Saturday, July 16, 2016

মাদক- জাতিবিনাশী অভিশাপ

মাদক- জাতিবিনাশী অভিশাপ
আলী ফোরকান
আমরা জানি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একজন শিক্ষার্থীকে তৈরি করে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুনিপুণ কারিগর ও শিল্পীত ধ্যান-ধারণার উন্নতমনস্ক মানুষরূপে। শুধু তাই নয়, প্রত্যেক শিক্ষার্থীরই প্রথম দায়িত্ব ও কর্তব্য পরিবার-পরিজন থেকে শুরু করে সমাজ-দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করা। আর এ ক্ষেত্রে যদি দেশের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহভাগ শিক্ষার্থী ভয়াল মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে অন্ধকারের অতল গহবরে নিমজ্জিত হয়। তাহলে ব্যক্তি-সমাজ ও দেশ উন্নতির দিকে যাচ্ছে এবং শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বাড়ছে তা কোন বোকায় বলবে?    
আজ অপ্রিয় হলেও বলা দরকার, সরকারের উদাসীনতার কারণে দেশের সর্বত্র মাদকের ভয়াল বিষ ছড়িয়ে পড়েছে। সমাজের উঁচুস্তরের বিত্তবান থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ, বেকার যুবক-যুবতী, শ্রমিক রিকশাচালক, ব্যবসায়ী ও ছোট্ট ছোট্ট ছেলে-মেয়ে অর্থাৎ টোকাই-ছিন্নমূল ও পথশিশুরাও বিভিন্ন ধরনের ভয়ানক নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে । এর হার দ্রুত বেড়ে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের চেয়ে কঠিন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দেশে সিংহভাগ চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, খুন-রাহাজানি, ইভটিজিং ও ধর্ষণসহ বহু অপকর্ম সংঘটিত হচ্ছে মাদকাসক্তদের দ্বারা। তাদের নেশার চাহিদা মেটাতে অর্থের জন্য আপনজনদের হত্যাসহ এমন কোনো জঘন্য কাজ নেই যা তারা করছে না। এক কথায়, মাদকাসক্তদের হিংস্রতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দিচ্ছে এ সহজলভ্য মাদক-নীলবিষ।
এই মাদকের কারণে দেশ যে সামগ্রিকভাবে অনেক পিছিয়ে পড়ছে। এর দিকে যেন কারো খেয়াল করার সময় নেই। যদিও মাদকের ভয়াবহ প্রসার ও মাদক বিষ-মরণব্যাধি সংক্রান্ত খবরাখবর প্রতিদিনই পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে ও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় দেখানো হচ্ছে বিভিন্ন চিত্র কিন্তু এর প্রতিকারে সরকারের উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। যার ফলে সমাজ চরমভাবে অবক্ষয়ে পতিত হচ্ছে। মাদকের থাবায় দিশেহারা হচ্ছে দেশের সর্বস্তরের মানুষ। এখন ব্যক্তি-পরিবার, সমাজ, জাতি তথা দেশের জন্য বড় ধরনের এক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মাদক। এই মাদক মরণ নেশা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে দেশের তরুণ সমাজসহ অন্যদেরও। জাতীয় জীবন স্তিমিত হচ্ছে। মেধা ও মনন বিনষ্ট হচ্ছে; সুপ্ত প্রতিভা গুমড়ে কাঁদছে; প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে সুস্থ চিন্তাচর্চা, সুস্থ দৃশ্যচর্চা ও সুস্থ কর্মচর্চায়। যাকে আমরা নির্দ্বিধায় জাতিবিনাশী বড় এক ধরনের অভিশাপ বলতে পারি। মাদকের সহজলভ্যতা সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়, এখন এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সমাজের যে কেউ ইচ্ছে করলেই যে কোনো মরণনেশা পেতে পারে ঘরে বসেই। ফেনসিডিল, হেরোইন, শিশা, ইয়াবা মারিজুয়ানা, দেশী-বিদেশী মদ, বিয়ার, গাঁজা, চরস, ভাঙ, বেনাড্রিল, নিপ্রোহেপটাইডিন, কোডাকাক, আইকা (এক ধরনের গাম) নিট্রোসানসহ ইয়াবা'র মতো সবরকম ভয়ানক নেশার উপকরণ টাকা হলে সহজেই মেলে। এমনকি কথিত রাজনীতিক ও পুলিশের সহযোগিতায় মাদক পৌঁছে দেয়া হয় নিরাপদ স্থানে।
আমরা দেখছি, এসব মাদকাসক্তদের বেশীরভাগই প্রথমে বন্ধু-বান্ধবদের দ্বারা নেশায় আসক্ত হয়। নেশাগ্রস্ত জীবনে জড়িয়ে যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে-প্রিয়জনের আঘাত, বেকারত্বের অভিশাপ, দারিদ্র্যতার কষাঘাত, বাবা-মার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়া, শখের বসে আবেগপ্রবণ এবং মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়ানোর বিষয় সমূহই উল্লেখযোগ্য। এসকল মাদকসেবীরা ঘূর্ণাক্ষরেও চিন্তা করে না যে, এসব ভয়ানক মরণনেশা তাদের সৃজনীশক্তিকে কতটা বিনষ্ট করছে। জীবনকে ধীরে ধীরে করে দিচ্ছে ধ্বংস। আমরা আজকাল লক্ষ্য করছি, বর্তমানে মাদক গ্রহণকারীদের প্রিয় মাদকদ্রব্য হচ্ছে গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবা ও শিশা। বিশেষ করে উচ্চবিত্তদের বেশীরভাগ নেশাগ্রস্তই ওইসব নেশা গ্রহণ করে। অবশ্য এখন নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা বিভিন্ন ফন্দি-ফিকিরের মধ্যদিয়ে পিছিয়ে নেই এসব মরণ নেশা থেকে। আর বাকিরা অন্যান্য নেশায় আসক্ত।
আমাদের মনে রাখা বাঞ্ছনীয়, নেশা যে কোনো ধরনের নেশাই হোক তা আমাদের জীবনকে নিশ্চিত ধ্বংস করে। নেশার শেষ পরিণতি নির্ঘাত মৃত্যু, এ  থেকে কোনোভাবেই বাঁচার উপায় নেই। বাঁচার একমাত্র পথ এ পঙ্কিলতা থেকে দ্রুত সরে আসা। আমাদের তরুণ ও যুব সমাজসহ সকল স্তরের নেশাগ্রস্তদের এ মরণব্যাধি- অভিশাপ থেকে বাঁচাতে হলে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে এবং সমাজের বিশৃক্মখলা দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে এখনই দেশপ্রেমিক ও সর্বস্তরের বিবেকবান সচেতন মানুষসহ সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে এবং দেশের সামাজিক সংগঠনগুলোকেও সম্পৃক্ত করতে হবে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচিতে। পাশাপাশি সকল মাদকবিরোধী সংগঠনগুলোকে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে ব্যক্তি-পরিবার, প্রতিবেশী, বাড়ি-মহল্লা, গ্রাম-ইউনিয়ন, উপজেলা-জেলা সর্বোপরি বিভাগ পর্যায়েও। প্রথমে ‘মাদকাসক্তদের ঘৃণা নয়, ভালোবাসা দিয়েই জয় করতে হয়' এই নীতিতে এগিয়ে যেতে হবে। স্নেহ ও নিখাঁদ ভালোবাসা দিয়ে প্রচেষ্টা চালাতে হবে এ অন্ধকার পথের যাত্রীদের ফিরিয়ে আনতে অনিন্দ্য সুন্দর আলোর দিকে।
আমাদের মনে রাখা উচিত, একজন মানুষ জন্মের পরেই নেশায় আসক্ত হয় না; কারো না কারো সংস্পর্শে গিয়েই এ পথে যায় সে। তাই তাকে অবহেলা-অনাদর, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য নয়, ভালোবাসা দিয়ে বোঝাতে হবে তার চলার এপথটি ভয়ঙ্কর অতি ভয়ঙ্কর এবং চরম অভিশাপ ও ঘৃণার। এ নিন্দনীয় পথে চলতে চলতে সে একসময় মৃত্যুমুখে পতিত হবে। আর এই সময়টিও অতি নিকটে। তার চাহিদা, সুবিধা-অসুবিধা ও সমস্যা নিয়ে বন্ধুসুলভ আচরণের মাধ্যমে খোলামেলা আলাপ-আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তার মধ্যে কোনো বিষয়ে হতাশা লক্ষ্য করা গেলে, সেগুলো যথাসম্ভব পূরণ অতঃপর মোটিভেশন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। তাকে টেনে নিতে হবে বুকে আদর-সোহাগ, মায়া-মমতা দিয়ে। তারপরেও যদিও তাদেরকে আলোর পথে না ফেরানো যায় তখন প্রয়োজনে কঠিন ও কঠোর হয়ে মাদকাসক্তদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে। সমাজে এমন অনেক পরিবার আছে যারা তাদের সন্তানদের এ পঙ্কিলতা থেকে ফেরাতে চায়, তাদের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে উপযুক্ত মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে পাঠাতে হবে। যদিও দেশে সরকারি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা হাতেগোনাই বলা যায়। তারপরও বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রগুলোয় যাতে সঠিক চিকিৎসা সেবা পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। এবং এ ক্ষেত্রে সরকারেরও উচিত, আরো মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র স্থাপনে উদ্যোগ নেয়া।
আমরা প্রায়ই পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনের খবরে লক্ষ্য করি, মাদক বিক্রির স্পট ও মাদক বিক্রেতাসহ মাদক সেবনকারীদের নিকট থেকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি-গোষ্ঠী, থানা, পুলিশ ফাঁড়ি, ব্যক্তি পুলিশ, দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক চাঁদা নিয়ে এ অনৈতিক ব্যবসা চালানোর সুযোগ করে দেন। যার সংবাদ ফলাও করে প্রচারও হয় কিন্তু পরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো প্রতিবাদ বা উল্লেখযোগ্য তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না। তখন সত্যিই সত্যিই মর্মাহত হতে হয়। অবাক লাগে, আমাদের সরকার আছে, আইন আছে, বড় বড় কথার সংস্কৃতি আছে কিন্তু অবস্থার কি কোনো উন্নতি হচ্ছে? আজ কি অস্বীকার করার কি কোনো সুযোগ আছে, প্রশাসনের যোগসাজশে দেশের প্রায় সর্বত্রই ওপেন-সিক্রেট মাদক বেচাকেনা যে চলছে না? মাদকদ্রব্য-বেচাকেনার রমরমা ব্যবসা ও সেবনের এ ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা কি প্রশাসন দেখে না? নাকি দেখেও না দেখার ভান করে নিজেদের পকেট ভারি করার ধান্দায় বিভোর? অবশ্য ক্ষেত্র বিশেষে দেশের কোথাও কোথাও পুলিশি এ্যাকশন আমরা লক্ষ্য করে থাকি। কিন্তু কয়েকদিন পরেই আবার সেই পুরানো গানের সূর। তবুও আমাদের অনুরোধ প্রশাসনের প্রতি, আমাদের এই সুন্দর-সুন্দর ছেলেমেয়ে তথা জাতিকে বাঁচাতে মাদক-নীল বিষের ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নিন। প্রয়োজনে নতুন আইন তৈরি করে হলেও এই ভয়াবহতা থেকে জাতিকে রক্ষার বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি জানাই বিশেষ আকুল আবেদন।

0 comments:

Post a Comment