প্রসঙ্গ: অপ্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
আলী ফোরকান
দেশে সরকারি সুবিধাপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে সরকারি ভাষায় বলা হয় এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতনের মূল অংশটি পেয়ে থাকেন সরকারের কাছ থেকে। বিগত এক দশকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছে প্রধানত রাজনৈতিক বিবেচনায়। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ইচ্ছা অনুযায়ী খোলা হয়েছে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান। প্রভাব খাটিয়ে অনেকেই নিজের নামে অথবা পিতা-মাতার নামে এসব প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ ক্ষেত্রে স্থান নির্বাচনের বেলায় বাস্তব প্রয়োজনের চেয়ে ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছাই প্রাধান্য পেয়েছে। যে কারণে বিগত এক দশকে এমন বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অস্বাভাবিক কম। অথচ অনেক জায়গায় প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় শিক্ষার্থীরা ভোগান্তির কবলে পড়ছে। শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ছে অনেক জনপদ। একটি অনুসন্ধানি রিপোর্টে দেখা যায়, অপরিকল্পিত-ভাবে গড়ে উঠা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ হাজার। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই বলা যায় অপ্রয়োজনীয়। শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলও অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। তারপরও এমপিওভুক্ত হওয়ার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের পেছনে প্রতিমাসে সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। অথচ প্রয়োজনীয় জায়গায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকার কারণে বহু শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে যাচ্ছে। অনুসন্ধানি রিপোর্টের তথ্যমতে, রাজশাহীর ১টি উপজেলায় ২১টি কলেজ রয়েছে। যশোরের ১টি ইউনিয়নে ২টি গার্লস কলেজ রয়েছে। অথচ বান্দরবান জেলার চারটি উপজেলায় ৮টি নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন থাকলেও সেখানে স্থাপিত হয়নি। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এ ধরনের অপরিকল্পিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কারণে সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অনুমতি পেতে হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনসংখ্যা ন্যূনতম ৮ হাজার হতে হবে। এছাড়া পৌর ও শিল্প এলাকায় নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ক্ষেত্রে সন্নিহিত ১ কিলোমিটার এলাকায় কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকার শর্ত রয়েছে। মফস্বল এলাকার জন্য এ শর্ত তিন কিলোমিটার পর্যন্ত। একইভাবে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে জনসংখ্যা হতে হবে ন্যূনতম ১০ হাজার। মহাবিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে জনসংখ্যা ১০ হাজার এবং এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানের দূরত্ব হবে ১০ কিলোমিটার। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের বেলায় এসব নিয়মের কোন অংশই মানা হয়নি। ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছায় ও রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি প্রদান ও এমপিওভুক্ত করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫ হাজার ৫৯০টি অপ্রয়োজনীয় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় স্থানে ৩ হাজার ৭০৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়নি। সরকারের বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী এসব স্থানে অনেক আগেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়া দরকার ছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, অপ্রয়োজনীয় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে বান্দরবানে ৩টি স্কুল, চট্টগ্রামে ২০টি স্কুল, ৯টি মাদ্রাসা ও ১৩টি কলেজ, কক্সবাজারে ১৩টি স্কুল ও ২টি মাদ্রাসা, রাঙামাটিতে ৫টি স্কুল ও ১টি কলেজ, খাগড়াছড়িতে ৫টি স্কুল, বি-বাড়িয়ায় ১২টি স্কুল, ৩টি মাদ্রাসা ও ৭টি কলেজ, চাঁদপুরে ১১টি স্কুল, ৪৬ টি মাদ্রাসা, ৯টি কলেজসহ ৬৬টি অতিরিক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। একইভাবে কুমিল্লায় বিভিন্ন ধরনের ১৮৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ফেনীতে ৩৯টি, লক্ষ্মীপুরে ১২৮টি, নোয়াখালীতে ১৩টি, ঢাকায় ২২টি, গাজীপুরে ১২৯টি, মানিকগঞ্জে ১১টি, মুন্সীগঞ্জে ৯টি, নরসিংদীতে ৪৩টি, ফরিদপুরে ১৩টি, রাজবাড়ীতে ৩০টি, মাদারীপুরে ৩৪টি, গোপালগঞ্জে ২৫টি, জামালপুরে ৫০ টি,শেরপুরে ১৫টি, কিশোরগঞ্জে ৪২টি, ময়মনসিংহে ২০৩টি, টাঙ্গাইলে ২৭৩টি, নেত্রকোনায় ২০টি, খুলনায় ১১৯টি, সাতক্ষীরায় ১০১টি, বাগেরহাটে ১৭৩টি, কুষ্টিয়ায় ৭টি, মেহেরপুরে ২টি, যশোরে ৩২৯টি, নড়াইলে ৩৬টি, ঝিনাইদহে ৪২টি, মাগুরায় ৬৩টি, বরিশালে ১৩৪টি, পটুয়াখালীতে ২৮৯টি, বরগুনায় ১৩৮টি, পিরোজপুরে ২৫৫টি, ঝালকাঠিতে ১৯৪টি, ভোলায় ৯৯টি, পঞ্চগড়ে ১১৭টি, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৮৪টি, দিনাজপুরে ৩৬৬টি, নীলফামারীতে ৮৪টি, রংপুরে ২১৯টি, গাইবান্ধায় ১৭৮টি,লালমনিরহাটে ৩৮টি, কুড়িগ্রামে ১৬৪টি, বগুড়ায় ১৫৩টি, জয়পুরহাটে ৮০টি, নওগাঁয় ১৯২টি, রাজশাহীতে ৩০১টি, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১০৮টি, নাটোরে ১১৭টি, সিরাজগঞ্জে ১০১টি, পাবনায় ৫০টি এবং সিলেটে ১৭টি অপ্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। শিক্ষা প্রশাসনের এতথ্য অনুযায়ী দেশে সর্বোচ্চ ৩৬৬টি অপ্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে দিনাজপুরে। সংখ্যার দিক দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে যশোর জেলা। এ জেলায় অপ্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩২৯টি। অন্যদিকে সরকারের বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী বান্দরবান জেলার বিভিন্ন স্থানে আরো ২৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্যতা রয়েছে। একইভাবে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় আরো ১৩৯টি স্কুল, ১২৯টি মাদ্রাসা ও ১৮টি কলেজের প্রাপ্যতা রয়েছে। এছাড়া সামগ্রিক জনসংখ্যার অনুপাতে দেশের ১৯৭টি উপজেলায় ১ হাজার ৬৯৮টি স্কুল, ২৮৩টি উপজেলায় ১ হাজার ৬৯১টি মাদ্রাসা এবং ১৮২টি উপজেলায় ৩১৯টি কলেজের প্রয়োজন রয়েছে। সবমিলিয়ে আরো ৩ হাজার ৭০৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্যতা থাকলেও এগুলো প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে এসব এলাকার শিক্ষার্থীরা নিকটবর্তী স্থানে পড়াশোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, দেশে বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সবমিলিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩১ হাজার ২৫৯টি। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৯ হাজার ৭৭৮টি। রাজশাহী বিভাগে সর্বোচচ ১০ হাজার ৪৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যা দেশের মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক-তৃতীয়াংশ।
অপরদিকে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের বিরোধে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। খোদ রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানার বালুঘাটের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচয় নির্ণয়ে রীতিমতো ব্যর্থ হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এটি কলেজ নাকি স্কুল, তা নির্ণয়ে রশি টানাটানি চলছে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে। তারপরও কোনো কূলকিনারা হয়নি। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের একাংশের দাবি, এটি বালুঘাট উচ্চ বিদ্যালয়। অপর অংশের বক্তব্য, এটি বালুঘাট স্কুল এ্যান্ড কলেজ। এমন বিবাদের মধ্যেই সম্প্রতি কলেজের স্বীকৃতি বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু অধ্যক্ষের পদ ছাড়ছেন না লিয়াকত আলী। তিনি নিজের মর্জিমাফিক একটি পরিচালনা কমিটি গঠন করে এখনো কলেজের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই সঙ্গে বহিষ্কার করে দিয়েছেন বালুঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বোরহান উদ্দিনকে। এ নিয়ে চলছে মামলা - পাল্টা মামলা। এ কারনে এক ধরনের অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে এক সময়ের সুনামধারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে। একইভাবে রাজধানীর নামকরা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজসহ দেশের ৯৫ ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের দ্বন্দ্ব-বিরোধ চলছে। নানা দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও ব্যবস্থাপনা কমিটির বিরুদ্ধে। কোথাও বিরোধ চলছে শিক্ষকদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠান প্রধানের। আবার কোথাও শিক্ষক বনাম ব্যবস্থাপনা কমিটি, আবার কোথাও বিরোধ চলছে সরকারের সঙ্গে। এসব বিরোধের কারনে দায়ের হয়েছে অসংখ্য মামলা-মোকদ্দমা। মামলা-পাল্টা মামলার কারণে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। কোথাও কোথাও সৃষ্টি হয়েছে চরম অচলাবস্থা। অনুসন্ধানি রিপোর্টের তথ্যমতে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানাবিধ দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র পেয়েছে। ডিআইএ’র রিপোর্ট অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্র্রহণ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ঠুকে দেন শিক্ষকরা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৬ হাজারেরও বেশি মামলা করেছেন দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। ডিআইএ’র রিপোর্টে অভিযুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যকই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শাস্তি মেনে নিয়েছেন। শিক্ষা পরিসংখ্যান বিষয়ক সরকারি দপ্তর ব্যানবেইসের তথ্য অনুযায়ী দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ৩১ হাজার ২৫৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৯ হাজার ৭৭৮টি। এ হিসাবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ৯৫ ভাগের বেশিই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১ কোটি ৩২ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১ কোটি ২৫ লাখ শিক্ষার্থী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করছে । শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাড়ার কারণে শিক্ষক- কর্মচারীদের বেতন-ভাতার সরকারি অংশ ১৯৯১-৯২ সালের ৩৬৮ কোটির স্থলে বর্তমানে প্রায় ৩ হাজার কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এ বিবেচনায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব বেশি হলেও সরকার এসব প্রতিষ্ঠানের তদারকির বিষয়ে কার্যকর কোন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। ফলে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি। সরকারি হিসাবে স্বাধীনতার পর তিন যুগে দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। একইসঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির হার বেড়েছে ৬ গুণ, শিক্ষক- কর্মচারীর সংখ্যা বেড়েছে ৫ গুণ এবং শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় বেড়েছে ১০ গুণ। কিন্তু তুলনামূলকভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানের তেমন কোন উন্নতি হয়নি। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার বিষয়ে পরিচালনা পর্ষদ বা ব্যবস্থাপনা কমিটির সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকায় কোন কোন ক্ষেত্রে সেই ক্ষমতার অপব্যবহার হচ্ছে। কোথাও টাকার বিনিময়ে, আবার কোথাও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে অযোগ্য লোকদের শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগদানের ঘটনাও ঘটেছে। আবার পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের সুপারিশ অনুযায়ী এসব শিক্ষকের এমপিও বাতিল করলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক বা কর্মচারী আদালতে মামলা ঠুকে দিচ্ছেন। সরকারি তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা মিথ্যা তথ্য দিয়ে এবং জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে গত ৬ বছরে সরকারি তহবিল থেকে অতিরিক্ত ১৬০ কোটি টাকারও বেশি তুলে নিয়েছেন । মাধ্যমিক স্তরসহ সামগ্রিক শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল হওয়ার কারণে অধিদপ্তরসহ স্থানীয় অফিসগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এছাড়া ব্যবস্থাপনা কমিটির হাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকায় তারা শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে। নীতিমালার বাইরে গিয়ে অবৈধ উপায়ে নিয়োগ দেয়ার কারণে ইতিমধ্যেই অপ্রয়োজনীয় শিক্ষকের সংখ্যা ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। নিয়ম বহির্ভূত উপায়ে নিয়োগ পাওয়া এসব শিক্ষকের মধ্যে ৫২ শতাংশই স্নাতক পর্যায়ে তৃতীয় শ্রেণীপ্রাপ্ত, ৩৪ শতাংশ দ্বিতীয় শ্রেণীপ্রাপ্ত এবং প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্ত শিক্ষকের সংখ্যা ১ শতাংশেরও নিচে। যোগ্যতাসম্পন্ন ও মেধাবীরা এ পেশায় নিয়োগ পাচ্ছে না বলেই শিক্ষার মান দিন দিন নিম্নমুখী। সরকারি এক জরিপ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯ হাজার ৩৯০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৬০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন ব্যবস্থাপনা কমিটি নেই। ৮০৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে এডহক কমিটি দিয়ে চলছে। ৮ হাজার ৪০৮টি মাদ্রাসার মধ্যে ৯৭টি মাদ্রাসায় কোন কমিটি নেই। ৪৪৮টি মাদ্রাসা এডহক কমিটি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। শিক্ষকদের সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের এবং ম্যানেজিং কমিটির অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কোন্দলের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান বিঘিœত হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, দেশে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্য বর্তমানে যে নীতিমালা রয়েছে তা মানছে না অধিকাংশ কর্তৃপক্ষ। দেশের ৩৭২টি নিম্ন মাধমিক স্কুল, ৯৪৮টি মাধ্যমিক স্কুল, ২৬২টি দাখিল মাদ্রাসা, ৩৩টি আলিম মাদ্রাসা, ৭৯৭টি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ এবং ডিগ্রী পর্যায়ের ১৮১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নীতিমালা অনুসারে ন্যূনতম শিক্ষার্থী নেই। অথচ দেশে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে সাড়ে ৫ হাজার। সাড়ে ৬ হাজার প্রতিষ্ঠানে ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত শিক্ষক রয়েছে। এছাড়া প্রয়োজনীয় শ্রেণীকক্ষ, পাঠাগার, ল্যাবরেটরি, খেলার মাঠ, আবাসিক হল, প্রয়োজনীয় অফিস কক্ষ, ক্যান্টিন সুবিধা, প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণসহ ভৌত অবকাঠামো ও পরিবেশগত মানের সংকট থাকার বিষয়টিও জরিপ রিপোর্টে বলা হয়। দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় সবগুলোতেই শ্রেণীকক্ষের অভাব রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই কাঁচা ও সেমিপাকা। শিক্ষার্থী অনুপাতে শ্রেণীকক্ষ অপ্রতুল। শতকরা ৭ ভাগ থেকে ১০ ভাগ প্রতিষ্ঠানে পানীয় জলের অভাব রয়েছে। ৬ শতাংশ স্কুলে টয়লেট নেই। এছাড়া ৪০ ভাগ স্কুল, ২২ ভাগ কলেজ ও অধিকাংশ মাদ্রাসায় কোন ল্যাবরেটরি নেই। শ্রেণীকক্ষে একজন শিক্ষক যথাসময়ে উপস্থিত হন কিনা, শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের পূর্বে প্রস্তুত হন কিনা, শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করেন কিনা এ বিষয়ে কোন নজরদারির ব্যবস্থা নেই। শিক্ষকরা নিয়মিত এবং যথাসময়ে ক্লাসে হাজির হন কিনা এ নিয়ে প্রতিষ্ঠান প্রধানের কোন বিধি-নিষেধ থাকে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জরিপ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৮০ শতাংশ শিক্ষক পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই ক্লাসে যান, ৮৫ শতাংশ শিক্ষক শিক্ষাদানের সময় প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করেন না। এছাড়া জরিপকালে দেখা গেছে যে, বিপুলসংখ্যক শিক্ষক কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকেন। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয় হউক। আর দেশের প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংযোজিত কারিকুলাম ও সিলেবাসে আরও আধুনিকায়ন করতে হবে। পাশাপাশি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ও শিক্ষার্থীদের সঠিক শিক্ষা দানের যথাপোযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। আধুনিক, বাস্তব ও কর্মমুখি এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান করে আমাদের যুব সমাজকে একটি বিশাল দক্ষ মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এভাবেই বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব। সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতিকে সমান্তরাল ও আলাদাভাবে চলতে না দিয়ে উভয়ক্ষেত্রে সমানভাবে গুরুত্ব আরোপ ও আধুনিকিকরণ করতে হবে। তাহলে অপ্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অযোগ্য শিক্ষক এমনিতেই ঝরে পড়বে। আমরা আশাকরি সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আধুনিকায়নে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।
লেখকঃ গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ,
মোবাইল:০১৭১১৫৭৯২৬৭
0 comments:
Post a Comment