শিক্ষানীতি পদ্ধতি ও অধ্যয়ন-অনুশীলন
আলী ফোরকান
বাংলাদেশ ঔপনিবেশিক শিক্ষা পদ্ধতি থেকে একচুলও অগ্রসর হতে পারেনি। যে ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতি ও পদ্ধতিতে মানুষ সুশিক্ষিত হতে পারে না, সেই পদ্ধতি ও নীতিতেই বাংলাদেশ চলছে এবং আশা করা হচ্ছে, এভাবে শিক্ষিত হয়ে যুবক-যুবতীরা মানুষ হবে। জাতি গঠনে ভ‚মিকা রাখবে। হচ্ছে ঠিক তার উল্টো। এরা জাতির দায় এবং কর্মজীবনে নিতান্তই আপদ। এরা জাতির সম্পদ নয় এবং জাতির প্রতি দায়িত্ব পালনে অক্ষম এবং অনীহাগ্রস্ত। উচ্চশিক্ষিতরা কি জাতির জন্য প্রয়োজনীয় ভ‚মিকা রাখতে পারবে? এমন প্রশ্নের সমাধান খুঁজে না পেয়ে মিয়ানমারের সামরিক সরকার উচ্চশিক্ষা বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের ইসলাম-পছন্দ ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিকরা তো মনে করেন উচ্চশিক্ষা জাতিকে বিভ্রান্ত করছে। তারা অল্পস্বল্প ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে সাধারণ মানুষকে শিক্ষা দিতেই চায় না। এ ধরনের শিক্ষাবৈরী ভাবসাব দেখে বোঝা উচিত আমাদের জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় কী ধরনের শিক্ষা দরকার। ঠিক সেভাবেই শিক্ষা পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিতরা মূলত উদ্বৃত্তভোগী জীবনযাপন করে। তারা সামাজিক শ্রমের প্রত্যক্ষ অংশীদার নয়। এক হিসাবে বলা যায়, তারা মধ্যস্বত্ব ভোগী। এদের কিছুসংখ্যক অবশ্য সৃষ্টিশীল। এরা নিজের ‘সৃষ্টিসুধা পান’ করে বেঁচে থাকে। আর সবাই অপরের শ্রম শোষণ করেই জীবন কাটিয়ে দেয়। এ প্রবণতা ও অবস্থা তৈরি হয় তাদের ‘শিক্ষা’ থেকে। যে ধরনের শিক্ষা কারিকুলামের মধ্য দিয়ে তারা যায়, তাতে তাদের পক্ষে কাজ করে জীবন নির্বাহ সম্ভব নয়। কিন্তু শিক্ষা তা যে প্রকারেরই হোক না কেন, জাতি গঠন প্রক্রিয়ার তা প্রধান শর্ত। শিক্ষার বিকল্প নেই। লেনিন যেমন বলেছিলেন, সোভিয়েত সমাজ নির্মাণে আলো অপরিহার্য। এ আলো বলতে তিনি শিক্ষার আলো এবং বিদ্যুতের আলোর কথা বলেছিলেন। আমাদেরও সেই আলোর কথাই বলতে হবে। শিক্ষার আলো চাই। বিদ্যুতের আলো চাই। বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটানোর জন্য সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা হচ্ছে। আরও অনেক বিকল্প হতে পারে। কিন্তু শিক্ষার আলোর কী হবে? সেখানে অন্ধকার।
বাংলাদেশের মানুষ না খেয়ে মরে। এমন দেশের রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিতে উচ্চশিক্ষা বিলাসিতা। কিন্তু একে বিলাসিতা বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া যাবে না এ কারণে যে, বাংলাদেশকে বিশ্বের যে কোন উন্নত জাতির সঙ্গে মোকাবেলা করে বাঁচতে হবে এবং সেজন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ের শিক্ষারও প্রয়োজন আছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষা সবার জন্য নয়। খুব কমসংখ্যক ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষা পেতে পারে। কিন্তু সমাজের প্রয়োজন মধ্যমেধার ছেলেমেয়েদের কাজের মানুষ হিসেবে তৈরি করা। কাজের মানুষ তৈরি করতে গেলেও উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন হবে। কিন্তু তথাকথিত উচ্চশিক্ষায় মানুষ কাজের মানুষ হয় না। জাতীয় প্রয়োজনের কাজের মানুষ পরিকল্পিতভাবে তৈরি করতে হয়। আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষায় পরিকল্পিতভাবে কাজের মানুষ তৈরির ছাঁচ নেই। প্রধানত ঔপনিবেশিক মডেলের শিক্ষাকেই পলিশ-টলিশ করে বর্তমানকালের উচ্চশিক্ষা চলছে বিধায় সমস্যাটা জাতিকে বহন করতে হচ্ছে। উচ্চশিক্ষিত মানুষ এবং একই সঙ্গে কাজের মানুষ তৈরি করার জন্য সরকারি বিদ্যাপীঠগুলোর কারিকুলাম একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। কিন্তু একদিনে কারিকুলামের খোলনলচে বদলানো যাবে না। এ কারিকুলাম নিত্যপরিবর্তনের মাধ্যমে অত্যাধুনিক করতে হবে। পরিবর্তনটি হবে নিত্য এবং অল্প-স্বল্প। যার ফলে শিক্ষকরা পড়াতে ভয় পাবে না এবং ছাত্রছাত্রীরাও পড়তে ভয় পাবে না।
অল্পস্বল্প পরিবর্তনের কারণে মৌলিক পরিবর্তন আসতে অনেক সময় লাগবে। কিন্তু দেশ ও জাতি অতদিন অপেক্ষা করে থাকতে পারবে না। জাতিকে প্রতিদিনই প্রতিদিনকার মতো বেঁচে থাকতে হয়। তাই কাজ করার মতো ‘বিদ্যাশিক্ষা’ বর্তমান অবস্থার মধ্যেই তৈরি করে নিতে হবে। সেজন্য উচ্চশিক্ষার সঙ্গে বিশেষ ‘অনুশীলন অধ্যয়ন পাঠ’ সংযুক্ত করলেই হবে। খুব বেশিদিনের জন্য নয়। বছর দুয়েক তারা অনুশীলন অধ্যয়ন পাঠ করবে। প্রথমেই অনুশীলন অধ্যয়ন পর্বের প্রয়োজন কেন সেটা আলোচনা দরকার। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখা যায়, তথাকথিত শিক্ষিতরা সমাজ থেকে, মানুষ থেকে, এমনকি আপন সত্ত¡া থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এক ধরনের কৃত্রিম আভিজাত্য তাদের গ্রাস করে। তারা কৃত্রিম আভিজাত্যের তাড়নায় সাধারণ মানুষকে ঘৃণা করতে শেখে, আপন ভাবতে পারে না, ভালবাসতে পারে না। বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিত্ব সামাজিকভাবে দেখতে গেলে বৈরী সত্ত¡া এবং জাতি গঠন প্রক্রিয়ার শর্তশক্তি হয় না। এরা নিজেকে নিয়ে মাতোয়ারা থাকে এবং অসামাজিক ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়। সমাজ ও মানুষকে ঘৃণা করে বিধায় খুব সহজেই ভ্রষ্টাচারী হয়ে যায় এবং দেশবৈরী শক্তির সঙ্গে আঁতাত করে। সমাজের মধ্যমেধার বিশাল কর্মীবাহিনী যদি এভাবে দেশবৈরী হয়ে যায় তাহলে কাজ করবে কারা? অনুশীলন অধ্যয়ন কারিকুলাম প্রতিটি বিভাগ নিজেদের মতো তৈরি করে নেবে। তবে যারা যথেষ্ট মেধাবী তাদের পাঠ্য নিজেদের তৈরি করে নেয়ার সুযোগ দেয়া হবে। তারপরও দেখা যাবে কিছু নিæমেধার ছেলেমেয়ে থাকবে যারা নিজেদের পাঠ নিজেরা তৈরি করতে পারবে না। তারা বিভাগ থেকে ‘সার্বজনীন পাঠ’ সংগ্রহ করবে। এই বিশেষ পাঠের ডিগ্রিধারীদের যদি সরকারি এবং জাতীয় পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হয়, তবে অনেকেই স্বেচ্ছায় এই পাঠে আগ্রহী হবে। উচ্চমেধার ছাত্রছাত্রীদের যেমন স্বাধীনতা দিতে হবে তেমনি মধ্যমেধার ছেলেমেয়েদের জন্য বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে হবে। না হলে এখন যে গড্ডলিকা প্রবাহ চলছে, তাতে কেউই স্বেচ্ছায় এই অতিরিক্ত দু’বছর অনুশীলন পাঠে আগ্রহী হবে না। তাদের জন্য সরকারের খুব বেশি মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। কিন্তু নির্ভরশীলতার কারণে দেশের বোঝা হবে যারা, তাদের সম্পদে রূপান্তরের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। বাংলাদেশে এখন প্রয়োজন জনসম্পদ। বিশাল জনসংখ্যা দেশের দায় হলে সমাজ ওলটপালট হয়ে যেতে পারে। তাই সর্বস্তরের জনসংখ্যাকেই স্তরমত সম্পদ বানাতে হবে। দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষিতদের ভুলভাবে সব সময়ই দেশের সম্পদ মনে করা হয়। নিæস্তরের অল্পশিক্ষিতদের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে কাজের লোক বানানোর সদিচ্ছা সব সময়ই পরিলক্ষিত হলেও উচ্চশিক্ষিতদের ব্যাপারে সবাই নির্বিকার। অথচ এরাও যে সম্পদ না হয়ে দায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেটা বোধকরি কারও বোধেই আসছে না। যারা উচ্চশিক্ষিত মনে করছেন নিজেদের, তাদের বোধেও পরিবর্তন দরকার। শিক্ষিতরা বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার কারণেই স্ববিছিন্ন। তাদের দেশপ্রেমও নেই এই বিচ্ছিন্নতার কারণেই। বাংলাদেশ গ্রাম অধ্যুষিত সমাজ। কিন্তু শিক্ষিতরা গ্রামকে ভয় পায়। এই ভয়ও বিচ্ছিন্নতার কারণে। বাংলাদেশের মানুষ ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সামান্য হলেও পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা অনুভব করে। বিশেষ করে উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনসংখ্যা নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করে। অথচ রাষ্ট্রের দায়িত্ব এদের বিচ্ছিন্নতা দূরীভ‚ত করে মূলধারায় একীভ‚ত করা। যারা ইতিহাস, সংস্কৃতি ও নৃ-বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছেন তারা তাদের অনুশীলন অধ্যয়ন পর্বে এ বিষয়ে অনেক ভালো কাজ করতে পারবেন। সবচেয়ে বড় কাজ হবে, গ্রামের সঙ্গে একাÍতা এবং উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের কারণে ভবিষ্যতে নিজেদের কর্মীতে পরিণত করা। উচ্চশিক্ষিতরা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে সমাজে ওই শূন্যস্থান পূরণ করেছে মৌলবাদ ও প্রতিক্রিয়ার শক্তি, যা জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় বৈরী শর্ত এবং ঐক্য বিনষ্টকারী। সামাজিক ও রাজনৈতিক শূন্যস্থান পূরণের জন্য সমাজের প্রতিস্তরে সচেতন মানুষ দরকার। কোথা থেকে আসবে এরা? বর্তমান রাষ্ট্রপক্ষের কর্তাব্যক্তিরা কি বিষয়টি ভেবে দেখবেন? কিভাবে একটি শিক্ষা নীতিমালা তৈরি করা যায়, যার মাধ্যমে বিশাল কর্মীবাহিনী তৈরি হবে, যারা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে?
0 comments:
Post a Comment