দুর্বল হয়ে পড়ছে ব্যাংক’ স্বাস্থ্য
আলী ফোরকান
বাড়ছে খেলাপি ঋণ। দুর্বল হয়ে পড়ছে ব্যাংক। জনগণের আমানত গ্রহণ করলেও তার সুরা দিতে পারছে না। ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করায় ব্যাংকগুলোতে প্রতিনিয়ত খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এর প্রভাব পড়ছে আমানত ও সুদের হারে। দুর্বল হয়ে পড়ছে ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্য। ২০১৬ সাল শেষে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। ২০১৫ সাল শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৮০১ কোটি টাকা। যদিও ২০১৫ সালে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল মাত্র ১ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। (তথ্য সূত্র বাংলাদেশ ব্যাংক)। এর বাইরে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। যার মাধ্যমে এসব মন্দ ঋণ আর্থিক প্রতিবেদন থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। এ ঋণ হিসাবে এলে খেলাপি ঋণ হতো ১ লাখ কোটি টাকার বেশি।
ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরের শেষে আর্থিক হিসাব ভালো রাখতে ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃ তফসিল করেছে। মূলত শেয়ারধারীদের বেশি হারে লভ্যাংশ দিতেই খেলাপি কমানো হয়েছে। এ কারণে খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ পায়নি। ফলে গত সেপ্টেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমেছে। গত সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৬৫ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর সালেহউদ্দিন আহমেদ একটি জাতীয় দৈনিকে স্বাক্ষাৎকারে বলেন, যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছে তা আদায়ে উদ্যোগের বড় অভাব আছে। বড় ব্যবসায়ীদের কাছে ব্যাংকগুলো অর্থ আদায় করতে পারছে না। ঋণ পরিশোধ না করলেও তাদের কিছু করা যাচ্ছে না। তারা আবারও ঋণ সুবিধা পাচ্ছে। এর মধ্যে একটা দুষ্টচক্র গড়ে উঠেছে। কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় করতে না পারলে অন্যরাও ঋণ পরিশোধে আগ্রহ হারাবে। খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকায় ব্যাংকগুলো ব্যয় সমন্বয় করতে আমানতের সুদের হার কমিয়ে আনছে। ঋণের সুদের হার কমানোর চাপ সামলাতেই আমানতের সুদ হার কমানো হচ্ছে। অথচ ৫ বছর আগেও এই সুদের হার ছিল ১২-১৪ শতাংশ। বর্তমানে তা নেমে এসেছে ৫ শতাংশে। খাদ্যপণ্যের বর্তমান মূল্যস্ফীতিও এর চেয়ে বেশি, ৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ফলে বিপাকে পড়েছেন সুদ আয়নির্ভর অল্প আয়ের গ্রাহকেরা। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আমানতের সুদ হার আর না কমানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঋণের সুদের হার কমাতে খেলাপি ঋণ কমানোসহ ব্যবস্থাপনা দতা কমিয়ে আনতে বলা হয়েছে ওই নির্দেশনায়। সাবেক এ গর্ভনর বলেন, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের মূলধনের ওপর আঘাত আসছে। এর ফলে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার কমিয়ে দিচ্ছে। অনেক ব্যাংক নতুন নতুন মাশুল আদায় করে আয় সমন্বয়ের চেষ্টা করছে। নতুন গ্রাহকেরাও ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমানত ও ঋণ উভয় েেত্রই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে খেলাপি ঋণ। যার প্রভাব পড়ছে পুরো অর্থনীতিতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২০১৬ সাল শেষে হয়েছে ৩১ হাজার ২৫ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের শেষে ব্যাংক ৬টির খেলাপি ঋণ ছিল ২৩ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। ২০১৫ সাল শেষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৮ হাজার ১০০ কোটি টাকা, গত বছর শেষে তা বেড়ে হয়েছে ১০ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। জনতার খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ২২৪ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের ৩৯টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ গত বছর শেষে হয়েছে ২৩ হাজার ৫৭ কোটি। ২০১৫ সাল শেষে তা ছিল ২০ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। বিদেশি ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা, ২০১৫ সাল শেষে যা ছিল ১ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ২ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এখন ৫ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। ২০১৫ সাল শেষে তা ছিল ৪ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বছরের শেষ সময়ে সব ব্যাংকই খেলাপি ঋণ নিয়মিত করেছে। এ সময়ে নগদ আদায়ও ভালো হয়েছে। ফলে খেলাপি ঋণ সেপ্টেম্বরের তুলনায় কিছুটা কমেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, পুনর্গঠন ও পুনঃ তফসিল করা ঋণ আবারও খেলাপি হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া নতুন করে নেওয়া ঋণও আদায় করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে এখনো অনিয়ম চলছে। এ ছাড়া বিশেষ ব্যবস্থায় পুনর্গঠন করা ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের কয়েকটি খেলাপি হয়ে পড়েছে। এ কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে জোরালো উদ্যোগ প্রয়োজন। বর্তমানে খেলাপি ঋণের ধাক্কা সামলিয়ে ব্যাংকের পে ওপরে ওঠা কঠিন হয়ে পড়েছে। অপর দিকে দেশে ুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে বিতরণ করা ঋণের ২৩ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে। এ খাতে বিতরণ করা হয়েছে ১ লাখ ৭২ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের বড় অংশই সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর। এ হিসাব গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। হিসাব মতে, সরকারি ব্যাংকগুলোর ৩০ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ১১ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকগুলো ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা ঋণের খেলাপি ৭৯৯ কোটি টাকা এবং বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর ১ লাখ ৩২ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা ঋণের খেলাপি ১০ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৬ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৫৫৫ কোটি টাকা। এদিকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাবে দেখা গেছে, এসএমই ঋণের বড় অংশ গেছে ব্যবসা খাতে। ২০১৬ সালে বিতরণ হওয়া ঋণের মধ্যে ব্যবসা খাতে গেছে ৯০ হাজার ৫৪৮ কোটি। সারা দেশের ৫ লাখ ১৭ হাজার ২৯৯ প্রতিষ্ঠান এ ঋণ পেয়েছে। শিল্প খাতের ৬৪ হাজার ১২৫ প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে ৩৫ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা ঋণ। আর সেবা খাতে দেওয়া হয়েছে ১৬ হাজার ২১৯ কোটি টাকা, বিভিন্ন অঞ্চলের ৫৩ হাজার ১৫০ প্রতিষ্ঠানকে এ ঋণ দেওয়া হয়েছে।সংশ্লিষ্ঠ সুত্র মতে, গত বছর সারা দেশের ৬ লাখ ৩৪ হাজার ৫৭৪ জন উদ্যোক্তা ঋণ পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৫৪৮ জন নতুন উদ্যোক্তা। এসব উদ্যোক্তা পেয়েছেন ২৩ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকার ঋণ। তবে একজন সাবেক ব্যাংকার ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদের মতে, বর্তমান বাংলাদেশের আর্থিক খাত দৈন্যদশায়। শৃঙ্খলার বড় অভাব। আর তার প্রধান কারণ ব্যাংকিং খাতে মন্দঋণ। ঋণের বিরাট অংশ আবার কতিপয় পরিবার বা ব্যবসায়ী গ্রুপের কাছে কুগিত। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে মন্দঋণের প্রধান কারণ: ঋণ ঝুঁকি পর্যালোচনা ও ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা। অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাব। নেতৃস্থানীয় পদে দুর্বল লোকদের নিয়োগ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারির অপর্যাপ্ততা এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব বা রাজনৈতিক ভাবে দুষ্টের লালন আর শিষ্টের দমন। তাহার মতে,আশির দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশে কাসিফাইড লোনের বিষয়টি আলোচনায় আসে। কিছুকাল পর ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ বিষয়টিরও যাত্রা। এটি শুরু হয় আপত্কালীন সময়ে বিশেষ একটি খাতকে দুর্যোগ থেকে রা করার উদ্দেশ্যে। সাধারণত উদ্যোক্তাকে দুঃসময়ে টিকিয়ে রাখতেই এ ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের ব্যবস্থা করা হতো।
আর্ন্তজাতিক কিংবা অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক দুঃসময়ে একটি বিশেষ খাত কিংবা গোষ্ঠীকে বিশেষ ব্যাংকিং সুবিধা দিতে ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ সুবিধা দেয় বিভিন্ন দেশ। অতীতে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, চলতি ঋণ কিংবা মেয়াদি ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ করা হয়েছে। আমাদের ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, অনেক উদ্যোক্তার নিজেদের পুঁজি ছিল না। তারা চলতি মূলধন অথবা ঋণ সংগ্রহ করেছেন বিভিন্ন ব্যাংক থেকে। পরবর্তীকালে এ চলতি মূলধন কিংবা ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি এবং সেটাকে ব্যবসায় প্রাথমিক পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এমন প্রবণতা ভারতসহ অন্যান্য বিকাশমান দেশ যেমন ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান কিংবা সিঙ্গাপুরেও দেখা যায়। এমনকি উত্তর আমেরিকার দেশগুলোয়ও এ অবস্থা ছিল একসময়। চলতি ঋণ পরবর্তীকালে ইন্সটলমেন্ট লোনে রূপান্তর করে কিংবা ব্লকড অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে ধীরে ধীরে পরিশোধ করেছেন উদ্যোক্তারা।
সামপ্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক উত্থান-পতনে বিভিন্ন খাত ও ব্যক্তি বিপদে পড়েছে। এখন তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার। আগে এর নাম ছিল রি-শিডিউলিং। বলা হতো, আমরা চাই না পাঁচ বছরের বেশি কোনো ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ হোক। শর্ত থাকত মরিটরিয়াম পিরিয়ড কখনো ছয় মাস বা এক বছরের বেশি হতে পারবে না। এর ভালো দিক ভোগ করেছেন সামান্য ক’জন ব্যবসায়ী। অধুনা একটি নির্দেশে অবশ্য বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের আগের কোনো ঋণকে পুনঃতফসিলীকরণ করা যাবে না।
সেখানে এও বলা হয় যে, ২০১৩ সালের রাজনৈতিক সহিংসতায় তিগ্রস্তদের এ সুযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু কিছু েেত্র আমরা এর অপব্যবহার দেখেছি। যারা প্রকৃত অর্থে তিগ্রস্থ হয়েছিল, তাদের বেশির ভাগই এ সুযোগ পায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। যে খাত বা ব্যক্তির সুযোগ পাওয়ার কথা, তারা পায়নি। বলতে দ্বিধা নেই, দুর্বল সুশাসন, প্রভাবশালীদের দৌরাত্য এবং রাজনৈতিক পপাতিত্বের কারণে এটা হয়েছে। এ শুধু বাংলাদেশের চিত্র নয়। পার্শ্ববর্তী ভারত কিংবা পাকিস্থানেও একই অবস্থা দেখা যায়।
২০০২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ভারতের ‘করপোরেট রিস্ট্রাকচারিং’ গাইড লাইনের আলোকে তা করার সময় এটি স্পষ্ট হয়েছিল যে, ঋণ পুনঃতফসিলীকরণকে দীর্ঘ সময়ে কার্যকর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যাচ্ছে না। প্রয়োজন বেইলআউট। অনেক ব্যবসায়ী আটকে গেছেন। দুর্বল সিকিউরিটি, দুর্বল ব্যবসায়িক পদ্ধতি, ব্যবসায়িক অসামঞ্জস্য, আমদানিকৃত পণ্যের েেত্র লাভবান না হওয়াসহ নানা কারণে তিগ্রস্ত হয়েছেন তারা। ঋণের শর্তগত দুর্বলতার কারণেও অনেক েেত্র এমনটা হয়েছে। দেখা গেছে, কোনো বিনিয়োগে ঋণ পরিশোধে সময় লাগবে পাঁচ বছর, কিন্তু ব্যাংকের শর্ত ছিল তিন বছরে তা পরিশোধ করতে হবে। সেেেত্র ঋণগ্রহীতা শর্ত মেনে ঋণ নিয়েছে প্রয়োজনের তাগিদে। কারণ টাকা দরকার ছিল জরুরি ভিত্তিতে। পরবর্তীকালে দেখা গেল, পাঁচ বছরের নিচে টাকা আসা সম্ভব নয়। অবকাঠামো উন্নয়নের কথাই বিবেচনায় নেওয়া যাক। এসব প্রকল্পে ব্রেক ইভেনে আসতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। এমনকি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে লেগে যায় কয়েক বছর। তখন ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। বিভিন্ন দেশের আলোকে ইন্টারনাল ক্যাশ জেনারেশনের ভিত্তিতে অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ নগদ অর্থ প্রবাহের ওপর ভিত্তি করে ব্যবসায়ীদের ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়ার দাবি উঠতে থাকে। চীন, ভারত, মেক্সিকো এমনকি ইউরোপের গ্রিস, পর্তুগাল, ইতালির মতো দেশগুলোতেও অভ্যন্তরীণ নগদ প্রবাহ বিবেচনা করা হয় ঋণ পুনর্গঠনের সময়। পুনঃতফসিলীকরণের সময় নয়। প্রস্তাব করা হলো, প্রতিষ্ঠিত চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে কোম্পানিগুলোর স্থায়ী-অস্থায়ী সম্পদ ও নগদ অর্থপ্রবাহের জরিপ করা হোক। কেননা দেখা যাচ্ছে, বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঋণের অর্থ অন্যান্য খাতেও বিনিয়োগ করেছে। এক খাতের কথা বলে ভিন্ন খাতে বিনিয়োগের ঘটনাও ঘটেছে। ব্যাংকঋণের অর্থে জমি কিনেছে কিংবা ভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করেছে অথবা ব্যাংক ব্যবসা শুরু করেছে। এটা শুধু নতুন নয়টি ব্যাংকের েেত্রই হয়েছে, তা নয়। ১৯৮২ সালে যখন প্রথম প্রাইভেট ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়া হয়, তখনো হয়েছে। ১৯৯৫ সালেও হয়েছে। এগুলো আমাদের দুর্বল ঋণ ব্যবস্থাপনার একটি উদাহরণ। পত্রিকান্তরে খবর বেরিয়েছিল, আলোচ্য ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধার ফলে ৩৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী উপকৃত হচ্ছে। যাদের অনেকেরই নানা সমস্যা রয়েছে। তারা তাদের গৃহীত ঋণের উদ্দেশ্য প্রমাণে সম হয়েছে বটে; তবে তাদের কারণে কতক নৈতিক স্খলনও দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে যারা ভোগ্যপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত পণ্য আমদানি-রফতানির সঙ্গে জড়িত। তাদের অনেকেই বছরে ৫ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা লেনদেন করছেন। তাদের অনেকেই আবার নামে-বেনামে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরও মালিক। তারা বিভিন্ন নামে নিজ ও অন্যান্য ব্যাংকের টাকা নিয়ে কোম্পানির কষ্ট কমিয়ে আনতে পারছেন। বাজারে এভাবেই কৃত্রিম সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এ প্রতিযোগিতায় প্রকৃত ব্যবসায়ীরা তিগ্রস্থ হচ্ছেন। যারা আর্ন্তজাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চাইছেন, তারাও তিগ্রস্থ হচ্ছেন।
আরেকটি নৈতিক স্খলনের দিক হলো, আমরা বেশিরভাগ েেত্র তাদেরকেই ঋণ পুনর্গঠনে সাহায্য করেছি। যাদের সে যোগ্যতা বা উপযুক্ততা ছিল না। এদের অনেকেই প্রভাব খাটিয়ে নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছে এবং প্রস্তাবিত খাতে বিনিয়োগ করেনি। টাকা বিদেশে পাচার করছে। ঋণের টাকা দিয়ে স্থায়ী সম্পদ বানিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংককে অর্থ পরিশোধ করেনি। তারা ঋণখেলাপি হলেও বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে তাদের বিচার নিশ্চিত হয়নি।
তৃতীয় নৈতিক স্খলন হলো, সরকারের ওপর একটি প্রেসার গ্রুপ আছে। যারা ‘প্রশাসনভিত্তিক সরকার’ পরিচালনা করতে সহায়তা করছে। সরকারও তাদের হাতে রাখার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে, নৈতিক কিংবা কিছুটা অনৈতিক উপায়ে তাদের হাতে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনরকে বলতে শুনেছি। তিনি এসব বড় প্রতিষ্ঠান এবং গোষ্ঠীর চাপে আছেন। আমরা এ অবস্থা দেখতে চাই না। প্রশ্ন উঠছে, তবে কি আমরা ঋণখেলাপিদের প্রণোদনা দিচ্ছি? যদি তা দেই, তাহলে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। এেেত্র বাংলাদেশের কিছু বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এ সুবিধা পাচ্ছে এবং তারা সংশ্লিষ্ঠ ব্যবস্থাকে অনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। অবশিষ্ট ব্যবসায়ীদের কাছে আমাদের কী নির্দেশনা থাকবে?
দারিদ্র্য বিমোচনে বিনিয়োগ। কর্মসংস্থান এবং দারিদ্র্য নিরসন মডেলকে বাস্তবায়ন করতেই হবে। তবে এটা করতে গিয়ে আমরা যেন বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর কাছে নতজানু না হই। সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংকিং টুলসকে সমুন্নত রাখতে হবে। ব্যাংককে ব্যাংকিং অস্ত্র ব্যবহার করার সুযোগ দিতে হবে। এেেত্র প্রশ্ন উঠছে, সোনালী ব্যাংক কেন হলমার্ক কেলেঙ্কারির সময় ব্যাংকিং টুলস না ব্যবহার করে গেল দুদকের কাছে। তারা কেন হলমার্কের সঙ্গে আলোচনা করল না? স্থায়ী সম্পদ, নগদ অর্থের প্রবাহ ও আর্থিক লেনদেন বিবেচনাপূর্বক ডাউনপেমেন্ট নির্ধারণ কেন করা হলো না? হলমার্কের ঋণ অবশ্যই পুনর্গঠন করা যেত।
মাঠপর্যায়ে পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঋণের বিপরীতে কোনো সিকিউরিটি নেই। ঋণ পুনর্বিন্যাস করতে গিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। একই ব্যবসায়ীর কিছু ব্যাংকে সিকিউরিটি বেশি রয়েছে। আবার কিছু ব্যাংকে কম। এটিও অ্যাডজাস্ট করা যাচ্ছে না। যাদের অতিরিক্ত সিকিউরিটি আছে, তারা আবার ভাগাভাগি করতে চান না। ব্যবসায়ী বা ঋণগ্রহীতারা সম্পদ বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে চাইছেন না। কারণ জমির বা তার কেনা সম্পত্তির মূল্য এখন কমে গেছে বা তারা ভবিষ্যতে আরো দাম বাড়ার আশায় অপো করছেন। তৃতীয় আরেকটি সমস্যা হলো, অনেকে নন-কোর ব্যবসার দায়িত্ব দিয়েছেন আত্মীয়দের। তারা এখন সেটি ছাড়তে চাইছেন না। আবার চালাতেও পারছেন না। চতুর্থ সমস্যা হলো, ব্যবসায়িক উত্তরাধিকার। বর্তমান উদ্যোক্তা মারা গেলে কে ব্যবসার হাল ধরবেন? অনেক বড় বড় কোম্পানির েেত্র এ দুশ্চিন্তা রয়েছে। কোম্পানিগুলো মূলত একক ব্যক্তিনির্ভর হয়ে পড়ছে।
একটা সময় লালবাগের হাঁসমার্কা নারকেল তেলের বেশ প্রচলন ছিল। তারা কিন্তু ম্যারিকোর ‘প্যারাসুট’ কিংবা স্কয়ারের ‘জুঁই’-এর কাছে প্রতিযোগিতায় হেরে গেছে। এটি হয়তো তাদের ব্যবসায়িক ব্যর্থতা নয়। সামাজিক বিবর্তনে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তাল মেলাতে পারেনি আধুনিক বিপণন ব্যবস্থার সঙ্গে। এমনকি নিত্যনতুন কৌশলের সঙ্গে। এভাবে অন্য অনেক ব্যবসাও হারিয়ে গেছে। এসব দিক বিবেচনায় বলতে হয়, ঋণ পুনর্গঠনের জন্য সুশাসন এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করাও প্রয়োজন। সেেেত্র সঠিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঋণ পাচ্ছে কিনা, তা নিশ্চিত করতে হবে। ঋণ সঠিক খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে কিনা, তাও নিশ্চিত করা জরুরি। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে আরো কঠোর হতে হবে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু অর্থ মন্ত্রণালয় বা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দায়ী করলে মূল সমস্যাটি অনালোচিত থেকে যাবে। আমাদের কেউ কেউ অবশ্যই বাণিজ্য-বান্ধব কৃষিব্যাংক বা কৃষক-বান্ধব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিণতি ভুলে যাননি।
লেখক: গবেষক ও কলামিষ্ট
০১৬১১৫৭৯২৬৭
0 comments:
Post a Comment