Saturday, December 28, 2013

পোশাক খাত ও বস্ত্র শিল্পের বিপর্যয় ঠেকাতে হবে

পোশাক খাত ও বস্ত্র শিল্পের বিপর্যয় ঠেকাতে হবে

ড.ফোরকান আলী
বিশ্ববাজারে তুলা ও সুতার উচ্চমূল্যের কারণে চরম প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি দেশের বস্ত্র ও পোশাক খাত। চলতি মৌসুমে বিশ্বের বেশ কয়েকটি তুলা উৎপাদক দেশে উৎপাদন বিপর্যয়ের কারণে তুলার তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে বিশ্ব বাজারে। তুলার কারণে বাড়ছে সুতার দাম। সুতার দামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পোশাকের দাম বৃদ্ধির পরিবর্তে মন্দাজনিত কারণে মূল্য আরো কমার প্রবণতা রয়েছে। এতে পোশাক রফতানিকারকরা পড়েছেন উভয় সঙ্কটে। এক দিকে পোশাকের উৎপাদন খরচ বাড়ছে, অন্য দিকে উৎপাদিত পণ্যের দাম কমছে। সুতার মূল্য যৌক্তিক না হলে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাত প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা। অন্য দিকে সুতা ও বস্ত্রকলের মালিকরা বলেছেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস নিয়ে একের পর এক প্রতিকূল অবস্থায় বস্ত্র খাত যখন বৈরী অবস্থার সাথে লড়াই করে কোনোভাবে টিকে আছে তখন তুলার সঙ্কট এক রকম বিপর্যয়ে ফেলে দিয়েছে উদ্যোক্তাদের।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমবর্ধমানভাবে তুলার মূল্যবৃদ্ধিতে গত এক বছরে বিশ্ববাজারে সুতার মূল্য পাঁচবার বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের বার্ষিক তুলার চাহিদা হলো ৫০ লাখ বেল। আর এই তুলার ১৫-২০ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয় ভারত থেকে আমদানির মাধ্যমে। বাকিটা আসে সিআইএস দেশগুলো অর্থাৎ উজবেকিস্তান, তাজাকিস্তান ও রাশিয়া থেকে। আমেরিকা থেকেও তুলা আমদানি করা হয়ে থাকে। বর্তমানে সেসব দেশে তুলার উৎপাদন খারাপ হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার মূল্য গত জানুয়ারিতে ৮২.২৫ সেন্ট ছিল। যা ফেব্র“য়ারিতে ৮৮.৪৩ সেন্ট, মার্চে ৯৬.৩৮ সেন্ট, মে মাসে ৯৮.১০ সেন্ট, জুনে ৯৮.৮৭ সেন্ট, জুলাইতে ১০০.৪২ সেন্ট, আগটে ১০২.০৮ সেন্ট এবং বর্তমানে ১২০.৭৫ সেন্ট দরে বিক্রি হচ্ছে। পাকিস্তানে বন্যার কারণে সেখানেও তুলার সঙ্কট দেখা দেয়ায় দর বৃদ্ধি পেয়েছে।
তৈরী পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদের আগে সুতার দাম ছিল ৩.৭০ ডলার। ঈদের পর প্রতিদিন সুতার দাম বাড়ানো হচ্ছে। এখন ৪.৫০ ডলার পর্যন্ত দাম চাওয়া হচ্ছে। তুলার দাম অনুসারে প্রতি কেজি সুতার দাম কোনোক্রমেই ৪ ডলারের বেশি হওয়া উচিত নয়। তা ছাড়া এখন ব্যবহার হওয়া তুলা অনেক কম দামে দুই-তিন মাস আগে আমদানি করা হয়েছে। বর্তমানে আমদানি করা তুলার দাম আগামী দুই-তিন মাস পর সুতার দামের ওপর প্রভাব ফেলার কথা। কিন্তু পিনিং মিল মালিকরা সুতার দাম বাড়িয়ে চলেছেন। এ েেত্র সরকারের কোনো মনিটরিং নেই। নিট রফতানিকারকরা অর্ডার নিয়েছে আরো দুই-তিন মাস আগে। তখন সুতার দাম অনুযায়ী উৎপাদন ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু লাগামহীনভাবে সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় কারখানা চালিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। গত মার্চ-এপ্রিলেও স্থানীয় সুতার বাজারে বেশ অস্থিরতা বিরাজ করছিল। সে সময় প্রতি কেজি সুতার দাম এক ডলার পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। পরে সরকারের হস্তেেপ এবং উভয় পরে মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি সহনীয় মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
বিজিএমইএ সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী জানান, আমাদের রফতানির বর্তমান বাজার এখন বেশ ভালো। আমরা এখন ভালো প্রবৃদ্ধি করছি। কিন্তু রফতানি পণ্যের কাঁচামাল সুতার দাম হঠাৎ করে বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা এখন শঙ্কিত। বেশি দরে সুতা কিনে উৎপাদিত পণ্যের দাম বেশি পড়ছে। বায়ারদের কাছ থেকে আমরা চার-পাঁচ মাস আগে যে দরে অর্ডার নিয়েছিলাম এখন সে দরে পণ্য দিলে আমাদের লোকসানে পড়তে হচ্ছে। লোকসান না দিলে বায়াররা হাতছাড়া হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে অনেক ছোট ছোট এবং মাঝারি কারখানা টিকে থাকতে পারছে না। তিনি বলেন, আমরা পিনিং মিল মালিকদের চার-পাঁচ মাস আগেই অর্ডার দিয়ে থাকি। তারা আজ থেকে দুই-তিন মাস আগে যে দরে তুলা কিনেছে এখন সেই তুলায় তৈরি সুতা উচ্চমূল্যে বিক্রি করছে। এটা কোনো যৌক্তিক হতে পারে না।
বিজিএমইএ নেতা বলেন, আমাদের দেশ তুলা উৎপাদন করে না। আমরা তুলা আমদানি করে থাকি। কম দামের তুলায় তৈরি সুতা কেন বেশি দামে বিক্রি হবে। এখন যে তুলা তারা আমদানি করছে দুই-তিন মাস পর সে তুলার সুতার দাম ওই দরে হবে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে যেটুকু দর বেড়েছে সেটুকুই বাড়ানো উচিত। কিন্তু এখানে তা হচ্ছে না।
রফতানির বিষয়ে বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি মোঃ ফজলুল হক জানান, বর্তমানে রফতানির অবস্থা ভালো। নতুন নতুন মার্কেটে আমরা যাচ্ছি। প্রবৃদ্ধি অনেক ভালো। কিন্তু সুতার দাম বৃদ্ধির কারণে এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। আমাদের বাজার হারাতে হবে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে। ফলে ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, স্থানীয় বাজারে ঈদের সময়ে প্রতি কেজি সুতার দাম ছিল ৩.৭৫ ডলার। এখন তা বেড়ে সাড়ে ৪ ডলারে দাঁড়িয়েছে। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে সুতার মূল্য কেজিপ্রতি ৭৫ সেন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশের বাজারে সুতার দাম প্রতি কেজি ৪ ডলারের নিচে। বেশি দামে সুতা কিনে কাপড় তৈরিতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সুতার দাম পরিবর্তন ও যৌক্তিক করা না হলে রফতানি খাতে আয় কমে যাবে। বাজার হারিয়ে অনেক শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে। তুলার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে বেড়েছে স্থানীয় বাজারে সুতার দাম তার চেয়ে বেশি বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় রফতানি খাত মারাÍক হুমকির সমুখীন হয়েছে। পোশাক শিল্প মালিকদের দাবি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়েও দেশীয় বাজারে সুতার মূল্য অনেক বেশি। ঈদের পর মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে সুতার দাম প্রতি কেজি ৭৫ সেন্ট বেড়েছে। ফলে চড়া দামে সুতা কিনে পণ্য তৈরি করে তা বাজার ধরে রাখা কঠিন হবে বলে রফতানিকারকরা জানান।
অন্য দিকে বিটিএমএ বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম গত সাত মাসে ৩৮.৫০ সেন্ট বেড়েছে। আর এক বছরে বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। আজ বিটিএমএ’র আমন্ত্রণে বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ সুতার মূল্য নিয়ে আলোচনায় বসছেন বলে বিজিএমইএ সভাপতি জানান।
বাংলাদেশ ইয়ার্ন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশন সুতার দাম অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গতকাল রোববার দুপুরে নারায়ণগঞ্জে অ্যাসোসিয়েশনের কার্যকরী পরিষদের মাসিক সভায় নেতৃবৃন্দ এই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সংগঠনের সভাপতি এম সোলায়মানের সভাপতিত্বে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নেতারা বলেন, সুতার দাম এভাবে বাড়তে থাকলে টেক্সটাইল খাতে চরম সঙ্কট সৃষ্টি হবে। তুলা উৎপাদনকারী দেশগুলোতে এ বছর উৎপাদন কম হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই সুতার মূল্য ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। স্থানীয় বাজার ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকায় ভারত বাংলাদেশে তুলা রফতানি না করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করেছে। ভারত ও অন্যান্য দেশ থেকে তুলা আমদানির েেত্র সরকারের উদ্যোগ নেয়া জরুরি। সভায় সুতার মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য পিনিং মিলগুলোকে আহ্বান জানানো হয়।
সুতার মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে বিটিএমএ সভাপতি আবদুল হাই সরকার বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সুতার দাম অনেক বেড়েছে। ফলে আমাদের উৎপাদিত সুতার দামও বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার মূল্য ১২০.৭৫ সেন্টের বেশি। আর উৎপাদন খরচ দিয়ে সুতার দামও স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম বৃদ্ধি পেলে আমাদের করার কিছুই নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে যেখানে প্রতি পাউন্ড তুলার দর গত ১০ বছর ধরে স্বাভাবিক মূল্য ৬০ সেন্ট ছিল, সেখানে প্রতি মাসে বাড়তে বাড়তে ১২০.৭৫ সেন্টে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, আমদানিকৃত তুলায় আমরা সুতা তৈরি করি। অথচ অহেতুকভাবে আমাদের ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে। আমাদের ৯০ শতাংশ সুতা নেয় বিকেএমইএ। ভারতে তুলা উৎপাদন হয়। সেখানেই এখন সুতার দাম প্রতি কেজি ৪.১০ ডলার। আর আমরা নিচ্ছি ৪.৩০ ডলার।
এক পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, বছরে আমাদের দেশে তুলার চাহিদা ৫০ লাখ বেল। প্রতি বেল হলো ৪৮০ পাউন্ড। আর স্থানীয় বাজার ও রফতানি মিলে সুতার দেশীয় চাহিদা হলো ২ হাজার মিলিয়ন কেজি। আন্তর্জাতিক বাজারে সুতার দাম অনেক বেশি বেড়েছে। পাশাপাশি ভারতেও সুতার দাম অনেক বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, এক দিকে তুলার আন্তর্জাতিক বাজারদর বৃদ্ধি এবং অন্য দিকে বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে কারখানাগুলোতে সুতা উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে উৎপাদিত সুতার দর বাড়বেই। তা না হলে এই মিলগুলোও টিকে থাকতে পারবে না।

0 comments:

Post a Comment