মাদকের নেপথ্যে- বাড়ছে অপরাধ
আলী ফোরকান
উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাওয়া খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ডের নেপথ্য অনুসন্ধানে প্রায়ই বেরিয়ে আসছে মাদকাসক্তির কাহিনী। বিশেষ করে তরুণ-যুবক শ্রেণির অপরাধীদের সিংহভাগই মাদকাসক্ত। মাদকদ্রব্য সহজলভ্য হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে জড়িয়ে পড়ছে।
তরুণ-তরুণীরা নেশায় জড়িয়ে লিপ্ত হচ্ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। নেশার টাকা জোগাড় করতে অনেকে খুন, চাঁদাবাজি, ছিনতাই এবং অপহরণের মতো অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।
নেশার কারণে বিবেক-বুদ্ধি লোপ পাওয়ায় মাদকাসক্তরা যেকোনো অপরাধ করতে দ্বিধা করে না। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোয় প্রায় ১২ হাজার ৩০৪ জন মাদকাসক্ত চিকিৎসা নিচ্ছেন। যাদের বড় একটি অংশ ইয়াবা ট্যাবলেটে আসক্ত। এছাড়া অনেকেই আসক্ত গাঁজা, হেরোইন এবং ফেনসিডিলসহ অন্যান্য মাদ্রকদ্রব্যে।
পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে দিন দিন ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। আসক্ত তরুণ-তরুণীরা অধিকাংশ উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ইয়াবা পরিবহন ও সেবন তুলনামূলক নিরাপদ হওয়ায় এর আসক্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিশেজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে এখন মাদকাসক্তের সংখ্যা অন্তত ৫০ লাখ।
গোয়ান্দা পুলিশের তথ্যমতে, ঢাকায় ইয়াবা ব্যবসায় কমপক্ষে ২০টি চক্র সক্রিয়। এই ইয়াবা প্রধানত মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার এবং টেকনাফ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এরপর সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে তা ছড়িয়ে দেয়। মাদক ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট এতই শক্তিশালী যে এদের আটক করেও তেমন ফায়দা হয় না। কিছুদিনের ব্যবধানে তারা ছাড়া পেয়ে যায়।
মাদক ব্যবসায়ী ম্যানিলা চৌধুরীকে দু’বছর আগে ঢাকা থেকে ১৭ হাজার পিস ইয়াবাসহ আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। তার ছয় মাসের জেল হয়। জেল থেকে বের হয়ে সে আবারও ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। তথ্যানুসন্ধানি প্রকাশিত রির্পোটে জানা যায়, মাদক ব্যবসার সঙ্গে বর্তমানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ জড়িত। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের জড়িত থাকার তথ্যও রয়েছে গোয়ান্দাদের কাছে। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের মূল টার্গেট উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা।
গোয়ান্দাদের তথ্যমতে, একটি সেলফোনের কভারের মধ্যে কমপক্ষে ৩০০ পিস ইয়াবা পরিবহন করা যায়। ট্যাবলেট হওয়ায় কেউ সন্দেহও করে না। ইয়াবা বিভিন্ন রঙ এবং ফ্লেভারে পাওয়া যায়। এর বিক্রি এবং সেবন উভয়ই সহজ। ফলে মাদকাসক্ত তরুণরা এখন ইয়াবার দিকেই বেশি ঝুঁকছে।
পাইকারি এক পিস ইয়াবার দাম ৩০০ টাকা হলেও, খুচরা প্রকারভেদে -৫০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পরিবহন এবং সেবন সহজ হওয়ায় রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে দ্রুত এটি ছড়িয়ে পড়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের অভিজাত এলাকাগুলোতে ইয়াবা তরুণ-তরুণীদের মানিব্যাগে স্থান করে নেয়। এখন এ নেশাদ্রব্য ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানীর অলিগলির মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েদের মাঝেও। নেশা গ্রহণকারীদের তালিকায় স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে, ব্যবসায়ী, গ্লামার জগতের বাসিন্দা থেকে শুরু করে গৃহবধূ পর্যন্ত রয়েছে। ইয়াবার পাশাপাশি অনেক তরুণ-তরুণী হিরোইন এবং ফেনসিডিল সেবন করছে।
মাদকের অর্থ জোগাড় করতে নেশাগ্রস্ত অনেকেই ছিনতাই, অপহরণ এবং খুনের মতো অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। আর এসব কাজে বাধা দিলে মাদকাসক্তরা নিজের মা-বাবা এবং আত্মীয় স্বজনকেও খুন করতে দ্বিধা করে না।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোয়েন্দা বিভাগের উপ-পরিচালক জানান, এখন মাদকাসক্তের শতকরা ২৫ ভাগই ইয়াবা আসক্ত। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে সারা দেশ থেকে এক লাখ ২৫ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করেছে। এর বাইরে র্যাব, পুলিশ এবং সীমান্ত এলাকায় বিজিবি এর আরও তিনগুণ ইয়াবা আটক করেছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের বিশেজ্ঞরা জানান, ইয়াবায় উত্তেজক এম সিটামিন এবং ক্যাফেইন রয়েছে। তাই ইয়াবা আসক্তরা শেষ পর্যন্ত মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে যেতে পারেন। এছাড়া যৌনক্ষমতা হ্রাস, মস্তিষ্ক ও কিডনির ক্ষতি এবং স্বাভাবিক কাজকর্মের ক্ষমতাও নষ্ট করে দেয় ইয়াবা।
বিশেজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, তাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসা মাদকাসক্তদের অধিকাংশই ইয়াবায় আসক্ত। আসক্তরা সাধারণত সাময়িক উত্তেজনার জন্য ইয়াবা গ্রহণ করে। বন্ধু-বান্ধবের দেওয়া পার্টিতে ইয়াবা সেবনের ব্যবস্থা থাকে বলেও জানা যায়।
বিশেজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, এর বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। তেমনি চোরাচালান বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
0 comments:
Post a Comment