Monday, February 12, 2018

বুড়িদহ এখন মৎস্য অভয়াশ্রম

বুড়িদহ এখন মৎস্য অভয়াশ্রম 
আলী ফোরকান 
পৃথিবীতে সব প্রানীকুলেই একটি আশ্রয়স্থল আছে। মাছ সে প্রাণীকুলেরই শীতল রক্তবিশিষ্ট একটি প্রাণী। যার অবাধ বিচরণ এবং পরবর্তী বংশ বৃদ্ধির জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থলের প্রয়োজন। শাব্দিক অর্থে এই নিরাপদ আশ্রয়স্থলকে অভয়াশ্রম বলা হয়। আমাদের দেশে মুনষ্য ও প্রাকৃতিক সৃষ্ট নানাবিধ কারণে মুক্ত জলাশয়ে বিগত বছরগুলোতে মৎস্য উৎপাদন অনেকাংশ হ্রাস পেয়েছে। বিশেষ করে মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রগুলো ধ্বংস হওয়ার ফলে অনেক প্রজাতির প্রাকৃতিক মাছের বিলুপ্তি ঘটেছে। এ পরিস্থিতিতে মৎস্য সম্পদ রক্ষা করে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কয়েকটি পদক্ষেপের  মধ্যে মৎস্য আভয়াশ্রম একটি বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারও সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রকল্পের মাধ্যমে অভয়াশ্রম স্থাপন করে। সরকারী পর্যায়ে পাহারার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সুফলভোগীদের সচেতনতা ও আগ্রহের অভাবে মৎস্যাভয়াশ্রম মাছের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ছিল না। এ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সরকার পরবর্তীতে সামজভিত্তিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়। এতে সুফল ভোগীদের সক্রিয় মৎস্য ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন প্রকল্পে সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরে। এর মাধ্যমে নিুলিখিত উপায়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। 
(ক) প্রকল্পভূক্ত মুক্ত জলাশয়ে পোনা মজুদ।
(খ) মাছের প্রজনন ক্ষেত্র বা আশ্রয়স্থল সংরক্ষন। 
 জেলা শহর দিনাজপুর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্ব কোণে নবাবগঞ্জ ও বিরামপুর থানায় অবস্থিত একটি উন্মুক্ত মৌসমী বিল, আশুরার বিল। বিলটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার এবং আয়তন প্রকল্প  
প্রস্তাবনা অনুযায়ী ৫,৩০০ একর। এলাকার কথিত প্রবাদে জলাশয়টি পানির নিগর্মন ও আগমনের জন্য আশিটি উন্মক্ত দ্বার আছে বিধায় বিলটির নামকরণ হয়েছে আশুরার বিল। বিলটিতে  ৮টি গভীর খাদ রয়েছে যা স্থানীয় ভাষায় দহ বলে এবং গ্রীষ্মকালে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর মধ্যে বুড়ির দহ অন্যতম। বিলের তীর ঘেঁষে এক পাশে রয়েছে বিশাল গভীর অরণ্য। নৈসর্গিক শোভামন্ডিত এ বিলটিকে ঘিরে রয়েছে রুপকথার অনেক কল্পকাহিনী। 
ষাট এর দশকে বিভিন্ন জেলা থেকে নদী ভাঙ্গনের শিকার, নি:সম্বল পরিবার সে বিলের পার্শ্ববর্তী এলকায় বসিত স্থাপন শুরু করে।  এরা  পেশা পরিবর্তন কওে, মাছ আহরণই হয়ে উঠে তাদের জীবিকা ও আয়ের প্রধান উৎস্য। আশে পাশের এলাকাগুলোতে চাহিদা মোতাবেক মাছের প্রধান উৎস্য হিসেবে এ বিলের নাম ডাক ছিল। পার্শ্ববর্তী নলশিশা নদীর সাথে খননের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন করায় বর্ষা মৌমুমে নদী বাহিত পলিতে ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে বিলের তলদেশ উঁচু হতে থাকে। আবার শুস্ক সৌসুমে জেগে উঠে জমি। পত্তনির মাধ্যমে জেগে উঠা জমিতে চাষাবাদের ফলে বিলের আয়তন ক্রমশঃই সংকুচিত হতে থাকে। কমে যেতে থাকে জলায়তনসহ মৎস্য সম্পদ। সাং¯ৃ‹তিক বৈষম্য এবং গ্রামীণ নেতৃত্বে প্রভাব রাখার জন্য স্থানীয় মৎস্যজীবীগণ নিজ নিজ গ্রামের নিকটবর্তী দহতে কাঠা স্থাপন করে কর্তৃত্ব বজায় রাখত। পাশাপাশি এক গ্রামের জেলে অন্য গ্রামের নিকটবর্তী দহতে মাছ ধরতে যেতে অনেকাংশে উৎসাহী হতো না। বর্ষা ও মৌসুমে শেষে বিভিন্ন জাল ও ফাদের মাধ্যমে বিশিষ্ট মাছগুলো ধরার ফলে প্রজনন ক্ষেত্রগুলো নষ্ট হয়ে অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়।  ৯০-এর দশকে মহামারী আকারে দেখা দেয় মাছের ক্ষতরোগ। বিলুপ্ত হতে শুরু করে আরো অনেক প্রজাতির মাছ। মৎস্য সমৃদ্ধ বিলের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে এবং মৎস্যজীবীদের কল্যানার্থে সরকার, প্রকল্পের মাধ্যমে আশুরার বিলে দু’দুবার কার্প জাতীয় মাছের পোনা অবমুক্ত করে। কিন্তু অবমুক্ত পরবর্তী বন্যা ও মৎস্যজীবী জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ না থাকায় সে উদ্যোগ থেকে প্রকৃত সুফল পাওয়া যায়নি। 
পরবর্তীতে সরকারি ও বেসরকারী সংস্থাসমূহের সমন্বয়ে সামাজভিত্তিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন প্রকল্পের কার্যক্রম আরম্ভ হয়। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিবেশের সাথে সংগতি রেখে মৎস্য আহরণ বা চাষের মাধ্যমে একটি স্থায়িত্বশীল মৎস্য সম্পদের উন্নয়ন। যা থেকে আয়ের প্রকৃত বন্টনের ওপর একটি সঠিক পদ্ধতি উদ্ভাবন কর যায়। 
কারিতাস উক্ত প্রকল্পে আশুরার বিলসহ আরো ৪টি জলাশয়ে কার্যক্রম বাস্তবায়নে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। কারিতাস এবং প্রকল্পের সার্বিক কার্যক্রমের উল্লেখযোগ্য অংশগুলো হচ্ছে ঃ-
ক্স মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ ও মৎস্যজীবী জনগোষ্ঠী অধিকতর সুযোগ পায়, তা নিশ্চত করার জন্য তাদের সাহায়তা প্রদান করা। 
ক্স মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ ও মৎস্য আহরণ সহনশীল পর্যায়ে সীমিত রাখার মাধ্যমে জলাশয়ে মাছ ধরার অধিকার পেতে পারে।  সে লক্ষ্যে মৎস্যজীবী জনগোষ্ঠীর উদ্ধুদ্ধ ও সংগঠিত করা। 
ক্স পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে দলীয় সদস্যদের প্রশিক্ষণসহ বহুমুখী কর্মকান্ডে মৎস্যজীবীদের নিয়োজিত করা। 
ক্স টেকসই সংগঠিত ব্যবস্থার মাধ্যমে মুক্ত জলাশয়ের সর্বোচ্চ ব্যবহারে সমাজের জনগোষ্টির অংশগ্রহণে সহায়তা করা। 
ক্স জনগোষ্ঠি / সংগঠিত দলগুলোকে ‘‘এপেক্স’’ পর্যায়ে বৃহত্তর জন সংগঠনের সাথে জড়িত করার মাধ্যমে শক্তিশালী করা।  যাতে করে তারা মৎস্য সম্পদ, সামাজিক অধিকার এবং ঋণ সুবিধাদি অধিক হারে পেতে পারে। 
এ প্রকল্পের একটি বিশেষত্ত্ব হচ্ছে, তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের মতামতকে অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করা। যাতে মৎস্যজীবীরা তাদের জীবন ও পরিবেশের জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে প্রকল্প কর্তৃক দেয় সুবিধাদির সমন্বয়ে নিকটবর্তী জলাশয়ের মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও বিভিন্ন কার্যক্রমে  নিজেদের সম্পৃক্ত করে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে। ইংরেজীতে এ ধারনাকে ইড়ঃঃড়স ঁঢ় ঁঢ়ঢ়ৎড়ধপয বলে। 
শুরুতে কারিতাস অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় প্রকল্প ধারনা প্রদানসহ উদৃদ্ধকরণ কার্যকমে প্রকৃত সুফলভোগীদের চিহিৃত করার কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এতে করে প্রকৃত সুফলভোগীদের নিয়ে গ্রামভিত্তিক মৎস্যজীবী ও মহিলা দল গঠনের পথ সহজতর হয়। 
প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে কারিতাস তার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ শিক্ষার মাধ্যমে প্রকল্প কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যায়। কারিতাস মনে করে প্রতিটি মানুষই এক একটি শক্তির আঁধার। এ শক্তি শুধু অজ্ঞতার কারণে জীবনীশক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে না। সম্প্রসারণ শিক্ষা গতানুগতিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের মত নয়। এ শিক্ষার সমাজের সকল পর্যায়ের শিক্ষিত, অশিক্ষিত পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান বা ধারনার প্রসার লাভ করে থাকে। যা পরোক্ষভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি বা সামাজিক প্রচলিত রীতিনীতি পরিবর্তনের সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িত। সম্প্রসারণ শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ তার দৈনন্দিন বিভিন্ন কর্মপ্রনালীতে বৈচিত্র আনে ও অর্জন করে নতুন অভিজ্ঞতা। ঠিক এ ধারণাটিকে ভিত্তি করে কারিতাস, মৎস্য অধিদপ্তর ও ইকলার্ম সংগঠিত দলগুলোর উন্নয়ন তথা নিকটবর্তী জলাশয়ে তাঁদের নিবিড় যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্য একটি প্রায়োগিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ পরিকল্পনার আওতায় রয়েছে। 
ক্স দলভূক্ত প্রতিটি সদস্য সঞ্চয়ী মনোভাবাপন্ন হবে। 
ক্স নিরক্ষর সদস্যকে বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন করে তোলা। 
ক্স সামাজিক ও কারিগরি প্রশিক্ষনের মাধ্যমে সচেতনাতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা। ঋণ সুবিধাদি প্রদানের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানমূলক কর্মকান্ডে সদস্যদের সম্পৃক্ত করা। 
ক্স নিয়মিত সভা, কর্মশালা, শিক্ষা সফরের মাধ্যমে নিজেদের সংগৃহীত জ্ঞান ও তথ্যের বিনিময় করা। 
সম্প্রসারণ শিক্ষা বিস্তারে যোগাযোগের মাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। সম্প্রসারণ কর্মীদেরকে সাধারণ মানুষের মধ্যে জ্ঞান, ধারণা কিংবা কৌশল বিস্তারের ক্ষেত্রে জনগনের চাহিদা বা কোন পদ্ধতি জনসাধারণ সুন্দরভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে তা বিচার বিশ্লেষণ করে নির্ধারণ করতে হয়। কারিতাষ উক্ত বলে সার্বক্ষণিকভাবে ২ জন সম্প্রসারণ কর্মীকে নিয়োগ করে। পাশাপাশি মৎস্য অধিদপ্তর ও ইকলার্মেল যৌথভাবে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ৩ জনকে নিয়োগদান করে। সম্প্রসারণ কার্যক্রমে ও কর্মীদের দক্ষতাপূর্ণ যোগাযোগ এবং প্রকল্প কর্তৃক দেয় সুবিধাদির ফলে মৎস্য জীবীরা আশুরার বিলের বর্তমান ও ভবিষ্যত গুরত্ব, সমস্যা ও তাদের করনীয় সম্পর্কে ফলপ্রসু উদ্যোগ গ্রহণ করে। এরই মধ্যে ১৯টি দলে ৪২৩ জন মৎস্যজীবী এবং ৪টি দলে ৭৫ জন মলিহাকে সংগঠিত করা হয়। সব কয়টি দলের সাপ্তাহিক সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১,১৪,৯৬৮ টাকা। যা নিজ নিজ দলের সাংগঠনিক মনোবল বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে। প্রায় ২৫০ জন পুরুষ ও মহিলা এবং মহিলা সদস্যকে বয়স্ক শিক্ষার আওতায় অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন করা হয়। ১৮টি বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৭০১ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। যাতে করে আশুরার বিলকে কেন্দ্র করে দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠে। মৎস্য চাষ, জাল, নৌকা এবং বিকল্প ঋণ হিসেবে ব্যবহার করে মৎস্যজীবীরা বিভিন্ন আত্মকর্মসংস্থানমূলক কর্মকান্ডে নিজেদের নিয়োজিত করে সফলতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছে। সাংগঠনিক গতিশীলতা ও কর্মকান্ডে সদস্যদের মাঝে দৃঢ় বন্ধন সূচিত হয়। নিজেদের ছোট খাট বিবাদ নিজেরাই মিটাতে সক্ষম হয়। নিজেদের মাঝে নেতৃত্বে চর্চার অভ্যাস গড়ে তোলে। বিল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যৌথ সিদ্ধান্ত নিতে এবং কার্যকর করার পদক্ষেপও গ্রহণ করে। আশুরার বিলে ইতিপূর্বে পোনা মজুদের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যর্থ চেষ্টার মুলে মৎস্যজীবীগন এ বিলের কারিগরি দিকের বিষয়টি বিবেচনা না করার তীব্র সমালোচনা করে। উপরুন্ত তাদের অংশগ্রহণ না থাকা সত্ত্বেও মজুদ পরবর্তী ২০% পুঁজি প্রত্যাহারের বিষয়টি মৎস্যজীবীদের নিকট অযৌত্তিক বলে বিবেচিত হয়েছে। এ সংকট থেকে উত্তরনের উপায় হিসেবে প্রাকৃতিক মাছের সংরক্ষনের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিতে থাকে। কিন্তু কিভাবে এটা সম্ভব। ইতিপূর্বে ১৯টি সংগঠিত দলের প্রত্যেকটি থেকে ১ জন করে প্রতিনিধি নিয়ে ১টি বিল ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। সাংগঠনিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য সকলের সম্মতিক্রমে মনোনিত করা হয় সভাপতি, সম্পাদক ও কোষাধক্ষ্য। এটি কোন বুুড়ির সম্পত্তি নয়। বহু আগে এ দহকে ঘিরে মৎস্যজীবী ও সাধারনে মানুষের ছিল জুজু বুড়ির ভয়। প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্ট বিলে ৮টি দহের মধ্যে এদহটি খুব গবীর,বড় এবং জঙ্গলাকীর্ন ছিল। মাছের একমাত্র আবাসস্থল হিসেবে একে চিহ্নিত করাহতো। এখানে মাছ ধরতে গিয়ে অনেকে বিভিন্ন ভাবে প্রাণ হারিয়েছে। মানুষের মনে ছিল কল্পিত দৈত্য বুড়ির ভয়। সম্ভবত সে নামানুসারে এর নামকরন করা হয়েছে বুড়ির দহ। শুরু হয় মৎস্য অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করার সামাজিক আন্দোলন। বুুড়ির দহে পূর্বে স্থাপিত কাঠার সকল উপকরন কাঠা মালিকগন স্বেচ্ছায় দান করে । স্থানীীয় থানা নির্বাহী কমকর্তা কারিতাস মৎস্য অধিদপ্তর কর্মকর্তা ও মৎস্যজীবীদের সমন্বয়ে  বুড়ির দহে অভয়াশ্রম স্থাপন করা হয়। বুড়ির দহে প্রায় ৮ হেক্টর বিশিষ্ট বিশাল এক গভীর জলরাশি । বর্ষার শুরুতে প্রথম দুমাস বিলে মাছ ধরা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত কার্যকর করে। ক্রমান্বয়ে ছোট ফাসের জাল ব্যবহারে থেকে বিরত থাকার কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। এরই মধ্যে মাছের প্রজনন ক্রিয়া সম্পাদনের ফলে বিলে পরিবর্তন দেখা দেয় মৎস্য সম্পদ প্রাচুর্যতার। ফলশ্র“তিতে সারা বর্ষায় বিলে মাছের পরিমান বছর বছর প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে।  এখন পুরো বিলে একটি মাত্র বিশাল কাঠা ধারন করে আছে এ বুুড়ির দহ। সে সাথে এক গ্রামের মৎস্যজীবী অন্য গ্রামের নিকটবর্তী দহে মাছ ধরার সহজ প্রবেশাদিকার উন্মুুক্ত হলো। মৎস্যজীবীগন বিভিন্ন সময়ে একক দল বা সন্মিলিত  দলীয় সভায় বিল ব্যবস্থাপনার সমস্যাদিও সম্ভাব্য সমাধানের উপায় নিয়মনীতি নিয়ে আলোচনা করে থাকে। ইতিমধ্যে অনিয়মতান্ত্রিক উপায়ে মাছ ধরার জন্য ২/১ জন মৎস্যজীবীকে শান্তি প্রদানের অংশ হিসেবে জরিমানা আদায়ে ঘটনাও ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা মৎস্যজীবীদের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য কিছু সুপারিশ করেছে। সুপারিশমালা সার সংক্ষেপে আলোচনা নিন্মে করা হলো।
(ক) জ্যৈষ্ঠ-শ্রাবন এই তিন মাস আশুরার বিলের কোন স্থানেই মাছ ধরা যাবে না।
(খ) কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ ধরা নিষেধ।নির্দিষ্ট ফাঁসের জালে বিলে মাছধরা যাবে।
(গ) সর্বোপরি মাছ ধরার জন্য বিল ব্যবস্থাপনা কমিটির অনুমোদিত সরঞ্জামই ব্যবহার করা যাবে। বিলে বাঁধ  দিয়ে মাছ ধরা সম্পুর্ন নিষিদ্ধ করতে হবে।
(ঘ) অভয়াশ্রমে কেউ মাছ ধরতে পারবেনা । অভয়াশ্রমে তিন বছর পর পর সাতদিন ব্যাপী মাছ ধরা যাবে। অভয়াশ্রম সীমানার ১০০ গজের মধ্যে মাছ ধরা যাবেনা । অভয়াশ্রম ছাড়া বিলের অন্য কোন স্থানে কাঠা দেয়া যাবে না। 
(ঙ) বহিরাগত মৎস্যজীবী বা এলাকার অন্যান্য ব্যক্তিগত শুধু খাওয়ার জন্য মাঝে মধ্যে মাছ ধরতে পারবে, বিক্রির জন্য নয়।
(চ) প্রতিটি সংগঠিতত দলের সভাপতি/সভানেত্রী ক্ষমতা বলে বিল কমিটির সদস্য হবে। ৩ বছরান্তে বিল ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তন হবে। সদস্যগন পারস্পারিক সৌহার্দ্যের ভিত্তিতে বিল ব্যবস্থাপনা যাবতীয় কার্র্র্যক্রম পরিচালনা করবে।
(ছ) প্রত্যেক দল থেকে প্রয়োজনে অভয়াশ্রমে  পাহারার ব্যবস্থা করবে এবং পাহারাদারের পারিশ্রমিক দলীয় ভাবে সংগ্রহীত হবে।
(জ) বিলে ব্যবহার নিষিদ্ধ এমন মাছ ধরার সরঞ্জাম কমিটির বাজেয়াপ্ত করতে পারবে, এবং আইন অমান্যকারীকে জরিমানা সাময়িক শাস্তি বা সদস্যপদ বাতিল করার ক্ষমতা রাখে।
(ঞ)  যে সময় মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকবে  সে সময় কারিতাস বা পরবর্তীতে নিজ নিজ দলের সংগৃহীত সঞ্চয় বৃদ্ধি ও গ্রহনের মাধ্যমে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। 
(ট) সরকারী সহযোগিতায় দলগুলোর গভীরতা বৃদ্ধি করে পাড়ের জমিকে ধান চাষের উপযোগী করে তোলার প্রচেষ্টা নেয়া হবে।
(ঠ) বিলের মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ ও মৎস্য আহরণ সহনশীল পর্যায়ে রাখার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
(ড) মৎস্যজীবীগণ বিল ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে বিলের ওপর ধার্যকৃত ইজারামূল্য সরকারী কোষাগারে জমাদান করে নিজেদের অধীকার সংরক্ষণ করবে।
 এভাবেই আশুরার বিলের মৎস্যজীবীরা প্রকল্প সহায়তার নিজেদের ইচ্ছা, আগ্রহ ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিল ব্যবস্থাপনায় নিজেদের সম্পৃক্ত করেছে। যে দহকে ঘিরে এলাকাবাসীর ছিল এক সময় অকাল্যণের ও মৃত্যুর জুজু বুড়ির ভয়। সেই বুড়ির দহ আজ সত্যিকারে হয়ে উঠেছে বিল বাসীদের জীবনের আশার প্রদীপ ও বিল উন্নয়নের প্রধান সোপান।

0 comments:

Post a Comment