Monday, April 23, 2018

স্মরণ: বারুখ স্পিনোজা

স্মরণ: বারুখ স্পিনোজা
আলী ফোরকান
জন্ম : ১৬৩২ সালের ২৪ নভেম্বর 
মৃত্যু : ১৬৭৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি 
 একজন ওলন্দাজ দার্শনিক। তিনি আধুনিক যুগের শুরুর একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মূলত সবচেয়ে মৌলিক দার্শনিক। দার্শনিক হিসেবে তিনি মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন এবং একই সঙ্গে কর্ম আচরণের ক্ষেত্রে নিজেকে নীতিনিষ্ঠ, নির্ভীক ও নিষ্কলঙ্ক মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি নির্জনতা পছন্দ করতেন। কিন্তু মানুষের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা ছিল যার প্রমাণ, মানুষ কিভাবে পৃথিবীতে সুখ লাভ করতে পারে তা স্থির করার পেছনে তার সাধনা। তার মতে জীব জগতে সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করে পৃথিবীতে শান্তি ও সুখের প্রতিষ্ঠা করার জন্য মানুষের যা করা দরকার তার স্বরূপ অনুসন্ধান করাই দার্শনিকের মূল লক্ষ্য। ব্যাপক পাণ্ডিত্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তার মধ্যে কোনো অহঙ্কার ছিল না। বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়দের কাছে তিনি ছিলেন সদালাপী ও অমায়িক একজন মানুষ। নিজের মতো তিনি কখনো অন্যের ওপর চাপিয়ে দেননি। সবারই চিন্তা করার ও মতো প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, এ ধারণায় তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। বারুখ স্পিনোজা ১৬৩২ সালের নভেম্বর ২৪ তারিখে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম শহরে এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পর্তুগাল থেকে নির্যাতিত হয়ে ইহুদিদের যে দলটি নেদারল্যান্ডস আশ্রয়গ্রহণ করেছিল তার পরিবার সে দলেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার বাবা গরমঁবষ ফব ঊংঢ়রহড়ংধ সে সময়কার ইতুদি সম্প্রদায়ের একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। এ কারণে শৈশব থেকেই স্পিনোজা শিক্ষা-দীক্ষা ও বেড়ে উঠার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা লাভ করেছিলেন। তার মা’র নাম এনা ডিবোরা। বাবা-মা উভয়েই সেফার্ডীয় ইহুদি বংশের ছিলেন। ১৬৩৮ সালে আমস্টারডামে ইহুদিদের জন্য একটি স্কুল খোলা হয়। স্পিনোজা এই স্কুলে তার পড়াশোনা শুরু করেন। সেখানে মূলত ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হতো। এখানে ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে তিনি জ্ঞান লাভ করেন। এরপর ইবন এজরা ও মাইমোনাইডসসহ বিভিন্ন ইহুদি দার্শনিকের জীবনী রচনার সঙ্গে পরিচিত হন। এ সময়েই তিনি কাব্বালার মরমী মতবাদের সঙ্গে পরিচিত হন যা তার দার্শনিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছিল। অনেকের মতে তার দর্শনে নব্য-প্লেটোবাদী চিন্তাধারার মূলে ছিল কাব্বালার দর্শন।
স্কুলের গণ্ডীবদ্ধ পড়াশোনার পাশাপাশি স্পিনোজা বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করতেন। এ বিষয়গুলোতে তিনি গভীর বুপত্তিও অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিভিন্ন ভাষা শিক্ষার প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। তার পারিবারিক ভাষা ছিল স্পেনীয় ভাষা। স্পেনীয় ছাড়াও তিনি লাতিন, পর্তুগীজ, ইতালীয়, ওলন্দাজ এবং ফরাসি ভাষা আয়ত্ত্ব করেছিলেন। ফ্রান্সিসকাস ফান ডেন এন্ডেন নামক একজন পণ্ডিতের কাছে তিনি লাতিন ভাষা শিক্ষা করেন। বাল্যকাল থেকেই স্পিনোজা বিশেষ মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। এ দেখে তার সম্প্রদায়ের লোকেরা ধারণা করেছিল যে তিনি বড় হয়ে নিজ সম্প্রদায়ের উন্নতি সাধন করবেন এবং ইহুদি ধর্মের জয়গান করবেন। কিন্তু তাদের এ ধারণা আর কার্যকর হয়নি।
১৬৬০-এর দশকের প্রথম দিকে স্পিনোজার নাম ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থ প্রকাশই ছিল এর কারণ। তার প্রথম প্রকাশনা ছিল ঞৎধপঃধঃঁং ফব রহঃবষষবপঃঁং বসবহফধঃরড়হব। ১৬৬৩ সালে তিনি ‘কজিটা মেটাফিজিকা’ শিরোনামে রনে দেকার্তের প্রিন্সিপিয়া ফিলোসফিয়া গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডের একটি সার-সংক্ষেপ প্রকাশ করেন। তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়া তৎকালীন বিখ্যাত দার্শনিক ও বিজ্ঞানী গটফ্রিড লাইবনিজ এবং হেনরি অলডেনবুর্গ তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জীবদ্দশায় প্রকাশিত তার অপর দুইটি বিখ্যাত গ্রন্থ হলো ‘ট্র্যাকটাটাস থিওলোজিকো-পলিটিকাস’ (১৬৭০) এবং ‘ট্র্যাকটাটাস পলিটিকাস’। ট্র্যাকটাটাস থিওলোজিকো-পলিটিকাস নামক বইটিতে বাইবেলের সমালোচনার পাশাপাশি তার রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদের সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে। দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে এই বইটি এতটাই উদারনৈতিক ছিল যে, নেদারল্যান্ডের মতো একটি সহিষ্ণু দেশেও তাকে এটি ছদ্ম নামে প্রকাশ করতে হয়েছিল। এত কিছু করেও তিনি পার পাননি। বইটি সেদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। এরপর তার জীবদ্দশায় তিনি আর কোনো গ্রন্থ প্রকাশ করেননি। তবে বন্ধু, শুভাকাক্সক্ষী এবং সমালোচকদের সঙ্গে তিনি পত্র যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছিলেন। ১৬৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি ২১ তারিখে নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরের উপকণ্ঠে নিজস্ব বাস ভবনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

0 comments:

Post a Comment