কুটিপানা মৎস্য ও পশুর সুসম খাদ্য
আলী ফোরকান
কুটিপানা বা ডাকউইড, এক ধরনের ক্ষুদ্রাকৃতির ভাসমান জলজ উদ্ভিদ। পানির উপরিভাগে এই উদ্ভিদ কচুরীপানার চেয়ে ও দ্রুত বিস্তার লাভ করে। কুটিপানার ব্যবহার সন্বন্ধে বিগত দু’দশক থেকে কিছুটা সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস চলছে। কুটিপানার গুনও ব্যবহারের সম্ভবনা সন্বন্ধে আমাদের অনেকেরই স্পষ্ট ধারনা নেই। কুটিপানা কে অনেকেই (সরৎধপষব পৎড়ঢ়) হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এর অত্যুৎপাদনের উজ্জ্বল সম্ভবনা দেখে গবেষকগন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। খাদ্য হিসেবে কুটিপানা তৃনভোজী মাছ এবং গবাদিপশু হাঁস মুরগীর কাছে প্রিয়।
বাংলাদেশে প্রায় ছয় জাতের কুটিপানা দেখা যায়। এর মধ্যে তিন প্রকার কুটিপানা উল্লেখযোগ্য ও বহুল আলোচিত।
(১) লেমনা (ষবসহধ)
(২) স্পাইরোডেলা (ঝঢ়রৎড়ফবষধ)
(৩) উল্ফিয়া (ডড়ষভভরধ)
বাংলাদেশের খাদ্যদ সংকট একটি জাতীয় গুরুত্বপুর্ন সমস্যা। শুধু মানুষের খাদ্য সংকট নয়, গবাদি পশু ও মাছের খাদ্য সংকটও প্রকট। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিও পশুসম্পদের সংরক্ষন,বৃদ্ধিও উন্নয়নে ও যে কয়টি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তার মধ্যে খাদ্য ও বীজ সংকট, রোগবালাই এর প্রাদুভার্ব, বাজারজাত করনের অসুবিধা এবং ব্যবস্থাপনা দুর্বলতা প্রভুতি উল্লেখযোগ্য। বলা বাহুল্য মাছও পশুখাদ্য সমস্যা সমাধানে সচেতনতা খুব প্রবল নয়। অথচ এই সমস্যা জোড়ালোভাবে মোকাবেলা না করে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। ইদানিং মাছও পশুখাদ্য উৎপাদনে কিছু দেশী বিদেশী উদ্যোক্তা নিয়োজিত থাকলেও তা প্রয়োজনীয় তুলনায় অপ্রতুল। স্থানীয় ভাবে লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মাছ ও পশু খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করে এই সমস্যার সমাধান করা ছাড়া বিকল্প নেই।
পশু খাদ্যর চাহিদা: দেশে পশু খাদ্যের চাহিদা আনুমানিক ১২৯ মিলিয়ন মেট্টিকটন এবং দানাদার খাদ্যের চাহিদা প্রায় ১২ মিলিয়ন মেট্টিকটন। এই চাহিদার মাত্র ৪০ ভাগ দেশে উৎপন্ন হয়। বাকি ৬০ ভাগ অপুরনীয় থেকে যায়। ক্রমবর্ধমান পশুখাদ্য ও মাছের খাদ্য নিরুপনে একটি জরিপ প্রয়োজন।
কুটিপানার খাদ্যমান: কুটিপানা পশু ও মাছের আদর্শ খাদ্য। গুনাগনের দিক দিয়ে এত শল্ক ওজনে আমিষের পরিমান সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ। তবে প্রাকৃতিক আবাসে জন্মানো কুটিপানায় আমিষের পরিমান কখনও কখনও সর্বনিন্ম ৬-৯ শতাংশ হতেপারে। শুধু পরিমানগত দিক দিয়েই নয় ডাকউইডের আমিষের গুনগত মানও উন্নত ধরনের । কুটিপানায় আব্যশীয় অ্যামাইনো এসিডের মধ্যে টিপটোফেন ও লাইসিন ব্যতিরেকে মানুষ পশুপাখির খাদ্য ব্যবহৃত অ্যামিনো এসিড রয়েছে। কুটিপানায় আমিষ,গুনগত মানের দিক থেকে প্রায় ডিমের সমকক্ষ। এ ছাড়া কুটিপানায় কিছু পরিমান ভিটামিন ‘এ’ও ‘বি’ রয়েছে। কুটিপানায় আঁশ কম থাকে যে কারনে মাছের খাদ্য হিসেবে সহজপাচ্য। খাদ্য হিসেবে কুটিপানায় ও সয়াবিন সমতুল্য। কোন কোন বিজ্ঞানী কুটিপানায় সয়াবিনের চেয়ে বেশি আমিষ প্রাপ্তির কথা বলেছেন। তারা আরও বলেছেন,-খৈল’ এর চেয়ে প্রায় দেড়গুন বেশি আমিষ কুটিপানায় রয়েছে। সংশ্লিষ্ট গবেষকদের প্রায় সকলেই স্বীকার করেন যে খাদ্যমান , উৎপাদন ব্যয় সহজলভ্যতা ও ব্যবহারের পদ্ধতি তুলনা করলে কুটিপানায় শ্রেষ্টত্ব প্রমান হয়।
কুটিপানার ব্যবহার: কুটিপানা খাদ্য হিসেবে মাছ ও পশুর জন্য উপযুক্ত। এছাড়া কুটিপানা বর্জ্য পানি / দুুষিত পানি শোধনের জন্য উপযুক্ত। কুটিপানা বিশেষত গার্হস্থ বর্জ্য পানি শোধনে ব্যবহুত হয়ে থাকে। গবেষকদের মতে, কুটিপানা পানির নানা প্রকার ময়লা,ধাতুও বিষাক্ততা শুষে নিতে সক্ষম। কুটিপানা আরও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। কুটিপানা বর্জ্য পানির উপরিভাগ আবৃত করে থাকলেও দুর্গন্ধ নিয়ন্ত্রন করতে সহায়ক। এছাড়া মশার বিস্তার রোধ করতে পারে,এমনকি প্রাকৃতিক নিয়মে খরতাপে পানির বাস্পী ভবনের হারকেও ৩০ শতাংশ হ্রাস করতে পারে। কুটিপানার বহুমুখী ব্যবহার বিজ্ঞানীদের আরও গবেষণা এবং অনুসন্ধানে অনুপ্রানিত করেছে। বলাবাহুল্য গবেষনালদ্ধ জ্ঞান দিয়ে কুটিপানা ব্যবহারে অনুপ্রেরনা জনসাধারনের মধ্যে জাগ্রত করা ডাকউইড গবেষণা প্রকল্পের মুল উদ্দেশ্য। কুটিপানা দ্রুত বৃদ্ধিপায়, প্রায় সব ঋতুতে এবং আবহাওয়ায় এমনকি অযতেœও এর বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। তবে, আলোর তীব্রতা,বায়ুরগতি, প্রখর তাপ, পানির অত্যাধিক লবনাক্ততা কুটিপানার বৃদ্ধি ব্যাহত করে। সুবিধা হল যে, প্রায় সকল প্রকার জৈব বর্জ্য, গবাদি পশুর মল-মূত্র,রান্না ঘরের ব্যবহৃত পানিও বর্জ্য দ্রবাদি, বায়োগ্যাস বর্জ্য ,গোসল খানার পানি,কসাই খানার পানি, খাদ্য শিল্প ও দুগ্ধখামারের বর্জ্য এবং শহরের নানাবিধ বর্জ্যতে পর্যাপ্ত পুষ্টি উপাদান যেমন, নাইট্রোজেন,ফসফরাস পটাসিয়ান ও ক্যালসিয়াম থাকায় কুটিপানা দ্রুত উৎপাদিত হয়। অজৈব সার দিয়েও কুটিপানায় উৎপাদন করা যেতে পারে। তবে জৈব সার দিয়ে কুটিপানা উৎপন্ন করতে কেজি প্রতি ৪০-৪৫ পয়সা ব্যয় হয় এবং অজৈব সার প্রয়োগে খরচ হয় প্রতি কেজি ৭০-৮০ পয়সা। একারনে উৎপাদন ব্যয়ের তারতম্যের ওপর কুটিপানার ব্যাপক প্রচলন নির্বর করছে।
উপসংহার ঃ বাংলাদেশে অভ্যন্তীন জলাশয়ের আয়তন প্রায় ৪৩.৫০ লক্ষ হেক্টর। ১৯৯৬-১৯৯৭ সালে দেশে ১৩.৭৩ লক্ষ মেট্টিক টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১০.৭৯ লক্ষ টন অভ্যন্তরীন মুক্ত জলাশয় থেকে এবং ২.৯৪ লক্ষ মেট্টিক টন বদ্ধ জলাশয় থেকে উৎপন্ন হয়েছে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদিত মাছের পরিমান বেশ কম বলা চলে। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় মাছ সুষম আমিষের উৎস। সুষম আমিষের অভাবে মানবদেহে নানাবিধ সমস্যাসৃষ্টি হয়ে থাকে। বিশেষত শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও মস্তিষ্ক বিকাশে বাধাগ্রস্ত হয় এবং পুষ্টির অভাবজনিত কারনে মৃত্যু ও হতে থাকে। এ কথা বিবেচনা করলে ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে খাদ্য হিসেবে প্রানীজ আমিষ সমৃদ্ধ মাছের ওপর নির্ভরশীলতা ক্রমাগত বেড়েই যাবে। দেশে ২৩৪ লক্ষ গরু,৮.২০ লক্ষ মহিষ, ৩৩৫ ছাগল, ১১.১০ লক্ষ হাঁস রয়েছে। পশুসম্পদের প্রবৃদ্ধির জন্য পশু খাদ্যের ব্যাপক উৎপাদন বৃদ্ধি আশু প্রয়োজন। পশু খাদ্য সংকটের সহজ সমাধান না থাকলেও কুটিপানার ব্যাপক চাষ ও ব্যবহার আংশিক সমাধান দিতে পারে। কুটিপানা মাছ কিংবা পশুর একক খাদ্য হিসেবে প্রভাব সৃষ্টি করতে না পারলেও পরিপুরক খাদ্য হিসেবে ব্যাপক অবদান রাখতে পেরেছে। মাছের খাদ্য ও পশু খাদ্যর যে সংকট বিরাজ মান এবং এই সংকটের ফলে জাতীয় অথনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তা পুরনে কুটিপানা ব্যবহার আংশিকভাবে হলেও সফল এতে কোন সন্দেহ নেই।
0 comments:
Post a Comment