারী শ্রমিক অপুষ্টিতে ভোগেন তারা সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে পারেন না। আর অপুষ্টির কারণে তাদের রক্তশূন্যতা, পেটে ব্যথা বা ফুসফুসে সমস্যা দেখা দিতে পারে।’ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক বলেন, ‘শ্রমিকদের খাবারের ব্যবস্থা করা মালিকপক্ষের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। কারখানাগুলোতে দেখা যায় পুরুষদের তুলনায় নারী শ্রমিকরা বেশিরভাগই সময়মতো ও পরিমাণমতো খাবার খান না। যদি মালিক পক্ষ খাবারের ব্যবস্থা করে তাহলে শ্রমিকদের অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি কমবে।’
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা- অনুযায়ী দেশে ১৫ বছরের ঊর্ধে মোট কর্মক্ষম শ্রমশক্তির ১১ দশমিক ৩ মিলিয়ন নারী। আর মোট নারী শ্রমশক্তির ৬৮ দশমিক ১ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত। অথচ কৃষি শ্রমিকদের কোন স্বীকৃতি নেই। ১৯৮৪ সালে কৃষি শ্রমিকদের জন্য কৃষি শ্রমিক অধ্যাদেশ তৈরি করা হয়। তাতে এই খাতের শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরির হার দৈনিক ৩ দশমিক ২৭ কিলোগ্রাম চাল অথবা স্থানীয় বাজারে ওই পরিমাণ চালের সমপরিমাণ অর্থ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এ অধ্যাদেশের কোন বাস্তবায়ন নেই। ‘কর্মজীবী নারী’র সভাপতি বলেন, ‘জাতীয় কৃষিনীতিতে কৃষির উন্নয়নে অনেক বিষয় অর্ন্তভুক্ত হলেও মজুরির বিষয় উল্লেখ নেই। তাই শুধু দিকনির্দেশনা যথেষ্ট নয়, তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। আর প্রয়োজন কৃষক ও গৃহস্থের স্বার্থ রক্ষাকারী শ্রম আইন।’
কৃষি শ্রমিকদের মতো স্বীকৃতি নেই দেশের গৃহ শ্রমিকদের কাজের। শহরাঞ্চলে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই গৃহ শ্রমিক থাকে। তাদের বেশিরভাগ ভোর থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করেন। সব ধরনের কাজই তাদের দিয়ে করানো হয়। অথচ তাদের জন্য মজুরি নির্ধারণ নেই। নারী নেত্রী বলেন, ‘দৈনিক ১২ ঘণ্টা পরিশ্রম, কম মজুরি ও অমানুষিক নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৮৫৭ সালে নিউইয়র্কে সুঁচ কারখানার নারী শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে নারী দিবসের সূচনা করে। 
০১৭১১৫৭৯২৬৭

0 comments:

Post a Comment