Wednesday, April 19, 2017

টিপাইবাঁধ ঃ হুমকির মুখে পড়বে দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ-প্রাণবৈচিত্র্য



টিপাইবাঁধ ঃ হুমকির মুখে পড়বে দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ-প্রাণবৈচিত্র্য 
আলী ফোরকান 
ভারতের উত্তরাঞ্চলের বরাক নদী। এ নদীর অববাহিকায় টিপাইবাঁধ। এ বাঁধ বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ-প্রাণবৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। এতে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা অববাহিকার সমৃদ্ধ সভ্যতা। আন্তর্জাতিক আইনানুসারে উজানের কোনো দেশ ভাটির দেশের সঙ্গে আলোচনা না করে উজানে বাঁধ-ড্যাম-ব্যারাজ নির্মাণ করে নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করতে পারে না। টিপাইমুখ বাঁধ শুধু বাংলাদেশ নয় ভারতের উত্তরাঞ্চলে ও এর তির প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর উৎসস্থল ভারতের মনিপুর রাজ্যের চুরাচাঁদপুর জেলায় ১৯৯০ সালে প্রথম টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় ভারত সরকার। ৪ কোটি রুপি ব্যয়ে সেখানে বাঁধ নির্মাণ করে ১৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদন মতাসম্পন্ন একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে চায় ভারত। এ ল্েয ১৯৯৬ সালে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের অধীন টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বা¯Íবায়নের কাজ পায় নিপকো কোম্পানি। প্রথমদিকে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রাপ্তিতে কিছুটা সমস্যা হয়। কিন্তু ২০০৮ সালের ২৪ অক্টোবর টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণে নিপকোকে পরিবেশগত ছাড়পত্রসহ কারিগরি সকল কাজ সম্পন্ন করার নির্দেশ দেয়া হয়। আগামী ২০১২ সাল নাগাদ এ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। জনগুরুত্বপূর্ণ এবং বাংলাদেশের জন্য হুমকির কারণ হয়ে ওঠা টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ প্রসঙ্গে ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য শুরু থেকেই দাবি জানিয়ে আসছেন দেশের সর্ব¯Íরের মানুষ।  টিপাইমুখ বাঁধ’র বিরুপ প্রতিক্রিয়া এখনই উভয় দেশের মানুষকে অবগত করতে হবে। সেই সঙ্গে সঠিক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে দু’দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ আন্দোলন করে ড্যাম নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। কেউ কেউ বলেন, আন্তর্জাতিক মহলের মাধ্যমে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এই ড্যাম বন্ধ করতে হবে। টিপাইমুখ ড্যাম/ব্যারাজ সম্পর্কে সরকারের অজ্ঞতা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন দেশের বিভিন্ন শ্রেনীর মানুষ। সরকারের এখন আর বসে থাকার সময় নেই। সরকারের করণীয় হচ্ছে ভারত সরকারের কাছে টিপাইমুখ ড্যামের প্রকৃত অবস্থা জানতে চাওয়া। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলেন, বিশ্বের কোথায় কি ঘটনা ঘটছে- পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে যে-কেউ ইন্টারনেট সার্চ করে জেনে নিতে পারে- সেেেত্র টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণের বর্তমান অবস্থা জানাটা সরকারের জন্য কঠিন কোনো কাজ নয়। অথচ আমরা এখনও জানি না টিপাইমুখে আসলে কি হচ্ছে। বরাক নদীর ওপর টিপাইমুখে বাঁধ নির্মিত হলে এক রকম প্রভাব পড়বে। ড্যাম নির্মাণ হলে অন্যরকম। আবার ব্যারাজ নির্মিত হলে প্রভাব হবে ভিন্ন ধরনের। কিন্তু আমরা এখনও জানি না টিপাইমুখে ভারত কি করতে যাচ্ছে। স্থাপনা ৩টি ব্যাখ্যা করে বলেন, নদীর পানি-বান-বন্যা থেকে গ্রাম-শহর-জনপদ-ফসল রার জন্য মাটি দিয়ে বাঁধ দেয়া হয়। যা ইংরেজিতে বলা হয় 'ঊসনধহশসবহঃ' 'উধস' বা অন্য জিনিস। ড্যাম পাহাড়ের বেষ্টনীর ভেতর জলাধার। যেমন কাপ্তাই ড্যাম। ব্যারাজ বা ইধৎৎরধমব. এটাতে শুকনো মৌসুমে ব্যবহারের জন্য পানি ধরে রাখার একটি ব্যবস্থা। যেমন তি¯Íা ব্যারাজ। তিনটি স্থাপনা যেমন ভিন্ন তেমনি প্রকৃতির ওপর এর প্রতিক্রিয়াও ভিন্ন। কিন্তু আমরা এখনো জানি না টিপাইমুখে আসলে কি হচ্ছে। ভারতের দুটো ‘ভার্সন’ রয়েছে টিপাইমুখ সম্পর্কে। এক নম্বর বক্তব্য হচ্ছে, টিপাইমুখে ড্যাম ও জলাধার নির্মাণ করে ভারত জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। এতে বাংলাদেশের কোনো তি হবে না। আরেকটিতে বলা হচ্ছে, টিপাইমুখের ভাটিতে (১০০ কিলোমিটার) একটি ব্যারাজ তৈরি করে তাতে বর্ষার পানি আটকে রেখে পরে শুকনো মৌসুমে ফসল উৎপাদনে সেচের জন্য ব্যবহার করবে। ড্যাম ও জলাধার নির্মাণ করা হলে শীতের মৌসুমে বেশি পানি আসবে। বর্ষায় কম আসবে। ফলে সিলেট অঞ্চলের বি¯Íীর্ণ শস্যভ‚মি তলিয়ে যাবে। বদলে যাবে পরিবেশ-প্রতিবেশ। আবার শীতকালে বাংলাদেশে কম পানি আসবে। শস্য উৎপাদনে সমস্যা হবে। এ মুহূর্তে সরকারের করণীয় হচ্ছে টিপাইমুখে কি হচ্ছে সেটা ভারতের কাছে জানতে চাওয়া। দু’দেশের মধ্যে কোনো বিরোধ থাকলে সেটা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। এ ল্েয ‘টেকনিক্যালী’ সঠিক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের জনমত তৈরি করতে হবে। টিপাইমুখে ড্যাম নির্মাণ করে ভারত জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করবে, একথা আমাদের বিশ্বাস হয় না। আমাদের ধারণা ওরা আরো কিছু করছে। কৃষি জমিতে সেচের জন্য ব্যারাজ নির্মাণ করছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে।  ওরা কি করছে সেটা সরকারকে জানতে হবে। প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য সরকারকে ভারতের কাছে দাবি জানাতে হবে। সেই সঙ্গে বিষয়টিকে সার্কে তুলতে হবে। আন্তর্জাতিক ফোরামকেও ব্যবহার করতে হবে। বিশ্বের অনেক অঞ্চলেই অভিন্ন নদীর পানি সমঝোতার মাধ্যমে ব্যবহার করছে নদী অববাহিকার দেশগুলো। চীনের মেকং নদী, যুক্তরাষ্ট্রের কলরাডো নদী, পাকি¯Íানের সিন্ধু নদের পানি চুক্তির মাধ্যমে ওই অঞ্চলের ৭টি দেশে ব্যাবহার করছে। ওইসব দেশ আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে পানিসম্পদ ব্যবহার করার চুক্তি করে শান্তিতে বসবাস করছে। তাহলে আমরা কেন পারব না? অভিন্ন নদীর ওপর ভারত একক সিদ্ধান্তে একের পর এক ড্যাম নির্মাণ করে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিকভাবে দুর্বল করে দিতে চাইছে। রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করার জন্যই এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে। নইলে জাতীয় স্বার্থে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ কেন হতে পারে না। অভিন্ন নদীর ন্যায্য পানির হিস্যা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য শুধু ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন চুক্তি করলে চলবে না আঞ্চলিক পানি চুক্তি করতে হবে। টিপাইমুখে ড্যাম বা ব্যারাজ বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিশাল জনপদ বিপন্ন হয়ে যাবে। কৃষি ভ‚মি, মাছের প্রজনন ভ‚মি নষ্ট হয়ে যাবে। টিপাইমুখে ড্যাম বা ব্যারাজ বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সুপেয় পানি বলে কিছু থাকবে না। সাহারা মরুভ‚মিতে পরিণত হবে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে, প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ টন কৃষি শস্যের তি হবে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ করতে হলে আঞ্চলিক পানি চুক্তি করা দরকার এবং সেটা জাতিসংঘের দায়িত্বে করতে হবে। সেই সঙ্গে জাতীয় সংসদে পানির ভয়াবহ অবস্থা তুলে ধরতে হবে। বর্তমান সরকারের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক রয়েছে। সেটা কাজে লাগিয়ে ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে হবে। ইসরাইল, আরব, পাকি¯Íান ও ভারতের মত চিরশত্রæ দেশের মধ্যেও যৌথ নদীর পানি বণ্টনের চুক্তি রয়েছে। তবে আশার কথা দেশের সরকারিদল ও বিরোধীদল উভয়েই টিপাইমুখ পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিএনপি ইতোমধ্যে তাদের ৬ সদস্যের একটি তালিকা প্রধান মন্ত্রীর কাছে প্রেরণ করেছেন। নামের তালিকার সাথে েিরাধী দলীয় নেত্রী টিপাইমুখ পরিদর্শনে বিএনপি’র প্রতিনিধি দলকে সহযোগিতার জন্য প্রধান মন্ত্রীকে অনুরোধ জানান। আমরা আশাকরি  টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে সরকারের ক‚টনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা জরুরি। পাশাপাশি দলমত নির্বিশেষে টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে দেশের স্বার্থে সবাইকে এক মত পোষণ করা উচিৎ। অন্যথায় বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ-প্রাণবৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। যা হাজার বছরেও কাটিয়ে উঠা সম্ভব নয়।(বিদ্র: লেখাটি দৈনিক নয়াদিগন্তে ২০০৭ সালে প্রকাশিত) অনেক পাঠকের অনুরোধে অন লাইন বøগে পোস্ট দিলাম। আপনাদের প্রয়োজন টা আশাকরি মেটাতে পারবেন।

লেখক: গবেষক 
মোবাইলঃ০১৬১১-৫৭৯২৬৭






0 comments:

Post a Comment