Tuesday, July 5, 2016

একজন আসুক

পাগলা হাওয়া ৪


একজন আসুক 

জোড় হাতের জীবন ঘুটুর। জোড় ধরে মা মরা দিন মজুর বাপের শিশু সন্তানের হাত জোড় করা ছাড়া আর কি থাকে? বাপের দূর সম্পর্কের ফুফুর কাছে জোড় হাত করেই আশ্রয় পেয়েছিলো। বয়স বাড়ার সাথে সাথে দুহাত সবল হলেও জীবনের বুঝ অবুঝের টানাপোড়নে এ সংসারই তার আপন হয়ে  গেছে। 
ফসল কেটে নেয়া পাথারে নাড়া পোড়া ধূঁয়ো ওঠা শীতের বিষন্ন সন্ধ্যা। পাথার ভাগ করা সাপজিঙে নদীর উপরে উড়ছে দল বাধা বাদুড়ের ঝাঁক।  কোহেলিয়া নদীর পানিতে ছোঁ মেরে সেরে তামাম দিনের তেষ্টা মিটাচ্ছে। পাথারের জন্তু জানোয়ার মানুষেরা এই নদীর পানিতেই পিয়াস মিটায়। সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা মানুষ গরু ছাগলের দূরাগত অস্ফুট হাক ডাক বয়ে নিয়ে হিমালয় থেকে শীতের বাও আসছে চিমটি কাটতে কাটতে। রাত যত বাড়বে ততই জোরে হামলে পড়বে জটি বুড়ির থোকড়া কাঁথার উপর। তুলে রাখা শাড়ি ব্লাউজের মত একটা পোশাকী নাম জটি বুড়িরও ছিল। তুলে রাখার মত শাড়ি ব্লাউজের  দিন যেদিন গত হয়েছে সেদিন থেকে নামটাও হারিয়ে গেছে। বুড়ির বয়স জট পাকিয়েছে নিন্দায় ও মাথার চুলে। মাথায় জটধারিণী বলে নাম হয়েছে জটি বুড়ি। বুড়ি তার যুবতী নাতনী নুরীকে ধোকড়ার তলে জড়িয়ে ধরে। নূরীর আচমকা ঠেলে ওঠা উঁচো বুক, নাচানো পাছা, পুরুষ্ট উরুতে হাতাতে হাতাতে তাকে আরও নিবিড় করে বুকের মধ্যে টেনে নেয় জটি বুড়ি। তার বয়সকালে যেমন নকশী কাঁথার ঢাকনায় তাকে চিপে পিষে শীত ঠেকাতে গরম নিংড়াতো এক ধুমসো জোয়ান। পাথারের উদোম মাথা তার বুড়ি হাড়ে কাঁপন তোলে রাতভর। বাইরের ঠান্ডাকে ঠেকানো আর ভিতরের গরমকে তাতানোর জন্য জটি বুড়ি হাড্ডিসার দেহে নুরীকে পেষে। সেই এড়ে মর্দটার মত কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে-মাগী চাপি আয় গে। 
কুঁকড়ে যাওয়া বুড়িকে বুকে চেপে ধরে তার মাথার উপর দিয়ে তাকায় নুরী। বাইরে শীতের ফ্কফকা জো¯œা। সামনের পাথারটা হা হা করে হাসছে। বারান্দা নামক স্থানটায় একটা প্রাণের অবস্থিতি তার অনুভবে তিরতির করছে। জীর্ণ কুঁড়ের ততোধিক জীর্ণ বারান্দায় ছালার বিছানায় কুকুর কুন্ডলী হয়ে শুয়ে শীত কামড়ে কোঁকায় ঘুটু। জটি বুড়ির ফোকলা দাঁতের ফিসফিসানি তার কানে আসে আর গরম হতে থাকে সে। পয়লা বানের পানিতে পুটি মাছের খেলার মতো নূরী খেলতে থাকে তার মনে। শীতের দিনে সরাসরি কড়া রোদের মধ্যে নাইলেও তা গা ঘেঁষে বসে থাকার ওম অনুভব করে সে। এতটুকু ওমই যথেষ্ট নয়, এমন শীতে আরও তাপ চাই, আরও গরম। 
ঘুটু কোমরের লুঙ্গির ভাঁজ উল্টিয়ে বিড়ি আর দেশলাই বের করে। দেশলাইয়ে একটা কাঠিই আছে। দুটো কাঠি সে চেয়ে নিয়েছিল সহ-যোগাল গোপালের কাছ হতে। এমন জমজমাট শীতে ঘটিকে ঘটিকে বিড়ির নেশা পায়। বিকেলে একটা কাঠি ফুরিয়েছে। শরীরটা কায়দা মাফিক কাত করে কাঠিটা ফস শব্দে জ্বালিয়ে বিড়িটা ধরালো সে যেনো বাতাসে কাঠিটা নিভে না যায়। বিকেলের আধ-খাওয়া বিড়িটা টেনে গরম হতে চায় সে। 
টেংরী ভাঙ্গা পাথারের মাঝখানে জটি বুড়ির ঐটুকুই ভিটে বাড়ি। সোওয়ামী ছিল ন্যাড়ার ফকির। মাঝ পাথারের নির্জন ভিটের ঘরেই গড়ে উঠেছিলো তার গাঁজা ভাঙ্গ আর ফকিরি সাধনার আসর। ফকিরের হক সম্পত্তি সাগরের ভাঙ্গনে গ্রাস হয়ে এইটুকুতে এসে ঠেকেছিল। ১৯৯১ সালের বন্যায় সংসারের দু’জন মরদ মানুষ, স্বামী ও জোয়ান ছেলে মরে গেল। তার আগে ছয়বার বিয়েও ঐ একজন আল্লাহর মাল টিকেছিল। বেঁচে রইলো সে, ছেলের বৌ আর সাত বছরের নাতনী। ছেলেরা বন্যার বানে মেয়ে রেখে চলে গেল। ঘুটু এসে এ সংসারে জুটেছিল তারও ছয় মাস আগে। তখন তার বয়স দশ কি এগারো। জটি বুড়ির ভিটে হতে নিকটের জনপদ, ধলঘাটা গ্রাম দেড় মাইল দূরে। এ পাথারের উত্তর-পশ্চিম জুড়ে বিশাল বিল। পূর্বে কোহেলিয়া নদী ।পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর দুই কিশোর-কিশোরীকে নিয়ে পাথারে গরুর গোবর কুঁড়িয়ে ঘসি, ধানের মৌসুমে ইঁদুরের গর্তের ধান সংগ্রহ, বিলের পানিতে মাছ ধরে, ফাঁদ পেতে ডা’ক, বক, বালি হাঁস আটকে, কলমী, কচুশাক, শাপলা শালুক কুড়িয়ে, জীবন চালায়। জীবন কত লড়াই–য়ে। বেঁচেই যায়। শুধু বেঁচেই যায় না, দিন কাল বছরের পরিক্রমায় জটি বুড়ি দিন দিন বুড়ো হয়, নুরী আর কুঁই কুঁই করা চ্যাংড়া ঘুটুর বয়সের ছোঁয়ায় ফনফনিয়ে ওঠা যৌবন পায়। 
ঘুটু এখন প্রতিদিন পাথার পেরিয়ে ধলঘাটা হাটে যায়। মাটি কাটা, লবণ মাঠে যোগাল দেয়া, নদীর তীরে ভিড়ানো নৌকার মাল খালাস, বোঝাই করা, যে কাজ পায় তাই করে। তবু সবদিন কাজ জোটে না। মজুরী যা জোটে তাই দিয়েই কেনাকাটা করে। কোনদিন জটি বুড়ি আর নুরীর সংগ্রহ করা শাকপাতা আর শাপলা শালুক হাটে বসে বেচে। ডাক বক বালিহাঁস ধরতে পারলে কথাই নেই। ধলঘাটার বড়লোকের পাড়ায় হাঁক দিয়ে ফেরে। ভাল দামে বেচে। ধলঘাটার পাথারের মাঝখানে সেই অচিন গাছ। রাতে বারোয়ারী পাখির আশ্রয়। দিনের আলো ফুটতেই উড়াল, কে কোথায় যায় কেউ জানে না। তবে গাছের আশেপাশে দেখা যায় না কাউকে। ঘুটুর জীবনও তেমনি। কুটিক বেনা বেরিয়ে পড়া-সন্ধ্যা রাতে আশ্রয়ে ফেরা। এক সময় নিজে বেঁচে থাকা ছাড়া প্রিয় বস্তু আর কিছুই ছিল না জীবনে। এখন প্রিয় থেকে প্রিয়তর হয়ে উঠেছে আর একটি জীবন। নুরীকে দিয়ে ঘুটুকে টেনে রাখতে চায় জটি বুড়ি। কিন্তু নুরীর উপর কবিজ আলগা করতে চায়না বুড়ি। চোখে চোখে রাখে। নুরী যদি ঘুটুর চটের তলে ঢোকে তাহলে তার ঝুরঝুরে হাড়ে তাপ যোগাবে কে? বাপ মায়ের সাকিন ঠিকানা ভুলে যাওয়া ঘুটু নুরীর দেহের আগুনের আঁচের আশে দারুণ জারেও জটি বুড়ির ভাঙ্গা কুঁড়ের বারান্দায় রাত কাটায়। বুড়ি আর কতদিন? তারপর তো নুরী আর সে। 
এমন শীত এক যুগ পড়ে নি। মাঘের শীতে বাঘ মরে। সন্ধ্যা নামতে নামতেই সেজে গুঁজে উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম থেকে হামাগুড়ি, দিতে থাকে, রাত যত বাড়তে থাকে ততই দৌড়াতে দৌড়াতে হামলিয়ে পড়ে। কাটা ধানের ক্ষেত হতে প্রতিদিন এক পাঁজা করে নাড়া তুলে রাখে ওরা। নাড়াও আজকাল যোগানো কঠিন। নাড়াতো নাড়া, ধান গাছের মোথা পর্যন্ত তুলে নিয়ে যায় মানুষেরা। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে নাড়ার আগুন ঘিরে বসে শরীর তাতায়, শীত তাড়ায়। তামাম রাত তো এভাবে বসে থাকা যায় না। রাতে যা জোটে খাওয়া দাওয়া শেষে আর একদফা আগুনের ওম নিয়ে শুতে যেতেই হয়। শীতের সন্ধ্যা রাতে আগুনের পাশে বসে সুখ দুঃখের কাহিনী আর চুটকি চাটকি কথা, এর চেয়ে আমেজের আসর আর নেই তিনটি মানুষের জীবনে। নুরী আর ঘুটুর জীবনের ইতিহাস নেই তেমন নয়, তবে তার ঊষাকাল। জটি বুড়ির জীবন তার মাথার জটের মতো জট পাকানো। দেহের হাড়-হাড্ডির মতো পুরানো। রিনরিনে সুখের। কনকনে ব্যথার। চোখ ভেঙ্গে ঘুম না আসা পর্যন্ত বুড়ি নাড়ার আগুনে বসে সেই বার্তাই নাড়াচাড়া করে। জটি বুড়ির চোখ ফাঁকি দিয়ে চোখাচোখি করার লোভেন্তুরী কাঁচা নাড়া ঠেলে দেয় আগুনের দিকে। কাঁচা নাড়া তাপের চেয়ে ধূঁয়ো ছড়ায় বেশি। একেতো বুড়ি চোখে কম দেখে তারপর ধূঁয়োর পর্দা ভেদ করে তার দৃষ্টি চলে না। চোখ জ্বালা করে পানি ঝরে। সেই মওকায় ওরা চোখে চোখে হাসে। ইশারায় কথা বলে। মনের টগবগিতে এক সময় ফিক করে হেসে ফেলে। জটি বুড়ির চোখ গ্যাছে, কান ঠিক আছে। সরেস আছে মাথা। সে মুখ খিস্তি করে বলে- মাগী মরদে ধূয়া ঠেলিস ক্যানেরে? 
নিশাচর কোয়াক পাখি কোয়াক কোয়াক আওয়াজ তুলে উড়ে যায়। অচিন গাছের আশ্রয়ে কূঁড়া পাখি শীতের দাপটে টানা টানা তীব্র স্বরে ডেকে ওঠে রাতের প্রহরে প্রহরে। শীতের কামড়ে বিলের পানিতে বরফ জমা হাল, এমন জার ঠান্ডায় পানিতে নেমে মাছ কাঁকড়া ধরে খাবার জো নেই। উদোম পাথারে ক্ষুধার্ত শিয়াল কাঁদে দল বেঁধে। খ্যাক খ্যাক আওয়াজ তুলে হুটোপুটি করে। আলো আধারীতে দৃষ্টি ফেলে ঘুটু বলে-শালা শালীরা গরম হবার চাইছে। 
নূরী বলে-আগুন পাবো কই? 
শরীরে আগুন আছে। দুনহো জনে আঁটো সাঁটো হলেই- 
-ঐ জ্যামনা জানোয়ারের গাওত আগুন থাকে? 
- রহে দাদী রহে। রাইতেত নুরীর গাওর আগুনত তুমার হাড্ডি ছ্যাক্ লাগে। 
ঘুটুর কথা অস্বীকার করতে পারে না  জটি বুড়ি। কিন্তু তার ভয় এ আগুন যদি দখল করে নেয় ঘুটু তাহলে সে বাঁচকে কি করে? নুরী বলে-দাদীর গুঁদরী (কাঁথা) ওশাড়ে খাটো। আঁটোসাঁটো করি না শুইলে আটিবে না। 
-দাদো বাঁচি রহিলে ঐখান গুদরীর নীচতই-
জটি বুড়ি আগুন খোঁচাবার পেন্টিখানা ঘুটুর মুখ বরাবর তুলে ধরে বলে-মর্দা তোর মুখত্ আমি দাগ দে দিম।
বুড়ি যদি খোঁচা দিয়েই বসে সেই আশঙ্কায় সরে বসে ঘুটু বলে- দাগ দিবার চাহিসতো দেইস। কিন্তু জেইঠে সেইঠে খোচাখুচি করি আগুন নিবাই ফেলাইসনা। যতখন জ্বলে ততখন পোহান ভালা। 
-ঠিকই বলিছিস ভাই। আগুনের ত্যাজ থাককে থাকতে পোহায়া নিলে ভাল। ত্যাজ কমিলে খালি ধূয়া করে হায়। 
নুরীর দেহে তখন তেজের আগুন, গনগনে। ঘুটুর দেহেও। এমন আগুনে দেহে শীত কম। জটি বুড়ির বয়স তার দেহের আগুন কেড়ে নিয়েছে কবে। তার দেহের আগুনের তেজে সে ওম দিতে গিয়ে অনেকের মনই পুড়িয়েছে। ঠিক যেন হনুমানের ল্যাজের আগুনে সোনার লঙ্গা পোড়ানোর ঘটনা। এমন আগুনে মেয়েছেলেকে নিয়ে ঘর বাঁধতে চায়নি কেউ। তাই সম্পন্ন ঘরের মেয়ের জীবনে জুটলো ধলঘাটা গ্রামের পাথারের নেড়ার ফকির কিতাবউদ্দিন, কেতু শাহ। এখন বয়সের ভারে কোমর পড়ে গেছে। গাটে গাটে বাত ধরেছে। ফিক্ ব্যথা পাঁজরে। বুকে ভর করেছে শ্বাসকষ্টের রোগে। শীত যত বাড়ে উপসর্গ এবং প্রকোপ তত বাড়ে। আজ সপ্তাহ ধরেই বাঘ মারা শীত পড়েছে। শীতের দাপটে সেই আকাশের গায়ে দেখা পাহাড় পর্বত হতে জন্তু জানোয়ার ভেগে আসছে সমতলে। এমন শীতে মোষের শিং নড়ে, বুড়ো-বুড়ি মরে। ধোঁকড়া কাঁথায় শীত কুলোয় না। সারা রাত শীতের ছোবলে কোঁকাতে কোঁকাতো নাতনীর নরম দেহের গরম নিংড়ে নিতে চায় সে। 
শেষ রাত হতেই গরু আর মোষের গাড়ি চলে, শীতের পাথার ভেঙ্গে এপাড় ওপাড় বন্দর, গঞ্জ, হাটের পানে। ধলঘাটার পাথার ঘিরে আছে সাপমারাড়েইল ঘাট, মহুরীঘোনাহাট, সুতুরিয়া বাজার। তেজারতির পণ্য নিয়ে রাত পোহাতে পোহাতেই দূরের হাটে পাড়ি জমাতে হবে। শীত-গ্রীষ্মে এই রীতি। রাতে নরম দেহের গরম বিছানা ছেড়ে গিয়ে ঘুমহীন শীত তাড়ানো কন্ঠে গাড়িয়াল গেয়ে ওঠে। উদোম পাথারের প্রান্তরে কন্ঠ ছড়িয়ে পড়ে- 
যদি গাড়িয়াল যাইবার চান 
ঘাড়ের গামছা থুইয়া যানরে-
ওহকি গাড়িয়াল-
তার সাথে গরুমোষ তাড়ানোর হ্যাঁট-হ্যাঁট-ডা-ডা, গাড়ির চাকার ক্যাঁচ ক্যাঁচ কু-কু শব্দ মিলে শীতের রাতের আবেশী পরিবেশে ঠান্ডা বাতাসে ভাসে ভাওয়াইয়া সুর-নিধূয়া পাথারে। এক সময় গাড়িয়াল আর গাড়িয়াল বৌ-এর বিরহী রাতের দুঃখে মন কাঁদতো জটি বুড়ির। এখন কাঁদে গাড়ি টানা অবলা জীবগুলোর কষ্টে। গানের সুরে যদি ঘুম ভাঙ্গে তাহলে আজকাল নুরীর মন আনচান করে। উসখুস করে ঘুটু। পরিবেশটা টুকরো টুকরো করে দিয়ে ঘড় ঘড় পো-পো আওয়াজ ভেসে আসে আচানক। রাতের নীরবতায় সকল আওয়াজের প্রচন্ডতা বাড়ে। সাগরের গর্জন বাড়ে। বয়স শুধু শক্তি সাহস কেড়ে নেয় না, ঘুমও কেড়ে নেয়। যে কোন শব্দেই তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। অচেনা শব্দে চমকে ওঠে জটি বুড়ি। ঘুমের ঘোরে আলগা হয়ে যাওয়া হাতে নুরীকে চেপে ধরে। উৎকন্ঠার কন্ঠে বলে-নুরীকে ঐখান কিসের শব্দ? 
ঘুটুর ঘুম ভাঙ্গে নি। সে জবাব দেয় না। ঘুটুর ছালার ঢাকানার তোয়াক্কা পাথারের বেয়াড়া শীত মোটেও করে না। তলের নাড়ার বিছানাও পাতলা। এমন ঠান্ডায় গায়ের ধোকড়া আর নিচের বিছানা জুতসই হলে যেমন ঘুমানো আরাম, খারাপ হলে তেমনি বেজুত। চোখে ঘুম থাকা সত্ত্বেও শীতের খোঁচানিতে তামাম রাতে ঘুটুর ঘুম গাঢ় হতে পারে নি। সে আধা ঘুমন্ত আধা জাগন্ত অবস্থায় জুটি বুড়ির আতঙ্কের কন্ঠ শুনলো। নিশুতি রাতের নিঃসীমতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে আওয়াজটা আসতে থাকলো। 
-ঐ নুরী বলিস না কেন ঐটা কিসের শব্দ? 
তবু নুরী নিরুত্তোর। 
-মাগী মরেছে। আমার ডর করছে। 
দাদীর চাপনের চোটে নুরী জেগে যায়। ততক্ষণে জবাব দেয় ঘুটু
-অ দাদী ভয়  পাচ্ছিস কেনরে, ঐখান সাগরে শব্দ। 
পুরোপুরি গন্ডগাঁও। নদীতে নাও, মাটিতে গরুমোষের গাড়ি, চুলি পালকি ছাড়া এ অঞ্চলের ঘরের বৌ-বেটিরা অন্য যানবাহন দেখেনি। ধলঘাটার পাথারের বুক ফেড়ে গরুর গাড়ির নিরিখের একটা পথ চলে গেছে ধলঘাটা হাটে। সেখান থেকে সাপমারারড়েইল ঘাট । সাপমারারড়েইল  আর ধলঘাটা পাথার পেরিয়ে উল্টো পথে মহুরীঘোনা বাজার । এগুলো কোনটা কত দূর, সেখানে কি সব তাজ্জব তাজ্জ্বব চিজ আছে সে সব জটি বুড়ি শুনেছে তার নেড়া ফকির স্বামীর কাছে। নুরী শুনেছে ঘুটুর কাছে। নুরী আর জটি বুড়ির দিন দুনিয়া ধলঘাটা পাথার আর দেড় মাইল দূরের সরিতলা গাওঁ। দুনিয়ায় চোখ ফুটেই দেখেছে নদীর পানি কেটে চলে নাও। পাথারের বুক চিরে নিরিখ কাটা পথে চলে গরুমোষের গাড়ি। অবশ্য পানির নৌকা খুব বড় বেশি একটা দেখে না। পাথারে বান ডাকলে তখন নৌকা চোখে পড়ে। ইদানিংকালে অবশ্য দু চাকার ক্রিং ক্রিং আওয়াজের গাড়ির পিছনে বোঝা চাপিয়ে দু চারজন মানুষ পাথারের পথে চলাচল করে। গরমের তাতানো দুপুরে পাথার পাড়ি দিতে ঘামে, তেষ্টায় হয়রানিতে একটু জিরিয়ে নিতে, এক কাতরা পানি খেতে দু চাকার চালকদের দুচারজন গাড়িসহ জটি বুড়ির ভিটেয় আসে। জটি বুড়ির বাড়ি যেন সরাইখানা। যারা আসে তাদের মধ্যে কাদু ফড়িয়া একজন। কাদু আগে ঘোড়ার খেপ দিত। এখন সাইকেল ঠেলে। পিছনের ক্যারিয়ারে, মাঝের রডের সাথে মাল বেঁধে ঠেলে নিয়ে যায়। কাদুর ঘোড়াটা মাঝ পাথারে সর্দি গর্মি আটকে পড়ে গিয়ে মরে গেছে। অমন ক্ষতির কথা কাদু আর ভাবতে পারে না। তাই সাইকেল কিনেছে সে। সেই সাইকেলে চড়ে, ঠেলে কাদু ফুড়িয়া নিয়মিত আসে। নুরী বড় ছটফটে। কাদুর সাইকেল নিয়ে তার ছেলেমির অন্ত নেই। কাদুও ভাব দেখায় যেন ওখানা ওর জন্যই কিনেছে। আসা যাওয়ায় পরিচয়টা একটু ঘন হওয়ায় কাদু ফড়িয়া চুলের ফিতে, কাচের চুড়ি, সস্তাদামের লিপস্টিক এসব নিয়ে আসে। জটি বুড়ি থাকলে বের করে না। বুড়ি চোখের আড়াল হলে এগুলো নুরীর হাতে গুঁজে দেবার ছলে হাত চেপে ধরে। বুকে টেনে নেবার চেষ্টা করে। কাদু চুপি চুপি এসে সাইকেলখানা পিপুলটি গাছের গায়ে হেলান দিয়ে রেখে কুড়ের দরজায় উঁকি দেয়। পরখ করে কে কে আছে কুড়েতে। নুরী একা থাকলে হুট করে বুকে গিয়ে গা ঘেসে বসে পড়ে। নীলা হাত ধরবার আগেই সে কুঁড়ের বাইরে এসে দাঁড়ায়। ছলবল করতে করতে গিয়ে সাইকেলের বেল ক্রিং ক্রিং একটানা বাজায়। বেল শুনে আশপাশ হতে জটি বুড়ি উঁচু গলায় বলে-কাদু ফড়িয়া তুই বস। আমি আসছি । 
এমন মওকাটা মাঠে মারা যাওয়ায় কাদু ফড়িয়া গোম্বায় মনে মনে গর্জন করে। কিন্তু নূরীর দিকে ¯েœময় দৃষ্টি তুলে ধরে বলে-তুই কিচ্ছু ন-বঝোস নীলা। 
নীলা একটানা হাসে, একটানা বাজায়। হাসির মোহ, বাজনার বিরক্তি দুটোই সামলাতে চেষ্টা করে কাদু মনে মনে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে চায়। নুরীকে পেড়ে ফেলবে না। ঐ কোমড়পড়া, নজরহারা গেটে বাতের বুড়ি কি করবে? কিন্তু ভয় ঐ শালা শাবল হাতি ঘুটুকে। ধারে কাছে কোথাও যদি থেকে থাকে। ঘুটু হাজির থাকলেতো কথাই নেই। এনামেলের চটা ওঠা বাটিতে এক বাটি পানি খেয়ে ভেগে যায় সে। জটি বুড়ি লম্বাপাড়ির জীবনে এমন ফিচেল কম দেখলো না। এমন ফেটে বাড়িতে একজন জোয়ান মর্দ দরকার। বুড়ী তাই দরদ ¯েœহ দিয়েই ঘুটুকে ধরে রাখতে চায়। ঘুটু সরল বলিষ্ঠ এ বুঝ ঘুটু নিজেও বোঝে। সহজ ঘুটুকে ভয় ফচকে ফড়িয়ার। কাদু মনে মনে দুই পা এগোয় আর আড়াই পা পিছোয়। আধা পায়ের দূরত্ব সে একদিন দূর করবেই। এই স্বপ্নেই তার ঘন ঘন যাওয়া আসা। বুড়ীর কন্ঠস্বর শুনেই সে বড়সর মুখে ফাঁক আরও ওশাড় করে চওড়া হাসি হেসে উঁচু গলায় বলে-অ দাদী গো মেলাদিন  তোমার খবরাখবর জানি না। তাই খবরা খবর নিবার আসলাম। 
চোখ যাই হোক কান সজাগ জটি বুড়ি আসতে আসতে বলে- ক্যানেরে কাদু বৃহস্পতিবার আসিছিল, আজ দেওবার। 
নুরী বলে-বাড়ির বগলত নিড়ানি, ঘুরি ফিরি জিরানি। নুীরর চোখে দৃষ্টি ফুটিয়ে দিয়ে জটি বুড়িকে বলে কাদু ফড়িয়া-তোমার জন্যে মনটা খারাপ লাগে, তাই মুই ঘন ঘন আসি। 
ঝিলিক মেরে উঠে নুরী বলে-বুঝলি দাদী ফইড়া মিয়ার তোর মতো গুইল গুলা বুড়ির মুহব্বতোত পরানটা পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। 
রাগের জ্বালা আর উসকানির জ্বালা দুই জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে কাদু ফড়িয়া দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলে-ডবকা মাগী একবার  যদি হাতের মুঠোত পাই- 
নুরী আর বুড়ির অভিজ্ঞতায় এপথে হালকা বাহন ঘোড়া আর সাইকেল। সুতরাং ট্রাক যন্ত্র না জন্তু কিছুই তারা জানে না। সদ্য ঘুম জাগা আমেজি কন্ঠে নুরী বলে-টেরাক কয় কারে?
-ধান পাটোত, মালপত্তর উঠায়।
-এটা কত বিরাট জন্তু জানুয়ার। 
-জন্তু জানুয়ার নয় গে,-টে-রাক, কলে চলে। 
নিজের জ্ঞান গরিমায় নিজেই একটা তুষ্টি বোধ করে ঘুটু। 
-কেমন কলগে, দেওদানো, ভূতের মান্দি? 
-বহুৎ জোর গ্যাঁ-গ্যাঁ-গ্যাঁ করি হুড়মুড় করি চলে। 
ভয়ভয় কন্ঠেই জটি বুড়ি বলে-কেমন কল  দেশোত আসিল কেয়ামত চলি ওসিল। 
এত তাড়াতাড়ি কেয়ামত আসুক নুরী তা চায় না। সে বলে-কেয়ামত না হয়, কাল কালে কাল পালটিয়েছে। তোমার কালত চলি গেছে দাদী এ্যালা আমার কাইল-নয়া কাইল ওসিল।
তার কাল যে শেষ অনেক আগেই টের পেয়েছে জটি বুড়ি। এ বয়সে কিনা দেখলো। ট্রাকের জন্য সড়ক বানাতে হয়। উড়োজাহাজের জন্য সড়কের দরকার নেই। ধলঘাটার বুকের উপর দিয়ে ট্রাক আসার পথ তৈরির অনেক আগেই তার খোলা আসমানে উড়োজাহাজ উড়তে দেখেছে। প্রথম দিন উড়োজাহাজ দেখে, শব্দ শুনে ভয়ে বিস্ময়ে কেঁদেই ফেলেছিল। সে তার মুন্সী নানার কাছে শুনেছিল নমরুদ বাদশা শকুনের পিঠে সওয়ার হয়ে আসমান ফুড়ে উঠে আল্লাহর আরশে তীর মেরেছিল। কি দিন কাল এলো মানুষ আল্লাহর আরশ ফুটো করে কালের জাহাজ উড়ায়। আখেরী জামানার শেষ ওয়াক্ত। কেবল তার কেন ছুড়ি বুড়ি সবারই দিন শেষ। লাঠি ভর দিয়ে জটি বুড়ি ঠুকঠুক করে হাঁটে। কপালে হাত দিয়ে ঢাকনা বানিয়ে বাইরের আলো ঠেকিয়ে ক্ষয়ে যাওয়া চোখের আলো ভীক্ষু করে পথঘাট মানুষজন দেখে নেয়। আর দিন গোনে যে কোনদিন ইস্রাইল ফেরেস্তা শিঙ্গা ফুঁক দিতে পারে। বুক খালি করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুড়ী। ঐ রাতের আঁধারে মুখ দেখা যায় না। নিশ্বাসের সামান্য শব্দও শোনা যায়। বুড়ির নিশ্বাসের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ঘুটু বলে-ধলঘাটাসহ সারাদেশে আর বান হবে না। 
ঘুটুর কথায় প্রশ্ন করে নুরী-কেনরে? 
ধলঘাটার বোক ফোড়ে একখান সড়ক সিধা যায়ছে। পানি আসবে ক্যামন করে? 
-তালে প্যাঁচাবন্ধীর বিলোত পানি আসবেনি। 
- শুইন্নু পাথার আর পাথার রহিবেনি। 
-কেনরে? 
-কায় কায় নাকি সরকার পাথার বিল ডাকি নিছে। পানির কল, কলের লাঙ্গল আসিবে। ডাঙ্গা তওড়, জুড়ি হেনে আবাদ হবে। তার সাথে আছে ভূতবাত্তি। 
-ভূতবাত্তি? 
-আইযে ফুটুস করি জ্বলে, ফুটুস করি নেবে। 
-আচাইর্ব বেপার। 
জটি বুড়ি বলে। এতক্ষণ নূরী আর ঘুটুর সওয়াল জবাব শুনছিল-আর ভাবছিল সইবতো গেল, তবে আর রইলো কি? কেয়ামতের আগে এমনি করে ধীরে ধীরে সব জিনিস উঠে যাবে। আজব আজব ঘটনা ঘটবে। নূরীর কাছে কলের লাঙ্গল পানির কল কিছুই তাজ্জবের নয়। তার মনে অগ্রীম এক বেদনা ফুলে ফুলে উঠছে। বিলে যদি পানি না আসে তাহলে ড্যাপ শ্যালক, কলমি হবে না। মাছেরা ঘাই মারবেনা, ভেসে উঠবে না। ধবল বকেয়া দল বেঁধে পাখা মেলবে না। মাছ শিকারের জন্য গাছের ডালে ওত পেতে কূড়া পাখি, মাছরাঙ্গা বসে থাকবে না। শিয়াল খটাসের কাঁকড়া মাছ খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। সাঁতার কাটবে না পানকৌড়ি, বালিহাঁস, পুচ্ছ নাচিয়ে নাচিয়ে পোকা মাকড় খুঁজে খাবে না কাদা খোঁচা। পাখ-পাখালি বনের জন্তু পানি খাবে কোথায়? কাজের অবসরে নিধূয়া পাথারে এইসব দেখাই ছিল তার সাথের সাথী। মনের কোনে বেদনার ফোটা টসটাস করে জমতে থাকে। ক্ষেত খামারে ফসল না হলে কহড় পড়ে। খাল বিল নদী-নালা বন্ধ হলে পানির প্রাণীর কি হাল হবে? 
শিশু ও যুব সূর্য আর জটি বুড়ির কুড়ের মাঝখানে কোন আড়াল নেই। বয়স ভারে সূর্য অচিন গাছের আড়ালে নূয়ে পড়লে তখন ছায়া পড়ে কুড়ের প্রাঙ্গণে। আবার যাবার আগে ভেংচি কাটে কোনাকোনি ডালপালার আড়াল দিয়ে। লাল সূর্যের পয়লা রোশনাই আলোকিত করে কুড়েটা। শীতের এমন সাফ্ ভোরে উত্তর আকাশে তাকালে হিমালয়ের ঝকমকে চূড়া নজর কাড়ে। শীতের ঊষার নিবিড় কুয়াশা মিলিয়ে গিয়ে সরাসরি রোদ-পড়া বারান্দায় চোখে রোদের খেলায় ঘুম ভাঙ্গে ঘুটুর। ‘আজি এ প্রান্তে সূর্য ওঠা সফল হলো কার।’ ঘুটু রবিঠাকুর বোঝে না, হয়তো নামও শোনেনি। তবে দিনমানের বিশেষ ক্ষণের তিক্ততা মধুরতা বোঝে, অনুভব করে। চোখ মেলেই সে দেখলো কুড়ের সামনের নিকানো প্রাঙ্গণে মধুর রোদে ঝকঝকে কাঁসার থালার পানির আয়নায় মুখ রেখে বুকটা টান করে মাথাটা পিছনে হেলিয়ে কাঁকুই দিয়ে চুল আচড়াচ্ছে নূরী। চুলের অরণ্যে কাঁকুই চালানোর টান আর বসার ভঙ্গিতে নূরী নামক সদ্যফোটা তন্বী দেহের শতদল মেলে ধরেছে। মুহূর্তের দুর্লভ পাওনা তাকে মোহিত করে। পলকহীন নয়নে সে শুয়ে শুয়ে দেখে আর দেখে। লাল ফিতের পরিপাটি বিনুনি করে চোখ ফিরাতেই নূরী দেখে কেমন এক চোখের ভাষায় ঘুটু তাকিয়ে আছে। এ ভাষার প্রথম পাঠ বোঝার বয়স ছুঁড়েছে তাকে। বেশ কিছুদিন যাবৎ দুজনেই দুজনের মন নিয়ে টান পাড়াপাড়ির খেলাটা বোঝে। সে ফিক্ করে হেসে ফেলে। কুড়ের পিছন থেকে জটি বুড়ি আসতে আসতে বলে-অমর্দা ঘুমন ভাঙ্গিল, কাজোত যাবেনি? 
কাম আর কাম। জীবনের এমন মুহূর্তগুলোর গায়ে কেবল ধাক্কা মারে দায়িত্বে হাত। দাদী আসছে, নূরী উঠে পড়ে। চিকনাই নদী থেকে পানি আনতে হবে। ধোয়া মোছা, খাবার পানিও। পাথারের প্রাণীর ঐতো পানির উৎস। ঘুটু ও উঠে। সকালে গিয়ে নাম লেখাতে না পারলে ট্রাক গরুর গাড়ি হতে নৌকা, নৌকা হতে ট্রাক গরুর গাড়িতে মাল বোঝাইয়ের কাজটা ধরা যায় না। ঘাট শ্রমিক সমিতি হয়েছে। মাতব্বরেরা টাকায় ২০ পয়সা কাটে। তাও ভাল। অন্য কাজের নিশ্চয়তা নেই। নদীতে বাঁধ হচ্ছে। মাটি কাটার কাজ। একটানা রাতদিন কাজ চলছে। দবদবিয়ার বন্দর হতে উজানে দূরে। ও কাজে গেলে অতদূর থেকে প্রতিদিন ফেরা খুব কষ্টের। অনেক পথ হেঁটে আসতে হয়। তবে মজুরী ভাল। কাটাকাটি নেই। ঘাটের কাজ না পেলে ঐ কাজে যাবার কথা ভাবে ঘুটু। ঘুটু যখন বন্দরের পথে পা বাড়িয়েছিল তখন পাথারের সূর্যের গায়ে আবছা আবছা মেঘের ছায়া ছুঁয়ে যাচ্ছিল। এমন নিটোল শীতে কাল মেঘের আনাগোনা। 
কুড়ের প্রাঙ্গণ হতে যেদিকে তাকানো যায় পাথারের প্রান্ত দেখা যায়। ঘুটু যাচ্ছে, নূরী দেখছে। প্রতিদিনই তোতা যায় কিন্তু কোনদিনই সে এমন করে একটানা তাকিয়ে ওকে দেখেনি। আজ বড় দেখতে ইচ্ছে করছে। যাবার আগে জটি বুড়িকে ডেকে ঘুটু বলেছিল-আইজ বেজায় জার, গাঁও গতর কাঁপছে। সাও করি ফিরিম। 
-সাও করি ফিরিবি। একখান শুকান রুটি খায় গেলু। তুই আসিলে চুলা জালাম। 
ঐদিন ঘুটু আর ফেরেনি। পথ চেয়ে চেয়ে কি হলো ভেবে ভেবে শেষতক ওরা হেঁশেল ধরিয়েছিল। পরদিন হেঁশেলে আগুন জ্বালাবার সুযোগ হয়নি। দিন ফোটার সাথে সাথে আচানক মেঘ ধেয়ে এলো বাতাসে সওয়ার হয়ে। এমন মেঘ কোথায় ছিল ওত পেতে তা বুঝাবার আগেই সূর্য ডেকে ফেললো। বৃষ্টি শুরু হলো। দূরের গাঁও হতে যারা পাথারে এসেছিল আরও ভোরে তারা শীত বাতাস বৃষ্টির কামড়ে গরু বাছুর নিয়ে ছুটছে গাঁয়ের পথে। টুটা, ফাটা, বেড়ার ফাঁক ফোকড় দিয়ে বৃষ্টির ছটি এসে লাগে। বাতাস বয়ে যায় কখনো হু হু কান্না হা হা হাসি আর শোঁ শোঁ হুংকার তুলে। শীতের মৌসুমে এমন ঝড় বাদলের অভিজ্ঞতা জটি বুড়ির আছে। এমন দুর্যোগ শেষ যে বছর দেখেছে সে বছরে তার কোমড় পড়েনি। গাটে গাটে ব্যথা, পাঁজরে ফিকের টানা বুকে হাফানীর শ্লেষ্মা ভর করেনি। গাও গতর এমন সিটকে মারতে শুরু করেনি। গত কয়েক বছর ধরে জার শীত সে মোটেই সইতে পারছেনা। কাঁথা বালিশ ভিজে না যায় সামলাতে নূরী ব্যস্ত। বুড়ি সেদিকে তাকিয়ে বলে-নূরীগে গুদরী অর সিতান উত্তর দিগত সরহায় নেহেনে বিছানা করেক। 
-ক্যানেহে দাদী, বিছানা ক্যানেহে? 
- মোর হাড় হাড্ডি জমে যাচ্ছে। দাঁত কপাটি নাগে যাচ্ছে-শুতে পড়–। 
নিদ গিয়েছিল জটি বুড়ি। আবার তাকে উঠতে হয়েছে। বয়ে যাওয়া বাতাসের কোন ঠিক ঠিকানা নেই। এখন উত্তর থেকে বাতাস বয়ে আসছে। ঝাপটা বাতাস উত্তরের পর্বতের বরফ বাতাস ঝেটিয়ে নিয়ে আসছে। আকাশে সূর্যের অবস্থান কোথায় বোঝার জো নেই। তবে সময়ের মাপে অনুমিত হয়-আয়ু নিভু নিভু। উত্তরের বিছানা পশ্চিমে সরিয়ে নিতে অনুমান নির্ভর কন্ঠে নূরী বলে-ও দাদী সাঁঝ নাগি গেল। এলাই ঘুটু ভাই ফিরিল নাই। আর ভাল লাগেছে নাই। ভোক্ নাগেছে। 
চাল আটা যা ছিল আগের রাতেই শেষ। একখানা শুকনো রুটি বেঁচেছিল, সেটা চিবিয়েই ঘুটু চলে গেছে। ধোকড়া কাঁথার তলে ঢুকতে ঢুকতে দাঁতে কাঁপনি তুলে জটি বুড়ি বলে-জোয়ান হাড্ডিত তাও সয়। বুড়া হাড্ডিতে ভোক্ আর জার কত সয়। 
-নিদদাম আওদি হতিছে দাদী।
-এ্যামুন আওদিত (ঝড়বৃষ্টি) আর জারত্ নিদুয়া পাথার ভাঙ্গি চ্যাংড়াট। 
ওসিবে কিমন করি? 
এসবই বোঝে নূরী। বুড়ো হাড়ে শীত ক্ষুধা সহ্য হয় না তা ঠিক। কিন্তু জোয়ান হাড়ে ক্ষুধার খাকতি বেশি। বারবার কেবল ক্ষুধাই লাগে। এমন ঝড়বাদল শুরু না হলে মাছ ধরতে, লতাপাতা কুঁড়োতে বিলে যেত সে। উপায়হীন নীরবতায় সে বিছানা পেতে কাঁপুনে শরীরটাকে শুইয়ে দেয়। বুড়ির শরীরটায় আর কিছু নেই। এক সময় এ নারী দশাসই যুবতী ছিল। তাকে শুইয়ে দিয়ে কাঁথা দিয়ে ঢেকে দেয় নূরী। 
-ও নূরীগে জারতো সয়ছে নাগে। 
- সয়বে কি, মোরই সয়ছে নি। 
- জইমে গেইল গে? 
জটি বুড়ির দেহে মেয়াদী জ্বরের কাঁপন। নূরী উঠে গিয়ে ঘুটুর সেলাই করা ডবল ছালার ধোকড়াটা নিয়ে এসে বুড়ির দেহে চাপিয়ে দেয়। নিজেও তার তলে ঢুকে পড়ে। 
-ও নূরী মোর পায়ের নগুনোত্ চিমটি দে। 
নূরী বুড়ির পায়ের আঙ্গুলের মাথায় চিমটি কাটে। 
-কিরে, দেনা ক্যানে? 
- দিছু দাদী। 
-আরও জরোত দেনা ক্যানে? 
-এলায় এমুন চিমটি দিছি রক্ত বেরাইছে। 
-মুই কিছুই বুঝছোনা। 
-দাদী এমন জার আর কোন দিনত দেখো নাই। 
-এমন জার হয়েছে ঐতো তর দাদোর ফুপাত ভাই সেইবার জারোত মরি গেইছে। জাপ্টার ধর, জাপ্টায় ধর নাগে। 
নূরী দাদীকে চেপে ধরে শুয়ে পড়ে। ক্ষুধা শীতে জটি বুড়ি ধুকতে থাকে। নূরী প্রহর গোণে। রাত ঘনিয়ে আসে। একটানা বৃষ্টি বাতাস হিমালয়ের চুড়ায় জমা বরফের গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে বয়ে আসছে। শীত তীব্র হতে তীব্রতর হচ্ছে। এমন নির্মম বাস্তবতায় দাদীকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। কুপিটা যে জ্বালাবে তার উপায় নেই। ঘরে দেশলাই নেই। ঘুটুর নিয়ে আসার কথা ছিল। দেশলাই থাকলেই বা কি হতো, বাতাসের ঝাপটায় নিভে যেত। শীত ও বাতাসের সাথে জোট বেঁধেছে নিঃসীম আঁধার। ঝড়ো বাতাসে শোঁ শোঁ হুশিয়ারী। রাত কতো হলো? দাদী ঘুমিয়ে পড়েছে। ঝিম ধরা গতর আর মন নিয়ে এক সময় সেও নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ে। চমকে উঠে ঘুম ভাঙ্গলো শিয়ালের তীক্ষè চিৎকারে। একেবারে বারান্দায় উঠে এসেছে। শীত বৃষ্টির হাত হতে বাঁচার জন্য চালায় তলে আশ্রয় নিয়েছে। তাড়াতে মন চায়না। কিন্তু একটা শঙ্কা চেপে ধরে তাকে-যদি ভিতরে ঢুকে পড়ে। এমন ঠান্ডায় ক্ষেপে গিয়ে হামলাও করতে পারে। সে দাদীকে ডাকে-ও দাদী, দাদী-
জটি বুড়ির কোন রা নেই। আবার তাকে ডাকে নূরী। জটি বুড়ি তেমনি নীরব নিশ্চল। 
-অ মাগী মরেছো, এত ডাকেছু এলায় রাও করিছু না। ঠসা হই গেল? 
নূরী দাদীর শরীরে ধাক্কা দেয়। একি একেবারে কাঠ। চমকে ওঠে নূরী। হৃদয়ফাটা চিৎকারে ভেঙ্গে পড়ে নূরী-অ দাদী-অ-অ-দা-দী-গে-
নূরীর হৃদয়ফাটা চিৎকারে ভয় পেয়ে শিয়ালগুলো খ্যাক খ্যাক করে আওয়াজ তুলে দৌড়ায়। কাঁদতে কাঁদতে নূরীর হিক্কা ওঠে। এক সময় তার অনুভবে চটকা লাগে, এই দুর্যোগময় গভীর রাতে বিশাল নির্জন পাথারে লাশের পাশে সে একা। জীবন নিয়ে যে দেহ রমণীর জীবনহীন সে দেহ ভয়াভহ। বিশেষ করে এমন পরিবেশে। লাশ নিজে শোনা কিচ্ছে। বাহিনী তার মনে জটপাকাতে থাকে। সে সিটিয়ে যেতে থাকে। লাশের পাশে বসে না থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। প্রাণের ভয় এমনই অনুভব যে জীবনের ভাল মন্দ কাতরতা সবই ভুলিয়ে দেয়। সে শীত, ্ক্ষুধা, কান্না সবই ভুলে যায়। এতক্ষণ কান্নার ঝোঁকে তার পাশের কোন সাড়া শব্দ তারকানে আসছিল না। চারদিকে নানা পোকা-মাকড়ের তান বাজছে এমন সাওতার মাঝেও। সে তান, ছন্দ, স্বাভাবিক পরিবেশে কান ফেলে শুনতে ইচ্ছে করে। মনে ভয় ঢুকলে সেই শব্দই মানুষকে শঙ্কাতুর করে ফেলে। সে প্রতি মুহূর্তে একটা কিছু ঘটে যাবার শঙ্কাতুর মন নিয়ে কাঠ হয়ে বসে থাকে। 
বাতাসটা একটু কমলেও কাইতান থামার নাম নেই। কমে যাওয়া ঝাপটা মাঝে মাঝ বেড়ে যায়। পাথারের তামাম দেহ জুড়ে কি নিশ্চিদ্র আঁধার। পথ ঘাট, দিক দিগন্ত বুঝবার উপায় নেই। এমন পরিচিত পাথার দুষমনের রূপ নিয়ে তাকে গ্রাস করতে চাচ্ছে। এমন সাক্ষাৎ দুষমনের বুকে পা রেখে, দিশাহীন প্রান্তে পা রাখতেই বিহ্বল ভয়ে চিৎকার করে ওঠে নূরী। পায়ের উপর দিয়ে কি যেনো কিলবিল করে উঠলো। সাপ। দিশেহারা এক অনুভবে সে এক ঝটকায় পা টেনে নেয়। কিলবিলে প্রাণীটা ছিটকে পড়ে গেল। চেতনাহীনতা তাকে পুরোপুরি গ্রাস না করলেও সর্বগ্রাসী এক জড়তা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। অবশ অনুভবে সে বারান্দাতেই বসে পড়লো। 
এমন স্থবিরতার মধ্যে কতক্ষণ সে ছিল নিজেই বলতে পারবে না। এক সময় মনে হলো ভিজা মাটিতে রাখা তার হাত বেয়ে কি যেনো উঠছে। নিস্পৃহ দৃষ্টিতে সে হাতের দিকে তাকালো। ততক্ষণে রাত ফুরিয়েছে কিন্তু সূর্য দেখা যাচ্ছে না। তবে রাতের নিঃসীম আঁধার কেটে আবছা আলো ফুটে উঠেছে। সেই আঁধার আলোতে সে দেখলো তার চারপাশে জ্যাবজেবে ভিজে মাটি ফুড়ে উঠে আসা অসংখ্য কেঁচো এঁকেবেঁকে চলছে। তারই একটা হাত বেয়ে উঠেছে। ভয় নয়, কেমন একটা ঘৃণার শিরশিরে অনুভবে সে হাতটা ঝাকিয়ে কেঁচোটাকে ফেলে দেয়। দিন ফোটার সাথে সাথে রাতের বিভীষিকা কেটে যেতে থাকলো। সে কুড়ের ভিতর ঢুকে দাদীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। শুকনো হাড় জিরজিরে মুখখানা প্রচন্ড শীতের কামড়ে আরও কুঁচড়ে গেছে। কুঁচকানো চামড়ার ফাঁক দিয়ে দাঁতগুলো বেরিয়ে এসেছে। একটা অনুপম মমত্ববোধে আবার হৃদয় ঠেলে কান্না বেরিয়ে এলো, তবে প্রথম অনুভবের মতো হাউ মাউ করে নয়। দাদীর কাঁথাটা দিয়ে তার মুখটা ঢেকে দিয়ে সে পাশে বসে নীরবে কাঁদতে লাগলো। কতক্ষণ, সে হিসেবে তার নেই। তারপর এক সময় সে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। আলো তখন অনেক উজ্জ্বল। কিন্তু বৃষ্টি আর এলোমেলো বাতাস থামবার কোন লক্ষণ নেই। আশেপাশে দেখা গেলেও পাথারের দিগন্তের কোন চিহ্ন নেই মনে হয়। বৃষ্টি বাতাসের ঝাপসার ওপারে কোন এক অজানা রহস্যময় দুনিয়া লুকিয়ে আছে। ভয় শঙ্কা কমার সাথে সাথে সেই প্রচন্ড শীতের অনুভব আর মরে যাওয়া ক্ষুধার অবসতা তার শরীর ঘিরে নাচতে থাকে। সেকি দিনের আলোয় পাথারে পা রেখে দবদবিয়ার পথে হাঁটা দেবে? তা কি করে সম্ভব? আধা পথ যাবার আগেই জমে দাদীর সহযাত্রিণী হতে হবে। কিন্তু এমন বৃষ্টি করে কখন থামবে তাও তার জানা নেই। তাহলে কি মরে যাওয়া ক্ষুধা তাকে ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলবে? অবশ্য এমন তাগড়া দেহে তেমন অবস্থা সহজে আসবে না। তবুতো একটা কিছু মুখে দিতে হবে। বৃষ্টি বাতাস ধরলেই সে পাথারে পা রাখবেই।
নূরী অসহায় অবশ অবস্থায় গুটিসুুটি মেরে বসে রইলো। বসেই রইলো। বসে থাকতে থাকতে দেখলো সে বৃষ্টি বাতাস ধরে এসেছে, কিন্তু কেমন সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে আসছে। তবু তাকে যেতে হবে। সে চলে যাবার প্রস্তুতি নিতেই সামনে তাকিয়ে দেখলো সেই দুটো শেয়াল ক্ষুধার্ত চোখ জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে। সে চলে গেলেই দাদীর লাশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। পরিণতি চিন্তা করতে গিয়ে সে শিউরে ওঠে। ঐ দেহের অসীম মমতায় ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে সে। না এমন সে হতে দিতে পারে না। সে এখান থেকে নড়বে না যতক্ষণ দাদীর দেহটা মাটি চাপা দিতে না পারে। কিন্তু তা এমতাবস্থায় একা সম্ভব নয়। ফেলে যাওয়া চিন্তার বাইরে। রাত আসছে আসুক। এক রাততো কাটলো। এমন তীতে লাশ পচবে না। কিন্তু কতক্ষণ ঐ জানোয়ার দুটোর হাত হতে লাশটা বাঁচাতে পারবে? তার চাইতে বড় কথা এমন শীতে আর ক্ষুধার হামলায় তার নিজের তাগদ কতক্ষণ জিইয়ে রাখবে? সামনে আবার আঁধার নামছে। রাতের আঁধার সামনে রেখে সে ধরে যাওয়া বৃষ্টির সাফ হয়ে যাওয়া দিগন্তে তাকায়। দৃষ্টি তীক্ষè করে সে দেখে বিরান পাথারের দবদবিয়া বন্দরের প্রান্তে। কে যেনো আসছে। দ্রুতই আসছে। মনটায় তার এটা সাহস লাফিয়ে ওঠে। ঘুটুর প্রতি অসহায় অভিমান মরে যেতে থাকে তার। সে প্রচন্ড আবেগে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। কিন্তু ঘুটু কি? ঘুটু যদি না হয়? যেই হোক, আসুক। কেউ একজন আসুক। 

0 comments:

Post a Comment