মৎস্যচাষে আরোও উজ্জ্বল সম্ভাবনা
আলী ফোরকান
বাংলাদেশের আয়তন ১,৪৭.৫৭০ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি । ঘনবসতিপূর্ন এ দেশে গড়ে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৮’শ জনের ও বেশী লোক বাস করে। অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে ১৪৭ লক্ষ হেক্টর আয়তনের ১৩ লক্ষ চাষ উপযোগী পুকুর, দীঘি রয়েছে। কৃষকদের জীবন ধারনের জন্য সমন্বিত উন্নত চাষ পদ্ধতি প্রয়োজন। আমাদের খাদ্যশস্য ,শাকসবজি ,ফল মুল, মাছ,মুরগী ইত্যাদি উৎপাদন করে চাহিদা পুরন করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। বিশ্বের দরবারে আমরা মাছে ভাতে বাঙ্গালী । খাদ্য তালিকায় মাছ আমাদের অতি প্রিয় এবং অন্যতম সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাদ্য। সুজলা-সুফলা,শস্য-শ্যামলা নদীমাতৃক এদেশটি স্মরনাতীত কাল থেকেই মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ। কিন্তু বর্তমানে চাহিদার তুলনায় মাছের উৎপাদন প্রায় অর্ধেক। একারনে বাজারে মাছের প্রাপ্তি খুবই কম আর মূল্য বেশি। অথচ এদেশে মৎস্য সম্পদ বাড়ানোর ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে বি¯তৃত জলাশয় ও উপযুক্ত মৎস্য প্রজননের সহনশীল পরিবেশ। একটু মনোযোগী হলেই আমরা উন্নত পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে পুষ্টি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকরে আয় বৃদ্ধি করতে পারি। দেশকে দরিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করে মৎস্য চাষে আমাদের অবহেলিত অনুন্নত পল্লীর আর্থ সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপুর্ন অবদান রাখতে পারি। দেশের ক্রমবর্ধমান পুষ্টির চাহিদা পুরন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জাতীয় অর্থনীতিতে বিভিন্ন জলাশয়ে মাছ চাষ করে সম্ভবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে পরিনত করতে পারি । মাছ চাষে চাষীরা সমপরিমান আবাদী জমি অপেক্ষা অনেক বেশি লাভবান হতেপারে। খাদ্য ছাড়া অর্থকরী ফসল হিসাবে আমাদের গ্রাম বাংলার লোকদের ব্যাপকহারে মৎস্য চাষে এগিয়ে আসতে হবে। বাড়ির আঙ্গিনায় অবস্থিত পুকুরে নারীরা ও মাছচাষে সম্পৃক্ত হতে পারে। এভাবে সবাই মিলে মাছ চাষ করলে যে সুযোগ এবং সম্ভবনা আমাদের রয়েছে। তাতে পুষ্টির অভাব, গ্রামীন দরিদ্রতা দুরকরে সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলা কোন কঠিন কাজ হবে না।
উন্নয়ন কর্মকান্ড: প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত কারনে বাংলাদেশের মৎস্য উৎপাদনের বিস্তর ক্ষেত্র রয়েছে । ক্রমবর্ধমান মৎস্য চাহিদা পুরনের লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তর দেশের বদ্ধজলাশয় ও অভ্যন্তরীন মুক্তজলাশয়সহ বিশাল জলসম্পদের যথাযথ ব্যবহারের নিরলস প্রচেষ্টা করছে। আমাদের পল্লী অঞ্চলে রয়েছে অসংখ্য দীঘি, পুকুর, ডোবা, নালা। যেখানে থেকে আমরা পরিবারের পুষ্টির অভাব পূরণ করেও আর্থিক স্বচ্ছলতার পথ খুঁজে পেতে পারি। এ সকল জলাশয়ের মধ্যে প্রায় ১ লাখ হেক্টর খাস পুকুর-দীঘি, বিল-বাঁওড়, ছড়া, পথিপার্শ্বিক ডোবা-নালা রয়েছে। সেচ প্রকল্প এলাকার বড়োপিট ও সেচনালা ইত্যাদিতে মাছ চাষের সুুযোগ থাকা সত্ত্বেও পতিত অথবা কম ব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে। দেশের জলজসম্পদের সুষ্ঠ্য ব্যবস্থাপনায় দেশে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে পুষ্টি সরবরাহ, কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, বিভিন্ন প্রকার শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। এছাড়া আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ডের ব্যাপারে মৎস্য সম্পদের বর্তমান অবদান ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা যাবে। এসব সম্ভাবনার আলোকে পতিত ও অব্যবহৃত জলাশায় সংস্কার এবং অধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে ব্যাপকভাবে মৎস্যচাষ সম্প্রসারণ করা যাবে। এ লক্ষ্যে বিশ্বখাদ্য কর্মসূচী ও ইইসি বাংলাদেশে দারিদ্র্য দূরীকরণ, উৎপাদন বৃদ্ধির কাজ করছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা প্রদানের জন্য জলাশয়ের উন্নয়নের নিমিেিত্ত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচীর আওতায় খাদ্য সহায়তা প্রদান করে আসছে । এখাদ্য সহায়তার মাধ্যমে প্রতি বছর হাজা-মজা পতিত জলাশয় সংস্কার করা হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারী এনজিও তাদের কার্যক্রমের আওতায় মহিলাদের দল গঠন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র মহিলাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন সাধন করছে।
সামাজিক আন্দোলন: মৎস্য চাষে পল্লীর বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়ন করতে হলে মৎস্য চাষকে একটি সামাজিক আন্দোলন হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের উন্নয়ন বহুলাংশে নির্ভর করে মৎস্য সম্পদের উপর। ইতিমধ্যে দেশের সরকার মৎস্য চাষে জনগনকে উদ্বুদ্ধ করে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহব্বান জানিয়েছেন। মৎস্য চাষকে সামাজিক আন্দোলন হিসাবে গড়ে তোলার প্রয়াসে জনগনকে সচেতনতা বৃদ্ধি ও আগ্রহ সৃষ্টি এবং প্রযুক্তির সম্প্রসারণ প্রয়োজন। প্রতিবছর এই সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াসেই মৎস্য সপ্তাহ বা মৎস্য পক্ষ উদযাপন করা হয়। মৎস্য সম্পদ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিপুল জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান, প্রাণীজ আমিষের চাহিদা পূরণে সহায়তা করে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে মৎস্য খাতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময়।
সমন্বিত মৎস্য চাষ: বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার শতকরা ১০ ভাগ লোকের খন্ডকালীন কর্মসংস্থানের উৎস হচ্ছে মৎস্য । গ্রামীণ জনযোষ্ঠীর শতকরা ৭৩ ভাগ কোন না কোনভাবে মৎস্য চাষ, উৎপাদন, বিষ্পনন ইত্যাদির সাথে জড়িত। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন আশানুরূপ নয়। মাছের উৎপাদন বাড়াতে হলে ক্ষুদ্র চাষীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। গ্রামের জনগন দরিদ্র ও ভূমিহীন বিধায় অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অর্থের অভাবে মাছ ছাষ করতে অক্ষম । আসলে মাছ চাষ এমন একটি কাজ যা অতি সহজে এবং বেশ কম খরচে করা যায়। নিজের বাড়িতে পুকুর না থাকলে অন্য কারো পুকুর ইজারা নেয়া যায়। তাও যদি না হয় তবে রাস্তার পার্শ্বে পতিত ডোবা বা খালে মাছ ছাষ করা যেতে পারে। এবার মাছের খাবারের দিকে যাই। মাছ পানিতে বিদ্যমান। শেওলা ও প্রাণিকনা খেয়ে বড় হয়। এছাড়া পরিমাণমত সার, গোবর প্রয়োগ করে পানিতে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মাতে পারে। এছাড়া খৈল, কুড়া, ভূষি, জবাইকৃত পশুপাখির, নাড়িভূড়ি রক্ত, নানা প্রকার কচুরিপনা ইত্যাদি। এগুলো সংমিশ্রন করে নিজেরাই খাদ্য তৈরী করে মাছকে খাওয়াতে পারি। এছাড়া সমন্বিত চাষ প্রক্রিয়ায় ধানের সাথে মাছ চাষ করে এক খরচেই মাছ উৎপাদন করে বাড়তি আয় করা সম্ভব। ধান চাষকালে একরে ১২’শ রাজপুঁটি, তেলাপিয়া, অথবা মিরর কার্পের উপযুক্ত পোনা ছাড়া যেতে পারে। ক্ষেত্র বিশেষে গলদা চিংড়ি ও দেয়া যায়। ধান আবাদের জন্য ক্ষেতে যে সার ও গোবর ব্যবহার করা হয় তা মাছের ও খাদ্য হিসেবে কাজ করবে। মাছের জন্য কোন বাড়তি খাদ্যের প্রয়োজন হয় না। একই সাথে ধানের ক্ষেতে একরে দেড়’শ থেকে ২’শ কেজি মাছ আমরা ইচ্ছে করলেই উৎপাদন করতে পারি।
একটি সম্ভাবনাময় কর্মসূচী: মৎস্য চাষে পল্লী উন্নয়ন নিঃসন্দেহে একটি সম্ভাবনাময় কর্মসূচী। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান মৎস্য চাহিদা পূরনের লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তর দেশের বিশাল জলরাশি ও মৎস্য সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের চেষ্টা করছে । বদ্ধজলাশয়ে উন্নত পদ্ধতির মৎস্য চাষের জন্য মৎস্য অধিদপ্তর সকল প্রকার কারিগরি জ্ঞান প্রদান করা হচ্ছে । অনাবাদী পুকুরসমূহে আবাদকল্পে যে সকল সমস্যা রয়েছে তা দুর করে মৎস্য চাষের জন্য স্থানীয় মৎস্য বিভাগের কর্মীগণ প্রকল্প প্রস্তুতপূর্বক ব্যাংকে ঋণের সুপারিশ করে থাকে। মৎস্য অধিদপ্তরের আওতাধীন মৎস্যবীজ উৎপাদন খামার হতে উৎপাদিত রেণু পোনা সুলভমূল্যে মৎস্য চাষীদের নিকট সরবরাহ করা হয়। সফল ও উৎসাহী মৎস্য চাষীদের মৎস্য চাষ বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। প্রয়োজনে উচ্চতর প্রশিক্ষনের জন্য বিদেশে প্রেরণ করা হয় । গ্রাম পর্যায়ের বেকার যুবকদের সংগঠিত করে সমবায়ভিত্তিক মৎস্য চাষে সংগঠিত করার কাজ চলছে। দরিদ্র জনগণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে তাদের সংগঠিত করে মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনায় তাদের অবদান নিশ্চিত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন চলছে। এ কার্যক্রমে মৎস্য অধিদপ্তর ছাড়া ও সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান কার্যকর ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। পুকুর মালিকদের মৎস্য সম্পদের উন্নত ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত করার জন্য মৎস্য বিভাগীয় কর্মকান্ডের পাশাপাশি তাদেরকে অর্থ বিনিয়োগ করার সহযোগিতা করছে। নিরক্ষরতা দূরীকরণ,সম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও পরিবেশের প্রভাব ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন করার কাজও চলছে। সরকারী বেসরকারী সংস্থা ও মৎস্য চাষের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের মাধ্যমে পল্লী উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
‘মৎস্য চাষে পল্লীর জনগনের ভাগ্য উন্নয়ন’ এই সম্ভাবনাময় কর্মসূচীর মাধ্যমে গ্রাম বাংলার মহিলারা সাংগঠনিক কাজ কর্মের পাশাপাশি মাছ চাষে বাড়তি আয়ের সংস্থান এবং পরিবারের সদস্যদের পুষ্টির ব্যবস্থা করতে পারে। প্রতিটি উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে মহিলাদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। নারী সমাজের উন্নতির উপর মূলত জাতীয় কল্যাণ ও সমৃদ্ধী বহুলাংশে নির্ভর করে। বিশেষ করে মৎস্য চাষে পল্লী উন্নয়ন কর্মকান্ডে মহিলাদের সঠিক উন্নয়ন এবং অধিকার সংরক্ষণ সরকারের এক বলিষ্ঠ নীতি।
মোট কথা: বাংলাদেশ নিু আয় ও ঘনবিসতিপূর্ণ একটি দরিদ্রতম দেশ। জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৮৫ জন লোক বাস করে গ্রামীন এলাকায়। নিু আয়, ভূমিহীন, বেকারত্ব গ্রামীণ জীবনের নিত্যসহচর। গ্রামের উন্নয়নের উপরই নির্ভর করে সমগ্রদেশের উন্নয়ন। উন্নয়নের সুফল সুষম বন্টনের লক্ষ্যে নিুতম আয়ের দরিদ্র শ্রেণীর জনগণের উপযুক্ত ও তাদের সাধ্যের মধ্যে সহজলভ্য স্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জনে, উপযুক্ত টেকসই ও যথাযথ কর্মসূচী বাস্তবায়নের মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মৎস্য চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। অদূর ভবিষ্যতে মৎস্যচাষে আরোও উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।
0 comments:
Post a Comment