Tuesday, May 1, 2018

স্মরণ : কবি শেখ ফজলল করিম

স্মরণ : কবি শেখ ফজলল করিম 
ফোরকান আলী
জন্ম  :  ১৮৮৩ সালের ১ মার্চ 
মৃত্যু : ১৯৩৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর 
কবির স্বর্গ ও নরক নামের কালজয়ী কবিতাটি ১৩২১ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যা ভারতবর্ষে প্রকাশিত হয়েছিল। কবির এই কবিতাটি ‘বঙ্গবাণী’ ও ‘মালঞ্চ’ নামক দু’টি স্কুল পাঠ্যপুস্তকেও গৃহীত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সিলেবাসে ম্যাট্রিক ক্লাসের জন্য তার কবিতা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে
বাঙালি মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে ক’জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয় হয়ে রয়েছেন তাদের মধ্যে শেখ ফজলল করিম হলেন অন্যতম।
‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে’ তা বহুদূর,
মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক মানুষেতে সুরা সুর।’
কবিতার রচয়িতা কবি শেখ ফজলল করিম, কাব্য রতœাকার, নীতিবাদী সাহিত্যিকের ৮০তম মৃত্যুবার্ষিকী অতিক্রান্ত হতে চলেছে।
কবি শেখ ফজলল করিম লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনায় ১৮৮৩ সালের ১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তার পিতার নাম আমীর উল্লা সরদার ও মাতার নাম কোকিলা বিবি। শৈশবে কাকিনা স্কুল থেকে ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে শেখ ফজলল করিম মধ্য ইংরেজি পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে রংপুর জেলা স্কুল থেকে তিনি মাইনর পরীক্ষায় পাস করেন। ছাত্রাবস্থায় কাকিনা স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় তার বিয়ে হয় কালীগঞ্জ উপজেলার বিন বিনিয়া গ্রামের গনি মোহাম্মদ সর্দারের মেয়ে বসিরণ নেসা খাতুনের সঙ্গে (মৃত্যু ১৯৬২ খ্রি:)। অতঃপর নানা কারণে তার স্কুল জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। দাম্পত্য জীবনে দু’পুত্রের জনক ছিলেন কবি। তার প্রথম পুত্র মাত্র তিন দিন জীবিত ছিল। দ্বিতীয় পুত্রের নাম মতিয়ার রহমান। কবি শেখ ফজলল করিম ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে থেকে ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পাট ব্যবসায়প্রতিষ্ঠান মেসার্স এমভি কোম্পানিতে চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন। স্বাধীনচেতা ফজলল করিম কোম্পানির মন যুগিয়ে কাজ করতে না পারায় চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। ত্রিশের দশকে শেখ ফজলল করিম ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টও ছিলেন। কর্মজীবনে তিনি মুন্সি মেহেরউল্লাহর (১৮৬১-১৯০৭ খ্রি:) অনুপ্রেরণা ও পরামর্শ পেয়ে ছিলেন। সাহিত্য সৃষ্টি, প্রকাশনা ও সাধনার পথে ধাবমান শেখ ফজলল করিম কাকিনায় নিজ বাড়িতে তার পীর সাহেব হজরত মাওলানা মহম্মদ শাহ সাহাব উদ্দীনের নামানুসারে তৎকালীন প্রায় দেড় হাজার টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন “সাহাবিয়া প্রিন্টিং ওয়ার্কস”। তিনি শেষ জীবন পর্যন্ত লেখার জগতেই জীবন অতিবাহিত করেন।
তার সাহিত্যিক জীবনের উন্মেষ ছোট বেলা থেকেই। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি ‘সরল পদ্য বিকাশ’ কবিতা গুচ্ছ প্রকাশ করেন। এরপর থেকে তিনি আজীবন সাহিত্য সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তার সাহিত্যকর্মে ধর্ম ও নীতি শাস্ত্র বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। নৈতিক আদর্শে সমৃদ্ধ কবিতা ও গদ্য লিখে তিনি প্রভুত সুনাম অর্জন করেন। মুসলিম ইতিহাস, মুসলিম উপাখ্যান, মুসলিম জীবন ইত্যাদি ছিল তার সাহিত্যের মূল উপজীব্য বিষয়, ছাত্রাবস্থায় ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘আহমেদিয়া লাইব্রেরি” নামক একটি ব্যক্তিগত পাঠাগার নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছিলেন। স্কুলের বাঁধা ধরা নিয়ম-কানুন তার কখনোই ভালো লাগেনি। তবে বাইরের প্রচুর বই অধ্যয়নে তার অনীহা ছিল না। বিশেষ করে ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রচুর জ্ঞান পিপাসা ও অনুশীলন তার লেখার জগতকে সমৃদ্ধ করেছে। শেখ ফজলল করিমের সাহিত্যের উপজীব্য বিষয় ধর্মীয় হলেও দৃষ্টিভঙ্গির উদারতা ও সাহিত্যিক প্রসাদ গুনে তার সৃষ্টি সার্বজনীন হয়ে উঠেছে। 
শেখ ফজলল করিমের পরিচিতি মূলত একজন কবি হিসেবে কিন্তু আমরা দেখি। তিনি কবিতা ছাড়াও লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ, নাট্যকাব্য, জীবনী গ্রন্থ, ইতিহাস গবেষণামূলক নিবন্ধ, সমাজ গঠনমূলক তত্ত্বকথা, গল্প, শিশুতোষ সাহিত্য, নীতি কথা, চরিত গ্রন্থ এবং বিবিধ সমালোচনামূলক রচনা, সাহিত্যের সব শাখায় ছিল তার পদচারণা।
ইসলাম প্রচারক, নবনুর, কোহিনুর, বাসনা, মিহির ও সুধাকর, ভারতবর্ষ, সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, শিশুসাথী, কল্পতরু, মোসলেম ভারত, সোলতান, মাসিক মোহাম্মদী, আলহক, বসুমতি ইত্যাদি পত্রপত্রিকায় ফজলল করিমের অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, উপন্যাস, কাব্য, জীবনী, আলোচনা, সমালোচনা ও অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। সমকালীন মুসলমান কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে তার অবস্থান ছিল প্রথম সারিতে। সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর (১৮৮০-১৯৩১ খ্রি:) নেতৃত্বে যে নবতর সাহিত্য প্রচেষ্টার উন্মেষ এ দেশে ঘটেছিল তার সার্থক ধারক ও বাহক ছিলেন শেখ ফজলল করিম, জীবিতকালেই তিনি পেয়েছেন তার সাহিত্য কর্মের স্বীকৃতি। ‘পথ ও পাথেয়’ গ্রন্থের জন্য তিনি রৌপ্যপদক পান। ১৩২৩ বঙ্গাব্দে নদীয়া সাহিত্য সভা তাকে ‘সাহিত্য বিশারদ’ উপাধিতে ভূষিত করে। ‘চিন্তার চাষ’ গ্রন্থের জন্য তিনি লাভ করেন নীতি ভূষণ উপাধি। ১৩৩১ বঙ্গাব্দে খিদিরপুর মাইকেল লাইব্রেরি মধুস্মৃতি কবিতার জন্য তিনি রৌপ্যপদক পান। ১৯৩৪-৩৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা সরকারের লঁঃব জবংঃৎরপঃরড়হ রৌপ্যপদক তিনি পেয়েছিলেন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে। এ ছাড়াও তৎকালীন বাংলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাকে দিয়েছিল কাব্যভূষণ, সাহিত্যরতœ, বিদ্যাবিনোদ, কাব্যরতœাকর উপাধি ও সম্মান।
শেখ ফজলল করিম কাকিনা থেকে ‘বাসনা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের মে’ মাসে। ‘বাসনা’ পত্রিকাটি দু’বছর চালু ছিল। সাহিত্যের মাধ্যমে হিন্দু মুসলমান মিলন সম্ভব এটি ছিল তার অভিমত। এই পত্রিকায় হামেদ আলী, শেখ রেয়াজ উদ্দীন আহমদ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, তসলিম উদ্দীন আহমদ (রংপুর এর প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট) এবং আরো অনেক স্বনামখ্যাত ব্যক্তির লেখা প্রকাশিত হতো। ওই সময় ‘বাসনা’ পত্রিকাটি ছিল পূর্ববঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাসিক পত্রিকা। বিভিন্ন সূত্র থেকে শেখ ফজলল করিমের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা অনুযায়ী আনুমানিক মোট ৫৮টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো-
সরল পদ্য বিকাশ (বাল্যকালের রচনা), তৃষ্ণা (কাব্য), মানসিংহ, পরিত্রাণ (কাব্য), ভগ্নবীনা বা ইসলাম চিত্র, লায়লী মজনু, আফগান স্থানের ইতিহাস, ভক্তি পুষ্পাঞ্জলি, গাঁথা, হারুন-অর-রশীদের গল্প, বিবি রহিমা, পথ ও পাথেয়, রাজর্ষি এবরাহিম, চিন্তার চাষ, বিবি খাদিজা, বিবি ফাতেমা, মোহাম্মদ চরিত, বিবি আয়েশা, ছামিতত্ত্ব বা ধর্মসঙ্গীত ইত্যাদি। তিনি ওমর খৈয়ামেরও বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। 
শেখ ফজলল করিমের গদ্য রচনার উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে ভাষা নির্মাণে তার অসাধারণ দক্ষতা। তার সাহিত্য সৃষ্টিতে ছিল একটা নিজস্ব সুর, নিজস্ব ভাষা। আবেগ উপলব্ধি ও অনুভূতি প্রকাশের সে ভাষাকে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যবহার করেছেন। স্বাচ্ছন্দ্য গতিময়তা তার লেখার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
কবির স্বর্গ ও নরক নামের কালজয়ী কবিতাটি ১৩২১ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যা ভারতবর্ষে প্রকাশিত হয়েছিল। কবির এই কবিতাটি ‘বঙ্গবাণী’ ও ‘মালঞ্চ’ নামক দু’টি স্কুল পাঠ্যপুস্তকেও গৃহীত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সিলেবাসে ম্যাট্রিক ক্লাসের জন্য তার কবিতা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক?’ বিখ্যাত কবিতার কবি হিসেবে সমগ্র বাংলাদেশে তিনি আজো সুপরিচিত। লালমনিরহাট তথা বাংলার গৌরব শেখ ফজলল করিমের অনেক পাণ্ডুলিপি কলকাতার নুর লাইব্রেরিতে প্রকাশের অপেক্ষায় ছিল। সেগুলো কোথায় আমরা তা জানি না। খোঁজ করলে হয়তো কবির আরো অনেক রচনার সন্ধান পাওয়া যাবে। 
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে অবিভক্ত বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানদের অবস্থান মোটেও সুদৃঢ় ছিল না। ব্রিটিশ ভারতে তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ছিল সুস্থ মননশীল সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। কবি শেখ ফজলল করিম সে সময়ে কবি বা গদ্য লেখক হিসেবে তিনি তার সাহিত্যের মাধ্যমে সুপরিচিত হয়েছিলেন। এটা তার অসীম কৃতিত্বের পরিচয়।
বরেণ্য কবি ও সাহিত্যিক শেখ ফজলল করিম ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে শেখ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কাকিনায় নিজ ভবনে তিনি চিরশায়িত আছেন।
তার কবর সাহাবিয়া প্রিন্টিং প্রেসের অবদান, ব্যবহৃত জিনিসপত্রাদি এবং নানা স্মৃতিচিহ্ন আমরা দেখতে পাই কবি বাড়িতে। সংরক্ষণের অভাবে এগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নানা আশ্বাস, নানা প্রতিশ্র“তি এবং নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও কবি বাড়িতে কিংবা কাকিনায় তার সম্পর্কে গবেষণা করার ক্ষেত্র কিংবা স্মৃতি রক্ষার সমন্বিত আয়োজন আমরা লক্ষ করি না। যেটুকু হয়েছে তা উল্লেখযোগ্য নয়। 
মৃত্যুর আগে শেখ ফজলল করিম তার নিজের জন্য কবিতা লিখে রেখে গেছেন-
আর্দ্র মহীতলে হেথা চির-নিদ্রাগত
ব্যথাতুর দীন কবি, অফুরন্ত সাধ,
ভুলে যাও ত্র“টি তার জনমের মত,
হয়তো সে করিয়াছে শত অপরাধ।
পান্থ পদরেণু পুত্র এ শেষ ভবন,
হতে পারে তার ভাগ্যে সুখের নন্দন।
কবি মনে করেছিলেন মধুসূদনের সমাধি ফলকের উৎকীর্ণ কবিতার মতো ওই কবিতাটির হয়তো বা লেখা থাকবে তারও সমাধিতে। মৃত্যুর ৮০ বছর পরও কি আমরা তার শেষ ইচ্ছাটি পূরণ করতে পারি না?

0 comments:

Post a Comment