মাদক ও টেলিভিশন
আলী ফোরকান
আজকাল শহরাঞ্চলে তো বটেই। গ্রামাঞ্চলেও প্রায় বাড়িতে বাড়িতে টেলিভিশন রয়েছে। এসব টিভিতে প্রতি সপ্তাহে থাকে বিভিন্ন পরিবেশনা। থাকে খেলাধুলা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, নাটক, সিনেমা ও টেলিসিরিয়াল। ফাঁকে ফাঁকে থাকে বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন। এ দিকে ক্যাবল লাইনের সুবাদে দেশ বিদেশের ৬০-৭০টি চ্যানেলের নানা অনুষ্ঠান দেখনো হয়। প্রতিদিনই কোনো না কোনো চ্যানেলে দেখানো হয় ছবি। শুক্রবারে বাডিতে সবাই মোটামুটি অবসর থাকেন। এ দিন নানা চ্যানেলে ছবি দেখার জন্য অনেকেই আগ্রহী। ধরা যাক, আপনি সপ্তাহে একটি সিনেমা দেখলেন। তা হলে মাসে ক’টা হলো। চারটি। বছরে? ৫২টি। ধরে নিলাম আপনার অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। তা হলে একই ঘরে আপনি আপনার স্ত্রী, ছেলেমেয়, বাবা-মা, ভাইবোনদের সাথে স্থূল শরীরী নাচের কুৎসিত দৃশ্য, প্রৌঢ মুখশ্রীসম্পন্ন নায়কদের যন্ত্রণাদায়ক নৃত্য, স্বল্পবসনা নায়িকাদের আদিম উল্লাসÑ সব কিছু সম্মিলিতভাবে দেখতে বাধ্য। বাডির শিশুটি হয়তো কেজি ওয়ান বা টুর শিক্ষার্থী। সে শতাধিক মাদক গ্রহণ ও খুন আর ধর্ষণ দৃশ্য দেখছে আপনার কাছে বসেই। যে হিসাবটি দেয়া হলো, তা শুধু এক বছরের। শিশুটির বয়স যদি হয় সাত কিংবা আট বছর তা হলে সে ঠিক কতটা অমানবিক দৃশ্য দেখার দর্শক হলো? প্রতিটি দৃশ্য কি তার সরল শৈশবের স্নায়ুকে ক্ষতবিক্ষত করছে না? প্রতিটি যৌনদৃশ্য কি তাকে রোগাক্রান্ত করে তুলছে না? শৈশবে এটুকু বয়সেই তার মনের গহিন প্রদেশে কি জন্ম নিচ্ছে না অজ্ঞাত অপরাধবোধ? অসুস্থ, অস্বাভাবকি মনোবিকলনের শিকার হয়ে বেডে উঠছে যে বিষবৃক্ষ। সে আমার আপনার প্রিয়, অতি প্রিয় স্নেহের সন্তান। টিভি সেটের ক্রেতা আপনি, মাসে মাসে কয়েক শ’ টাকা তুলে দিচ্ছেন ক্যাবল মালিকদের কাছে; কিন্তু এর বিনিময়ে কী পাচ্ছেন? বিজ্ঞজনের লেখায় পাই, ‘বর্তমান বিশ্বে প্রচারমাধ্যম পরমাণু বোমার চেয়ে শক্তিশালী। বোমাতো কেবল ধ্বংস করে, মানুষ মারে; কিন্তু প্রচারমাধ্যম মানুষকে দখল করে নেয়। সে যেমন চায়, মানুষকে তেমনিভাবে ভাবায়। হাঁটায়, বলায়, খাওয়ায়, স্বপ্ন দেখায়।’ এক সমীক্ষায় প্রকাশ, সত্তর বছরের এক বৃদ্ধ ইংরেজ জীবনের ১২টি বছর টিভি দেখতে ব্যয় করেছেন। আমেরিকার একটি পরিবার তাদের জীবদ্দশায় এক-চতুর্থাংশ সময় টিভির সামনে বসে কাটিয়েছে। জাপানের ৯৫ শতাংশ পরিবারই নিয়মিত টিভির দর্শক। ফ্রান্সে ৮৮ শতাংশ মানুষের অবসরের বেশির ভাগ দখল করে রাখে টিভি। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল আর্ন্তজাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব। এর সমাপ্তি অনুষ্ঠানে তদানীন্তন তথ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, টিভি মাধ্যমগুলোর সর্বগ্রাসী অগ্রগতি অচিরেই পৃথিবীকে শয়তানের হাতে দেবে। তার মতে, পশ্চিমা দেশগুলোতে পাঁচ থেকে পনেরো বছর বয়সী শিশু-কিশোরেরা সিনেমা ও টিভির বদৌলতে ইতোমধ্যে চল্লিশ হাজার ধর্ষণ ও পঞ্চাশ হাজার হত্যাকান্ডের সাক্ষী। ফ্রান্সের কালচার অ্যান্ড কমিউনিকেশন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রী জাক লাং বলেন, ‘সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর জাতীয় সংস্কৃতি ও নৈতিক মূল্যবোধের বৈশিষ্ট্যকে ভয়াবহভাবে বিষাক্ত করা হচ্ছে সাংস্কৃতিক এ ধারার প্রচারের মধ্য দিয়ে।’ সম্ভবত ১৯৮০ সালে পাবলিক ওপিনিয়নে পোলের মাধ্যমে চাঞ্চল্যকর তথ্য জনসমক্ষে এসেছিল। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় দর্শকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, আগের সপ্তাহে টিভি সিরিয়ালের বিজ্ঞাপ্তিত পণ্যসামগ্রীর মধ্যে কোনগুলো তাদের মনে আছে? বেশির ভাগ দর্শকই মার্কিন বহুজাতিক সংস্থার পণ্যের নাম বলেছিলেন। কেউ কেউ অন্য কিছু। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তাদের স্মরণে থাকা পণ্যসামগ্রীর প্রথম ১০টির তালিকায় একটিও নিজের দেশের বস্তু ছিল না। আগের শিশুটির কথায় ফিরে যাই। জানাচ্ছেন বাংলাদেশের একজন নাট্যব্যক্তিত্ব ‘আমাদের সমাজের ছোটরা সোল্লাসে টেলিভিশনের অমর সিরিয়াাল ও সুনির্বাচিত সিনেমায় বোধ হয় প্রতি পনেরো মিনিটে পাঁচটি খুনের দৃশ্য দেখে। এ ছাডা আরো কিছু হত্যার সাথে থাকতে হয় তাদের। যেমন দৃষ্টি দিয়ে খুন, কথা দিয়ে খুন, উপেক্ষা দিয়ে খুন। এ ছোটদের দাদা-দাদী তারা যে সামাজিক জন্তু। তাদেরও যৌনজীবনের প্রয়োজন আছে। তারা তা জানতেন; কিন্তু তারা বা তাদের পূর্বপুরুষেরা একই সাথে ‘ভালোবাসা’ নামের একটি বস্তু ও আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন; কিন্তু এখন সেসব সম্পূর্ণভাবে ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমাদের সমাজজীবনে অপরিহার্য হয়ে ওঠা টেলিভিশনের কল্যাণে একটা ১৩ বছরের ছেলে বা মেয়ে প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষভাবে যৌন আচরণকে উসকে দেয়া নৃত্যগীত দেখছে এবং সংশ্লিষ্ট সংলাপ শুনছে। দেখছে মাদক গ্রহণের দৃশ্য। ফলে গ্রামে-শহরে ১৪ বা ১৬ বছরের একটি ছেলে মাদক ও ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের চিন্তাভাবনায় আচ্ছন্ন ও প্রভাবিত হয়ে পডছে। বন্ধুত্ব করার ইচ্ছা সেখানে জোরালো নয়। আইনের শাস্থি থেকে বাঁচার জন্য মেয়েটিকে খুন করে বনে-জঙ্গলে অথবা পাট ক্ষেতে ফেলে দিয়ে শিস দিতে দিতে বন্ধুর বাডি যাওয়ার জন্য ট্রেন বা বাসে উঠে পডেছে। লিখছেন একজন পরিচালকÑ আপনি যখন মধ্যরাতের গভীরে স্ত্রীর সাথে টিভির সামনে বসবেন ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ আনসেনসর্ড ছবি দেখার জন্য। তখন আপনার সন্তান নাগালের মধ্যেই নিদ্রাতুর থাকবে। পাশের ঘরে থাকবেন আপনার ভাই, বোন, বাবা-মা। শিশুদের ঘুম ভাঙবে শৈশবের অমলিন সারল্যে; কিন্তু অতি ধীর সংক্রমণে আসক্ত হতে থাকবে সংগোপনে। আপনি কিভাবে দিনের আলোয় পুরনো সেই সম্ভ্রম, সেই অপত্য স্নেহ নিয়ে তাকাবেন আপনার সহোদরের দিকে? নৈতিকতার তর্জনী কি অধিকারে তুলে ধরবেন তাদের দিকে? অথচ অন্য ধারার সিনেমা কি আগে তৈরি হয়নি? এখনো কি হচ্ছে না? চিলির কথা বলি। এখানে যখন শ্রমিক বস্তিগুলো পরিণত হচ্ছিল বন্দিশিবিরে। সন্ত্রাসে ডুবে যাচ্ছিল গোটা দেশ। কোকাকোলা আর ডিসকো কালচারে পচে যাচ্ছিল সমগ্র জাতির রুচিবোধ। নিরস্ত্র চলচ্চিত্র শিল্পীরা তখন ‘সশস্ত্র’ হয়ে উঠলেন। পুলিশি খুনে বাহিনীর প্রহরা টপকে পৌঁছে গেলেন শ্রমিক বস্তিতে। সেলুলয়েডের ফিতে দিয়ে তারা বন্দী করলেন সীমাহীন শোকের বিস্ফোরণকে। বলিভিয়ান তামার খনিগুলো ছিল আমেরিকার ‘প্রভু’দের দখলে। শ্রমিকেরা দীর্ঘ শোষণের পর রুখে দাঁড়ালেন। অমানুষিক পুলিশি অত্যাচার চলল। কাছের পাহাডের আডাল থেকে ল্যাটিন আমেরিকান চলচ্চিত্রযোদ্ধা, বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান হারমান ছবি তুলতে থাকেন। এক সময় পুলিশের মেশিনগানের নল ঘুরে আসে ক্যামেরার দিকে। হারমান বুঝতে পারেন বিপদটা। তবু নড়েন না। মেশিনগানের প্রথম বুলেটটি লেন্স ভেঙে তার কপালে লাগার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত ধরা থাকে সে দৃশ্য। ক্যামেরায় চোখ রেখে একজন মানুষের দেহ অসংখ্য বুলেটের ঝাঁজরা হয়ে ধীরে ধীরে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। এ দৃশ্য ধরা পড়ে হারমানের পেছনে রাখা সহকর্মীর ক্যামেরায়। শিশুদের উপযুক্ত ছবিও তৈরি হচ্ছে। চলচ্চিত্রের সুস্থ, স্বাভাবিক, দায়বদ্ধ একটি প্রবল প্রবাহ আমাদের পাশেই বয়ে চলেছে; কিন্তু তার সংবাদ আমরা কেউই জানতে পারি না। জানতে দেওয়া হয় না। আমরা আশাকরি চলচিত্র ণির্মাতারা আগামী প্রজম্মকে মাদক ও সন্ত্রাস মুক্ত করতে চলচিত্র ণির্মাণে এগিয়ে আসবে।
0 comments:
Post a Comment