অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য চাষ
আলী ফোরকান
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। আমাদের কৃষকেরা কৃষি কাজ বলতে মূলত: খাদ্য শষ্য উৎপাদন কে বুঝে থাকে। খাদ্য শষ্য উৎপাদনে মানূষ সম্প্রতি অধিক মনোযোগি হয়। ফলে দেশ এখন খাদ্য শষ্যে প্রায় স্বয়ং সম্পূর্ণতার দিকে এগোচ্ছে। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় আদিকাল থেকেই দেহের আমিষ জাতীয় খাদ্য যোগানের উৎস্য হিসেবে মাছ
অর্ন্তভুক্ত রয়েছে। পূর্বে মুক্ত জলাশয় থেকে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যেত। যার ফলে কৃষকগণ মাছ চাষের প্রয়োজনীয়তা তেমনভাবে অনুভব করে নাই। বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির ফলে মৎস্যের চাহিদা ও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পক্ষান্তরে প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট কতিপয় কারণে মাছ উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ গুলো হচ্ছে ঃ
ক। পলি পড়ে জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া।
খ। অপরিকল্পিত ভাবে কৃষি কাজে পানি সেচ ব্যাবহার।
গ। অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় কৃষি জমিতে ও মৎস্য ঘেরে রাসায়ণিক সার এবং কীটনাশকের ব্যবহার।
ঘ। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ।
ঙ। অতি মাত্রায় ছোট ও ডিমওয়ালা মাছ আহরণ।
তবে আশার কথা, আমাদের দেশে বিপুল পরিমানে পুকুর-দীঘি ও উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি প্রকল্প রয়েছে। তাতে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে চিংড়ি ও মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষকদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত করা সম্ভব হবে। দেশে বর্তমান ১.৪৭ লাখ হেক্টর আয়তনের ১৩ লাখ চাষ উপযোগী পুকুর-দীঘি রয়েছে। এছাড়া ১.১০ লাখ হেক্টর আয়তনের উপকূলীয় চিংড়ি খামার রয়েছে। কৃষি কাজের চেয়ে মাছ ও চিংড়ি চাষ অধিক লাভজনক বিবেচিত হওয়ায় বর্তমানে কৃষকগণ বিপুল উৎসাহ নিয়ে চিংড়ি ও মাছ চাষে এগিয়ে আসছেন। সঠিক ব্যবস্থাপনায় মৎস্য ও চিংড়ি চাষ সম্ভব হলে এ সকল পুকুর-দীঘি ও চিংড়ি খামার থেকে বছরে প্রায় ৩ লাখ টনের ও বেশি উৎপাদন করা সম্ভব হবে। যা কৃষকদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে।
উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে মৎস্য চাষ সম্প্রসারণের এ বিপুল সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখে ময়মনসিংহে ডানিডার আর্থিক সহায়তায় মৎস্য চাষ সম্প্রাসরণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। চাষীদের ঋণ প্রদান করা হচ্ছে । পাশাপাশি চাষীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উন্নত পদ্ধতিতে মৎস্য চাষ ”লছে। আত্মকর্মসংস্থান ও চাষীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি পরিচালনাধীন রয়েছে। বর্তমানে উক্ত প্রকল্পাধীন পুকুরে মাছ উৎপাদনের পরিমাণ হেক্টর প্রতি গড়ে ৩.৩৮ মেট্রিক টন। কৃষি ক্ষেত্রে শস্যজাত পণ্য উৎপাদনের চেয়ে উন্নত পদ্ধতিতে মৎস্য উৎপাদন যে অধিক লাভজনক তা ময়মনসিংহের এ প্রকল্পের তথ্য থেকে পরিস্কার বুঝা যায়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পূর্বে এবং বাস্তবায়নের পরে উন্নত পদ্ধতিতে মাছ চাষ সম্প্রসারণ কর্মকান্ডে কৃষকদের আয়ের উৎস বৃদ্ধি পেয়েছে।
আধা-নিবিড় চাষের পূর্বে ও আধা-নিবিড় চাষের ফলে কৃষকদের আয়ের উৎস তুলনা করলে দেখা যায় যে, আধা-নিবিড় চাষের পূর্বে যেখানে মাছ চাষ থেকে আয়ের উৎস ছিল ৬%। বর্তমানে সেখানে আধা-নিবিড় চাষের ফলে আয়ের উৎস মৎস্য চাষ থেকে ৩৮% এ উন্নীত হয়েছে। কৃষি খাতে আয়ের উৎস ৭০% থেকে হ্রাস পেয়ে ৪৬% দাড়িয়েছে। বর্তমানে অর্থ উর্পাজনের উৎস হিসেবে জনগণ মাছ চাষ কার্যক্রমে অধিক হারে আগ্রহী হয়ে পারিবারিক আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মাছ চাষ ও কৃষি কাজ থেকে অর্জিত আয়ের তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শুধুমাত্র কৃষি কাজ থেকে যেখানে মোট মুনাফা পাওয়া যায় শতকরা ৫৮.৯৮ ভাগ। সে খানে কেবল মাত্র মাছ চাষ করে লাভ হয় শতকরা ১২৮ ভাগ। আর মাছ ও মুরগীর সমন্বিত চাষ থেকে পাওয়া যায় শতকরা ৯০.৫০ ভাগ। এতে সহজেই বুঝা যায় যে, মাছ চাষ কার্যক্রম কৃষি কাজের চেয়ে অধিক লাভজনক ও কৃষকের আয় বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। সারা দেশের পুকুর-দীঘি ও চিংড়ি খামারে সম্প্রাসরণ মূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে উন্নত পদ্ধতিতে মৎস্য ও চিংড়ি উৎপাদন করা হলে কৃষকদের আর্থ-সামাজিক আশাব্যজ্ঞক অগ্রগতি সাধিত হবে। মাছ চাষ স্বল্প পুঁজি ও স্বল্প শ্রম নির্ভর একটি কর্মকান্ড। যা থেকে অর্জিত আয়ের পরিমান যে কোনো কর্মকান্ডের চেয়ে বেশি। তদুপরি এ খেকে জনগণের পুষ্টিসাধন,শ্রমের যোগান ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন সাধিত হয়। এসব কারণেই কৃষকদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মাছ চাষের গুরুত্ব অপরিসীম।
0 comments:
Post a Comment