মাদক- মূল্যবোধের অবক্ষয়
আলী ফোরকান
‘সমাজের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে মাদক নেই। পুলিশ ফেনসিডিল পান করছে। কতিপয় ডাক্তার অপারেশনে যাওয়ার আগে ফেনসিডিল সেবন করে যান। ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজনের কেউ না কেউ গাঁজা-ফেনসিডিল, ইয়াবার মতো মাদকে আসক্ত। মাদক এখন মহামারি আকার ধারণ করেছে। বলতে দ্বিধা নেই, মাদকদ্রব্যের বেশকিছু কুটির শিল্প আছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়।’
বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, পর্ণোগ্রাফির অবস্থা এতই খারাপ যে, লাখ লাখ পর্ণো সিডি এখন হাটবাজারে মুডি-মুড়কির মতো কিনতে হয়না। কিছু ওয়েব সাইট পর্ণো এখন অন লাইনে ফিরি বিতরণ করে। কিশোর-কিশোরী সমাজ আজ মাদক ও যৌন-ব্যভিচারে লিপ্ত। সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে। এর পাশাপাশি মাদক তো আছেই। বিশেষ বিশেষ সময়ে আইন শৃংখলা বাহিনীর আটক হয়। তবে সে টা খুবই নগন্য। প্রতিদিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। তার চেয়ে অধিক রয়ে যাচ্ছে ধরা চোয়ার বাইরে। তবে মাদকদ্রব্য নির্মূলে বিশেষ উদ্যোগ ও সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে। তবে কাজের কাজ হচ্ছে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক (হাসপাতাল) বলেন, সারাদেশে মাদক মহামারি আকার ধারণ করছে। যদি এখনই মাদকের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা না হয়, তাহলে আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে সামাজিক অবক্ষয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হবে, পারিবারিক কলহ, সন্তানের হাতে বাবা মায়ের খুন হওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পাবে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। মাদক বিশেষজ্ঞরা বলেন, এক সময় ইয়বাসহ বিভিন্ন মাদক সেবন উচ্চবিত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু হাতের নাগালে মাদক পাওয়ার কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত যুবক-যুবতীদের মধ্যেও মাদকের বিস্তার ঘটছে।
বাংলাদেশের মাদকের ইতিকথা: বাংলাদেশের মানুষ মাদকদ্রব্যের সঙ্গে কম বেশি পরিচিত থাকলেও এদেশে মাদকাসক্তির ব্যাপক প্রসার লক্ষ্য করা যায় স্বাধীনতা উত্তর সময়ে। অবস্থানগত দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রধান তিনটি আফিম ও আফিমজাত পণ্য উৎপাদনকারী অঞ্চলের কাছাকাছি একটি দেশ। ১৯১৭ সালে সমবায় ভিত্তিতে নওগাঁ জেলায় সর্বপ্রথম গাঁজার চাষ শুরু হয়। স্বাধীনতাপূর্ব কাল হতে বাংলাদেশে ছিল সীমিত সংখ্যক লাইসেন্সধারী আফিমসেবী। কিন্তু স্বাধীনতার পর গাঁজা ও মদের প্রচলন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৩-৮৪ সালের আগে আমাদের দেশের কেউ হেরোইন চিনত না। অথচ ব্যাপকভাবে হেরোইন চোরাচালান বৃদ্ধি ও বাংলাদেশে তার বাজারজাত করণের ফলে ৮৫-৮৬ সাল থেকে বাংলাদেশে নিয়মিত হেরোইনসেবীর সংখ্যা বাডতে থাকে এবং ১৯৮৭-৯১ সাল পর্যন্ত বিশেষত তরুণ ছাত্র সমাজের মধ্যে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা সৃষ্টি হয়। নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও ধরা হয়, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে ইয়াবার আবির্ভাব ঘটে। তবে ২০০৫ সাল থেকে জেলা ও থানা পর্যায়ের তরুণ-তরূণীর হাতে ইয়াবা ট্যাবলয়েট চলে যায়। এর আগে ২০০০ সাল থেকে সীমান্তপথে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার থেকে চোরাচালান হয়ে তা দেশে অনুপ্রবেশ করতে থাকে।
মাদক বিস্তারের প্রধান কারণ: মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্য অনুসারে, অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশকে পঞ্চাশের দশক থেকে অদ্যাবধি আর্ন্তজাতিক পাচারকারী চক্র বাংলাদেশকে মাদকাসক্তি চোরাচালানের করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। প্রধানত মাদকদ্রব্য উৎপাদনকারী অঞ্চল থাইল্যান্ড, লাওস, বার্মা, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক, ভারত ও নেপাল সীমান্তের বাংলাদেশ নিকট প্রতিবেশী। এসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য উৎপাদনে ও ব্যাপক ব্যবহারে দীর্ঘদিন ধরে মুক্ত ছিল। ফলে আর্ন্তজাতিক মাদকদ্রব্য প্রতিরোধ সংস্থার কার্যাবলী ও তাদের সন্দেহের বাইরে রয়েছে। মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারীরা সুযোগকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে সক্ষম হযয়েছে। ইতোপূর্বে বাংলাদেশ হেরোইনের ব্যাপক চালান আসত বার্মা ও থাইল্যান্ড থেকে।
মাদকদ্রব্যের চাহিদা: জানা গেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ৯০ লাখ লোক মাদকাসক্ত। সরকারি হিসাব মতে এ সংখ্যা ৫০ লাখ। এদের মধ্যে ৭০ ভাগ হেরোইন বা এডিন সুগারে আসক্ত। আর ৩০ ভাগ ফেন্সিডিলে আসক্ত। আর বর্তমানে বহুল প্রচারিত যৌন উত্তেজক মাদক ইয়াবা আসক্তের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে দিন দিন এর চাগিদা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ইয়বা এখন সারা দেশে শীর্ষ স্থানে রয়েছে। শুধু ঢাকাতেই ইয়াবার দৈনিক চাহিদা ১৪ লাখ। চট্টগ্রামে ১০ লাখের মতো আর কক্সবাজারে এর সংখ্যা ৫ লাখ। বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা কত সে নিয়ে- তেমন কোনো জরিপ হয়নি। তবে বিভিন্ন পরিংখ্যানের তথ্য অনুসারে বর্তমানে ৯০ লাখের অধিক মানুষ মাদকাসক্ত। যার মধ্যে আশি ভাগই যুবসমাজ। মাদকের অর্থ যোগানে যুবকেরা বিভিন্ন অপরাধকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পরছে। দেশে বর্তমানে ৩০ ভাগ মাদকাসক্ত ব্যক্তি খুন-জখম, অপহরণ, ছিনতাই, চুরি, ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িত রয়েছে।
সারাদেশে মাদকের মহামারি: ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তথ্যানুসারে, অবৈধ মাদকদ্রব্যের বিষাক্ত অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে দেশের জনসংখ্যার বিরাট একটা অংশ। এমনকি বিষাক্ত মাদকদ্রব্য সেবন করে মৃত্যু কোলে ঢলে পড়ছে অসংখ্য মানুষ। বর্তমানে শুধু রাজধানী শহর ঢাকার মাদকের প্রধান স্পট আছে ১০০০টির মতো। খুচরা স্পটের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। ঢাকার ডেমরা থানাধীন ধলপুর বস্তি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে বস্তায় বস্তায় ভারতীয় ফেনসিডিল ও মায়নমার থেকে ইয়াবা এখানে আসে এবং অর্ডার অনুযায়ী এখান থেকে সরবরাহ করা হয়। ঢাকার অধিকাংশ বস্তিতেই মাদক বেচা-কেনার আখড়া। রাজধানীর মেট্রো পলিটন থানাগুলোর মধ্যে কাফরুল ও ক্যান্টনমেন্ট থানা ছাড়া বাকি সবগুলোই মাদকের রমরমা বাজারে পরিণত হয়েছে। চোরাই পথে বানের পানির মতো মাদক আসছে এখানে। মাদারীপুর জেলার জেলখানা থেকে পতিতালয় সব জায়গায়ই জমজমাট মাদক ব্যবসা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সদর উপজেলায় মাদকদ্রব্য বিক্রির কম করে হলেও ৫০টি স্পট রয়েছে। বরগুনা শহরের কমপক্ষে ৩০টি। এখানে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকার ইয়াবা,হেরোইন, ফেনসিডিল মদ, গাঁজা ও বিভিন্ন ধরনের নেশাজাতীয় ইনজেকশন সবই বিক্রিয় হচ্ছে প্রকাশ্যে। শেরপুর শহরের বিভিন্ন জায়গায় চলে মাদকের ব্যবসা। বগুড়ার শিবগঞ্জে ও পাবনার ঈশ্বরদীতেও ইয়াবা,ফেনসিডিল ভয়াবহ আঘাত হেনেছে। সীমান্তবর্তী জেলা নাটোরের লালপুর, রাজশাহীর বাঘা ও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় চোরাইপথে ফেনসিডিল নিয়ে আসার পর তা ঈশ্বরদীতে পাঠানো হয়। এখানে থেকে ট্রেন, বাস, মাইক্রো ও প্রাইভেট গাডিতে করে এগুলো যায়, ঢাকা, সাভার, নারায়নগঞ্জ, গাজীপুর প্রভৃতি এলাকায়। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ঢাকা শহরের প্রায় ২৫০টি ইয়াবা,ফেনসিডিল বিতরণ কেন্দ্র রয়েছে। যশোরের চৌগাছা ও বেনাপোল সীমান্তের বিভিন্ন চোরাপথ দিয়ে ফেনসিডিল পাচার হয়ে আসে। আসুন আমরা আমারদেশ মাদক মুক্ত করতে এখনই শপথ গ্রহণ করি। তাহলেই কেবল বাংলাদেশকে মাদকের মহামারি থেকে রক্ষা করা সম্ভব।
0 comments:
Post a Comment