পরিবেশ: সব কিছু হওয়া চাই স্বাস্থ্যসম্মত
আলী ফোরকান
মানুষের এ আশা সাম্প্রতিক নয়। সৃষ্টির শুরু থেকেই এ চিন্তায় মগ্ন ছিল। সেই আচ্ছন্নতা এখনও মানুষের মনে রয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত বাস্তবায়ন করে চলছে। এ স্বপ্নচারী মানুষ কী কখনো ভেবেছে তার আরাধ্য ঘর প্রতিনিয়ত নরকে পরিণত হচ্ছে। যাকে বলে গৃহ দূষণ!! মানুষ সাধারণত শতকরা ৬০ ভাগ সময় ঘরে কাটায়। এখন যদি ঘরের ভারসাম্য নষ্ট হয়, তাহলে মানুষ কী পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হবে, তা সহজেই আঁচ করা যায়। সাধারণত গৃহদূষণ বলতে বুঝায় একটি আবদ্ধ বা সংরক্ষিত পরিবেশে বিভিন্ন ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক দূষকের উপস্থিতি যা কিনা স্বাভাবিকভাবে উন্মুক্ত বায়ুতে বিদ্যমান নয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাইরের দূষণের চেয়ে গৃহে দূষণ শতকরা ২-৫ ভাগ বেশী ঘটে। এ নগরায়ন ও শিল্পায়নের যুগে প্রধানত কল-কারখানা এবং মোটর ইঞ্জিনকেই পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী করা হয়। আর আমরা প্রতিনিয়ত সোচ্চার হচ্ছি শিল্পায়নের বিরুদ্ধে, প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য উন্নয়নের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমরা কি কখনো ভাবি ঘর থেকেই আমরা কী পরিমাণ দূষণের শিকার হচ্ছি!! চলুন দেখি কিভাবে আমরা গৃহদূষণ করছিঐ গৃহদূষণের একটি অন্যতম কারণ ধূমপান যা ধূমপায়ী ছাড়াও অধূমপায়ীও মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং ঘরের বায়ুকে চরমভাবে দূষিত করে। এ তামাকজাত দ্রব্যে ৪,০০০ রাসায়নিক পদার্থ থাকে যার মধ্যে ২০০টি বিষাক্ত পদার্থ সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত। যেমন কার্বন মনোক্সাইড, বেনজিন, ফরমালডিহাইড এবং ৪৩টি পদার্থ ক্যান্সার সৃষ্টিকারক। ডঐঙ-এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কোন ধূমপায়ী যদি ৩টি সিগারেট পান করে, তাহলে একজন অধূমপায়ীর একটি সিগারেট পান করা হয়ে যায়। ঘরে ধূমপানের ফলে প্রায় সকলেই ক্ষতির শিকার হয় এবং সাধারণ থেকে মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা দেখা দেয়। যেমন ক্লান্তিবোধ, ঘুমঘুম ভাব, মাথা ব্যথা, বুক ব্যথা, জ্বালাপোড়া, চোখ, নাখ ও গলায় অস্বস্তিবোধ, নিউমোনিয়া, এজমা, ব্রংকাইটিস, ফুসফুস ক্যান্সার প্রভৃতি। আমেরিকায় ২০,০০০-১,০০,০০০ জন এজমা আক্রান্ত শিশুকে পরীক্ষা করে দেখা গেছে তাদের এ রোগের আক্রান্ত হওয়ার পিছনে গৃহে ধূমপানই প্রধান কারণ। এনভারনমেন্টাল প্রটেকশান এজেন্সীর রিপোর্টে দেখা যায়, প্রতি বছর আমেরিকায় ৩৫,০০০-৫০,০০০ শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ পরোক্ষ ধূমপান। অপর একটি রিপোর্টে দেখা গেছে, প্রতি বছর আমেরিকায় ১,৫০,০০০-৩,০০,০০০ ১৮ মাস বয়সের শিশুর ফুসফুস ইনফেকশন হয়ে থাকে শুধুমাত্র তাদের আশেপাশে ধূমপানের ফলে এবং ৪,৪০,০০০ শিশু ম্যাচুরিটি আসার আগেই মারা যায় এবং একই কারণে বিকলাঙ্গ শিশুও জন্মাতে পারে। সুতরাং ধূমপানের ব্যাপারে একান্ত সচেতনতা প্রয়োজন। ঘরে রান্নাজনিত কারণে যে দূষণ ঘটে তাও মারাত্মক। এর প্রধান শিকার নারী ও শিশুরা। বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ মহিলাই গৃহিণী এবং তারা শতকরা ৮০-৯০ ভাগ ঘরেই কাটান এবং যেসব শিশু মায়েদের কাছে বেশি সময় থাকে বা ঘরে বেশি সময় কাটায় তারাও এর শিকার হয়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে তো বটেই, শহরের বস্তিসহ অনেক জায়গায় যেখানে গ্যাস সরবরাহ নেই, অধিকাংশ রান্না হয় কাঠ, পাতা ও খড়কুটা দিয়ে, যা প্রচুর কালো ধোঁয়া সৃষ্টি করে, যা ঘর ও বাইরের পরিবেশকে দূষিত করে। যেসব পরিবারে গ্যাসে রান্না হয়, সেক্ষেত্রে এ দূষণের পরিমাণ অনেক কম; কিন্তু সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। বেশিক্ষণ গ্যাসের চুলা জ্বালানো থাকলে ঘরের ভিতরে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পায়, আবার আবদ্ধ ঘরে কার্বন মনোক্সাইডও সৃষ্টি হতে পারে যা হার্টের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। গ্যাসের চুলা জ্বালানোর সময় লক্ষ্য রাখবেন, হলুদ বা কমলা রঙের শিখাই কিন্তু কার্বন মনোক্সাইড বেশি উৎপন্ন করে। যদি আনবার্ন (না পোড়া) গ্যাস বেরোয় অর্থাৎ লিক দিয়ে গ্যাস বেরিয়ে আসে বা নীল আগুনের পরিবর্তে লাল আগুন বেরিয়ে আসে তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। পোকা-মাকড় ধ্বংসকারী উপাদান থেকেও পরিবেশ নষ্ট হয়। সাধারণত মশা, মাছি, তেলাপোকা, ইঁদুর ও অন্যান্য পোকা-মাকড় মারতে এরোসল, কয়েল ব্যবহার করা হয়। কয়েলের ধোঁয়া থেকে ঘরের বায়ু দূষিত হতে পারে, সত্য কথা হলো কয়েল যত সম্ভব এড়িয়ে চলাই ভালো। এরোসল একটি উদ্বায়ী পদার্থ যার প্রধান উপাদান ট্রাইক্লোরোইথেন, প্যারা ডাই ক্লোরোইথেন। এটি ব্যবহারে নিয়মাবলী মেনে চলা একান্ত প্রয়োজন। অন্যথায় এর প্রভাবে তীব্র মাথা ব্যথা, স্নায়ু দৌর্বল্য, মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। রান্নার তৈজসপত্র নির্বাচনেও সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার। আমাদের দেশে রান্নাসহ অন্যান্য কাজে প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। প্লাস্টিকের জিনিসপত্র বেশিদিন ব্যবহার উচিত নয়, কারণ এটি একটি পলিমারিক পদার্থ যা অনেকদিন ব্যবহারে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে পারে এবং বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের সাথে দেহে প্রবেশ করতে পারে যা স্বাস্থ্যের জন্য বিরাট ক্ষতিকর। আমাদের দেশে রান্না কাজে অ্যালুমিনিয়াম, লৌহ ও নিকেলের তৈরি বিভিন্ন তৈজসপত্র ব্যবহার করা হয়। গবেষকরা দেখিয়েছেন যে অনেকদিন ব্যবহার করা অ্যালুমিনিয়াম পাত্র রান্নার সময়, তাপে অ্যালুমিনিয়াম লবণ তৈরি হয়ে খাদ্যের সাথে মিশে এবং তা গ্রহণের ফলে দেহে চরম ক্ষতি সাধিত হয়। কখনই প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম, স্টিল বা এ ধরনের পাত্রে দীর্ঘদিন খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ করা উচিত নয়। গৃহে প্রতিনিয়ত যে দূষণগুলো হচ্ছে তা স্বাস্থ্যে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে। অনেক উপসর্গ সাথে সাথে দেখা না দিলেও এগুলো ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক ক্ষতি সাধিত করতে পারে। আমাদের সচেতন হতে হবে প্রাত্যহিক বিভিন্ন দ্রব্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে, জানতে হবে এর ব্যবহার নিয়মাবলী এবং এটি স্বাস্থ্যে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারে। গৃহ বা ঘর শুধু মানুষের আশ্রয়ের স্থান নয়, এটি মানুষের মানসিক, শারীরিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনেক চাহিদাই পূরণ করে। গৃহদূষণ রোধে শুধু ব্যক্তিগতভাবে নয়, জাতিগতভাবেও আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কারণ একটি সুস্থ সবল জাতির উপর নির্ভর করে জাতীয় উন্নয়ন।
0 comments:
Post a Comment