এইডস এখন আর মৃত্যু আতঙ্ক নয়
আলী ফোরকান
এককালে বলা হতো, যার হয় য²া তার নাই রক্ষা। আজ কথাটা উল্টে গেছে। এখন বলা হয়, য²া হলে রক্ষা নাই, এ কথার ভিত্তি নাই।
বিজ্ঞান এখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। দুরারোগ্য বহু ব্যাধির প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছে। চিকিৎসায় বহু কঠিন রোগ ভালো হয়। কিন্তু মানুষ এক সময় একটি ক্ষেত্রে বড় অসহায় ছিল। তা হচ্ছে এইডস।
১৯৮১ সালে হলিউড তারকা রক হাডসনের এ রোগ ধরা পড়ার পর উন্নত বিশ্বের টনক নড়ে। চলতে থাকে গবেষণা। খরচ করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। সেরা গবেষকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আজ পযর্š— অনেক অগ্রসর হয়েছেন। গোটা মানব জাতির সামগ্রিক পরিত্রাণের ক্ষেত্রে সে আবিষ্কার মোটামোটি ভ‚মিকা রাখছে।
স¤প্রতি বাজারে আসছে রোগীদের জন্য নতুন ধরনের এইচআইভি ওষুধ। গত এক দশকের মধ্যে এটিই হবে এইচআইভি/এইডসের প্রথম নতুন মুখে খাওয়ার ওষুধ। ফাইজারের সেলসেন্ট্রি (ম্যারাভাইরক) নামে এ ওষুধটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার কোষের মধ্যে ঢুকতে বাধা দেয়। কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে ১০ বছর চেষ্টার পর এটি তৈরিতে সক্ষম হয়েছে ফাইজার। সেলসেন্ট্রি শরীর থেকে এইচআইভি পুরোপুরি দুর করতে পারবে না। তবে বাজারে পাওয়া অন্য ওষুধে কাজ হয়নি এমন রোগীদের সাহায্য করতে পারে এ ওষুধ। হার্ট (হাইলি এফেকটিভ অকজান্টি-রেট্রোভাইরাল থেরাপি) নামে পরিচিত তিনটি ওষুধের একটি মিশেল এইচআইভি আক্রান্তদের আয়ু উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ালেও এর বিরুদ্ধে লড়াইতে এইচআইভি ভাইরাসের প্রতিরোধ ক্ষমতা চিকিৎসকদের জন্য একটি মাথাব্যথার কারণ। সেলসিন্ট্রি অন্য কিছু অকজান্টি রেট্রোভাইরাল ওষুধের সঙ্গে মিলিয়েই খেতে হয়। আর এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতিতে কাজ করে। এ ওষুধটি সিসিআর ৫ রিসেপ্টল্টর নামে একটি আনুবীক্ষণিক প্রবেশ™^ারকে বন্ধ করে। এইচআইভি ভাইরাস রোগ প্রতিরোধে কাজ করা সিডি ৪টি কোষের ভেতরে ঢুকে তাকে সংক্রমিত করে সিসিআর ৫ সিসেপ্টল্টর নামে প্রবেশ™^ারটি দিয়েই। বাজারে বর্তমানে আর যেসব মুখে খাওয়ার ওষুধ পাওয়া যায় তার সবই কাজ করে কেবল এইচআইভি ভাইরাস রোগ প্রতিরোধী কোষে ঢোকার পরই। গত বছরের আগষ্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদন পায় ম্যারাভাইরক। সেখানে এটি বাজারজাত করা হয়েছে সেলজেন্ট্রি নামে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, কিছু রোগীর শরীরে (শুধু যারা সিসিআর ৫ ট্রপিক এইচআইভি ১ জাতের ভাইরাসে আক্রান্ত) এ ওষুধটি রক্তে এইচআইভি ভাইরাসের সংখ্যা হ্রাস এবং সিডি ৪ কোষের সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। অপরদিকে এন্টিরেট্রো ভাইরাল চিকিৎসা দেখিয়েছে, এইচআইভি/এইডস কোনো মৃত্যুদন্ডাদেশ নয়। এন্টিরেট্রো ভাইরাল ওষুধ সেবনে এইচআইভিকে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে বংশ বৃদ্ধি করতে এবং সক্রিয় হতে বাধা দেয়। ফলে এইচ,আইভি/এইডস একটি দীর্ঘস্থায়ী কিন্তু নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউএন এইডস-এর হিসেবে সমৃদ্ধ দেশগুলোতে যেখানে এ চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে এ চিকিৎসার প্রবর্তন ও ব্যাপক এইডস ব্যবস্থাপনার পর থেকে এইডস সংক্রান্ত মৃত্যু শতকরা ৭০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে।
গত দশকে এন্টিরেট্রো ভাইরাল এইচ,আইভি/এইডস চিকিৎসার ব্যয় অনেক কমে গেছে। ১৯৯০ দশকে বছরে ১০ হাজার ডলার থেকে ৫ হাজার ডলার করে কমতে কমতে আজকে কোন কোন জেনেরিক মিশ্রন ৩শ ডলারে নেমে এসেছে। তবুও এই মূল্যে কোন কোন ক্ষতিগ্রস্ত ও এইচ,আইভি/এইডস এ আক্রান্ত দেশগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ রোগীদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। উদাহরণ হিসেবে মালাবির কথাই বলা হয়েছে, মালাবিতে শতকরা ১৪.২ ভাগ প্রাপ্ত বয়স্ক লোক এইচআইভি সংক্রমিত। অথচ সারা বছরে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোক গড়ে আয় করে ১শ ৭০ ডলার।
একদিকে এই মহামারীর কারণে সৃষ্ট হতাশা অন্যদিকে এন্টিরেট্রো ভাইরাল চিকিৎসার প্রতিশ্র“তির প্রতি সাড়া দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউএন এইডস, ইউনিসেফ ও অন্যান্য সহযোগী সংস্থা গত ২০০৩ সালে একটি নতুন পরিকল্পনা ৫ এর মধ্যে ৩ চালু করে। এ উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল ২০০৫ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল ও উত্তরাশীল দেশসমূহের ৩০ লাখ লোককে এন্টিরেট্রো ভাইরাল চিকিৎসা দেওয়া হয়। এন্টিরেট্রো ভাইরালে চিকিৎসা শারীরিক দুর্বলতাজনিত সংক্রামণের মাত্রা কমিয়ে আনে। যা জনস্বাস্থ্য সুযোগ সুবিধার উপর চাপ লাঘব করে এবং অন্যান্য রোগীর সেবায় অর্থ অবমুক্ত করে। এটি একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্য সেবা অবকাঠামো। এন্টিরেট্রো ভাইরালের সুযোগ সার্বজনীন করার জন্য বাস্তব ভিত্তিক একটি প্রচেষ্টা চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে বলছে, স¤প্রতি ক্যামেরুনে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, প্রতিমাসে মাত্র ২০ ডলার ব্যয়ে জেনেরিক এন্টিরেট্রো ভাইরাল অত্যন্ত সহজতর ও কার্যকর হয়েছে। সমীক্ষায় আরো বলা হয়, উন্নত দেশগুলোর চেয়ে দরিদ্র দেশগুলোতে অব্যাহতভাবে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার হার অনেক বেশি। উদাহরণ হিসেবে ক্যামেরুনের জরীপের কথা বলা হয়। সেখানে আক্রান্তরা শতকরা ৯৯ ভাগ চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলায় কার্যকর ফল হয়েছে।
এন্টিরেট্রো ভাইরাল সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় ব্রাজিলে। সেখানে আক্রান্তদের বয়সের মত আগের চেয়ে পাঁচ বছর বেড়েছে। যা আগে বেঁচে থাকার গড় সময় ছিল ছয় মাসের কম। এন্টিরেট্রো ভাইরাল চিকিৎসা রোগীদের বাঁচিয়ে রাখার চেয়েও অনেক বেশি কিছু করে।
আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় ও মহামারী মোকাবেলায় ২ হাজার কোটি ডলারের বেশি অর্থ সংস্থান করে এইচ,আইভি/এইডস এ আক্রান্তদের প্রতি নজিরবিহীন প্রতিশ্র“তি দেখিয়েছে। গ্লোবাল ফান্ড টু ফাইট এইডস টিউবারকিউলোসিস এন্ড ম্যালেরিয়া বিশ্বব্যাংক, ইউনিসেফ ও ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের মধ্যে অগ্রণী কিছু চুক্তির মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আক্রান্ত হ্রাসকৃত মূল্যে উচ্চমানের ওষুধ সরবরাহ করা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করা সম্ভব করে তুলেছে। তবুও অর্থায়নের অনেক চাহিদা এখনো মেটেনি এবং অগ্রগতিও যথেষ্ট নয়।
সময়ের ঘড়ি টিক টিক করে ২০১০ সাল শেষ করে ২০১২ সালের মাঝামাঝি পার হবে। এ সময়ের মধ্যে যে ৬০ লাখ লোকের চিকিৎসার প্রয়োজন। তাদের মধ্যে মাত্র ৪ লাখ লোকের চিকিৎসা চলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এন্টিরেট্রো ভাইরাল ওষুধ এইচ,আইভি/এইডস এর চূড়ান্ত চিকিৎসা নয়। এ ওষুধ’র প্রতিরোধ ক্ষমতা, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এবং উপযুক্ত বিতরণ পদ্ধতি খুঁজে বের করা এখনো উদ্বেগের বিষয় রয়ে গেছে। কারন এগুলো রয়ে গেছে শিল্পোন্নত বিশ্বে। ফলে বিনা চিকিৎসায় ৫০ লাখের বেশি মানুষ শীঘ্রই মারা যাবে। তবে এইডস বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসার পাশাপাশি সামাজিক নিয়ম মেনে চললে এইচ,অইভি/ এইডস’র মৃত্যু আতঙ্ক থেকে বিশ্ব মুক্তি পেতে পারে।
0 comments:
Post a Comment