Tuesday, May 1, 2018

স্মরণ :জুবাইদা গুলশান আরা

স্মরণ :জুবাইদা গুলশান আরা 
আলী ফোরকান
জন্ম : ১৯৪২ সালে ২২ এপ্রিল।
মৃত্যু :  ১৯ মার্চ ২০১৭
বাংলাদেশের শিক্ষা ও সাহিত্যাঙ্গনে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও সুপরিচিত একটি নাম জুবাইদা গুলশান আরা। যিনি প্রতিভার প্রাচুর্য্যে ও প্রখরতায়, মেধাদীপ্ত সৃষ্টিতে, স্নিগ্ধ মধুর ব্যক্তিত্বে ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে নিজস্ব বলয়ে নিজেকে চিহ্নিত করেছেন। উত্তরবঙ্গের নদী ঘেঁষে সবুজ শ্যামলিমায় ছায়াময় বর্ধিঞ্চু গ্রাম রূপপুরে তাঁর শেকড় ও পিতৃভূমি। তবে তার জন্ম হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ার পিতা আলহাজ মুহম্মদ ইউনুসের কর্মস্থল খুলনায়, ১৯৪২ সালে ২২ এপ্রিল।
ছেলেবেলা কাটে কলকাতায় ও পরে দার্জিলিং, কার্র্লিয়াং পাহাড়ে নির্জলা আনন্দে। দুরন্ত শৈশব অভাবনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে কাটিয়ে তিনি সমতলে নেমে আসেন। টাঙ্গাইলের বিখ্যাত বিন্দুবাসিনী স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা, গান, আবৃত্তি সব ক্ষেত্রেই দক্ষতা ও সুনাম অর্জন করেন। ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী স্কুল থেকে ১৯৬৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে আনন্দ মোহন কলেজে ভর্তি হন। পরে ইডেন কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬২ সালে বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করে ভিকারুন্নেসা গার্লস স্কুলে শিক্ষকতা করেন (১৯৬৩-১৯৬৪)। ১৯৬৪ সালে পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে নির্বাচিত হয়ে ঢাকা ইডেন গার্লস কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। তার সুদীর্ঘ কর্মজীবনে বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, উপাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিভিন্ন সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনে বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষক, মৌখিক পরীক্ষক ও প্রধান পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন (২০০২-২০০৬) দক্ষতার সাথে। জাতীয় কমিটি ও গ্রন্থনীতি পিএসসি এবং জাতীয় শিশুনীতির সাথে যুক্ত থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রাণীবিজ্ঞানী মাহমুদ-উল-আমীনের সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয়নের অভিলাষে তিনি ইংল্যান্ডে চিত্রশিল্প ও মৃৎশিল্পে, ডেনমার্কে ডেনিশ ফোকলোর ও ভাষাবিষয়ে স্বল্পকালীন শিক্ষা লাভ করেন।
জুবাইদা গুলশান আরার সাহিত্য জগতে গোড়াপত্তন ঘটে তার বর্ণাঢ্য কৈশোরে ভাষা আন্দোলনের গান ও আবেগ নিয়ে। ভেতরের শক্তিই তাকে জাগিয়ে দেয় লেখকের স্বপ্ন। বরিশাল সদর গার্লস স্কুলে পড়ার সময় তার প্রথম কবিতা ছাপা হয় পত্রিকায়। প্রথম ছড়ার বই ‘মজার ছড়া’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে।
সৌন্দর্য অন্বেষণ ও শিল্পীত জীবনভাবনার প্রতীক তার রচিত সাহিত্য। অবলীলায় গাহন করতেন জীবনের গভীরে। তিনি দুঃখ-তাপিত, যন্ত্রণাদগ্ধ বিরূপ বিশ্বে একাকী থেকেও বেঁচে থাকতে জীবনকে ভালোবাসায় সিক্ত করেছেন। হেসেছেন গোলাপের হাসি। 
তার বিপুল রচনা ও লেখার মধ্যে আছে গল্প, উপন্যাস, নাটক, ভ্রমণকাহিনী, মুক্তিযুদ্ধের কথা, ইতিহাসভিত্তিক ও গবেষণামূলক গ্রন্থ, শিশুতোষ গ্রন্থ। উপন্যাস ১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ খণ্ড, ঢাকার তিনশো বছরের ইতিহাস ও ঘটনাভিত্তিক উপন্যাস, প্রচুর ছোটগল্প, প্রবন্ধ ও বিচিত্র শিশু জগতের রচনা। 
রচিত উপন্যাসÑ আমি যোদ্ধা অযুত বৎসর (১৯৯৯) (মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস), বিষাদ নগরে যাত্রা (১৯৮২), ধল প্রহরের আলো (১৯৮২), কি লিখেছো তরবারী তুমি (১৯৯২), ছোঁ বুড়ির দৌড় (১৯৮৭), ঘৃণার জঠরে জন্ম (১৯৮৮), প্রমিথিউসের আগুন (১৯৮৭), অশ্রুনদীর ওপারে (১৯৮৯), ঊষারাগ (১৯৯০), ঘাসের উপরে মুখ রেখে (১৯৯৪), পদ্মা আমার পদ্মা (১৯৯৪), হৃদয়ে লিখো নাম (১৯৯৪), চৈতী তোমার ভালোবাসা (১৯৯৪), বিবর্ণ নগরী (১৯৯৫), মন্দাকিনী (১৯৯৫), ভালোবাসার স্বভাব এমন (২০০৪), বিধাতার চারদিন ও সোনালী রঙের নদী (২০০২), অপরিচয়ের স্বপ্নযাত্রা (২০১২)। শিশু-কিশোরদের জন্য লিখেছেন মজার ছড়া (১৯৬৯), শিশুকিশোর সমগ্র, মন ছুটেছে তেপান্তরে, নিঝুম দ্বীপের গল্প, রূপমের চিড়িয়াখানা (২০০৩), তোমাদের জন্য গল্প (২০০২), অচিন পথের বন্ধু, পরিচয় হোক বন্ধুর সাথে (২০০২), শিশু, তোর খেলার সাথী (২০০২), ছোটদের নাটক মালা (২০০৩), বাবুই পাখীর বাসা, ঘুম ভাঙ্গানো নদীসহ (১৯৮৮) আরও হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া অসংখ্য লেখা। তাঁর ছোটদের বই গল্প তবু গল্প নয় (২০০৩) ইউনিসেফ থেকে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
শিশুকিশোরদের জন্য প্রচারিত টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তার অসাধারণ মেধা ও আন্তরিকতার পরিচয় পাওয়া যায় । বাংলাদেশ টেলিভিশনে শিশুদের জন্য প্রচারিত অনুষ্ঠানে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সফল উপস্থাপক ছিলেন। দীর্ঘ দিন ধরে শিশু অনুষ্ঠান, সাহিত্য আসর ও গণশিক্ষা অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত থেকেছেন। টিভি বেতারে তার রচিত একাধিক নাটক প্রচারিত হয়েছে।
জুবাইদা গুলশান আরা সম্মানিত হয়েছেন বহুবিধ পুরস্কারে। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশের পদক (২০০৫), কবি আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৯), কমর মসতরী স্বর্ণপদক (১৯৮৫), বাংলাদেশ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন পদক (২০০০), শের-এ বাংলা স্মৃতি পুরস্কার, জিসাস স্বর্ণপদক (২০০৪), কবি জসিম উদ্দীন পরিষদ পুরস্কার (১৯৯৩), চয়ন সাহিত্য পত্রিকা স্বর্ণপদক (২০১৩), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক (১৯৮৯) এবং লেখিকা সংঘ প্রবর্তিত ড. তাইবুন নাহার রশীদ (কবিরতœ) স্বর্ণপদক (২০১৬), ত্রিভুজ সাহিত্য সংসদ পুরস্কার (১৯৯৩), কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার (২০০২), দেশনেত্রী সাংস্কৃতিক পুরস্কার (২০০২), নন্দিনী সাহিত্য পুরস্কার ও আরো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাহিত্য সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান থেকে সংবর্ধনা ও সম্মাননা লাভ করেন।
তিনি বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের জন্মলগ্ন (১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭৩) থেকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকেছেন। আমৃত্যু ছিলেন এই সংগঠনের সহসভাপতির পদে। লেখিকা সংঘ প্রকাশিত বার্ষিক সাহিত্য পত্রিকা ‘সঞ্চয়ন’-এর সম্পাদনার দায়িত্ব তিনি পালন করতেন সুচারুরূপে। পেন ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ শাখার সাহিত্যপত্র সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সালে এশিয়ান উইমেন্স, ড্রামাটিক কনফারেন্স ফিলিপিনের ম্যানিলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ও তার তৈরি শর্ট ফিল্ম ‘উইম্যান ওয়াক আপ ইটস টাইম’ ভূয়সী প্রশংসা লাভ করে। ২০০৫ সালে তিনি ‘উইম্যান অব দ্য ইয়ার’ উপাধিতে ভূষিত হন।
১৯ মার্চ এই প্রতিভাদীপ্ত খ্যাতিমান নারী পঁচাত্তর বছর বয়সে চলে যান পৃথিবী ছেড়ে।
জুবাইদা গুলশান আরা জীবনচলার সাধনায় নিজের অবস্থানকে দৃঢ় করে রেখেছিলেন এক মানবিক শুদ্ধতায়। তার লেখনী পাঠককে শুধু আনন্দই দেয়নি, চিন্তাচেতনায় আলোকিত করে, উজ্জীবিত করে তোলে।

0 comments:

Post a Comment