Wednesday, June 29, 2016

পরিবেশ ও বস্তি সমস্যা

পরিবেশ ও বস্তি সমস্যা  
আলী ফোরকান
গ্রাম থেকে দল বেধে মানুষ শহরের দিকে আসছে। তবে রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোর দিকেই বেশি আসছে। গ্রামের মানুষের ধারণা, ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে তাদের আহার মিলবে; মিলবে মাথা গোজার ঠাই। কিন্তু রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে কি তাদের মাথা গোজার ঠাইটুকু হয়? ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে এসে এই সাধারণ মানুষদের ঠাই হয় লঞ্চ স্টেশন, ট্রেন স্টেশন, বাস স্ট্যান্ড কিংবা রাস্তার পাশে। আবার করো ঠাই হয় নগরীর আনাচে কানাচে গড়ে ওঠা বস্তিতে। দিনে দিনে বস্তির সংখ্যা বাড়ছে।
নগর গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, শুধু রাজধানী ঢাকায় বস্তির সংখ্যা তিন হাজারের অধিক। এরমধ্যে প্রায় ৭ শত বস্তি সরকারি জমিতে এবং ২ হাজার ৪ শত বস্তি ব্যক্তিমালাকানধীন জমিতে অবস্থিত। এই বস্তিগুলোর দখলে রয়েছে প্রায় এক হাজার ৪০ একর জমি। এগুলোতে বাস করছে প্রয় ২৩ হাজার পরিবার। লোক সংখ্যা ৩০ লাখের অধিক। এছাড়া বিভিন্ন স্টেশন,মার্কেট রাস্তার পাশে অলিতে গলিতে বাস করছে আরো লক্ষাধিক মানুষ। বস্তির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেও আনেকের মাথা গোজার ঠাই হয়না। তারা খোলা আকাশের নীচে বসবাসকরে। বস্তিগুলোর পরিবেশ বসবাসের অযোগ্য। ছোট্ট একটি কক্ষে ৭/৮ জন গাদাগাদি করে থাকতে হয়। কিন্তু তাদের যাওয়ার জায়গা কোথায়! নিতান্তই দায় ঠেকে তাদের এ দুর্বিসহ জীবন বেছে নিতে হয়েছে। গ্রামে কাজ নেই,আহার নেই। তাইতো তারা কাজের সন্ধানে, একমুঠো ভাতের জন্য ছুটে আসছে শহরে। আর এই শহরও দিতে পারছে না তাদেরকে থাকার খাওয়ার নিশ্চয়তা। বস্তির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে গিয়ে তারা নানা রকম রোগের শিকার হয়। সর্দি, কাশি, ডায়রিয়া, আমাশয় প্রভৃতি রোগ তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। এসব রোগের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অনেকে কোনোমতে টিকে থাকে। আবার অনেককে এই মায়াময় পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়। সবচেয়ে ঢাকা শহরের বস্তিগুলো পরিবেশর জন্য একটি বড় সমস্যা। বস্তি গুলো থেকে অনেক রোগ নগরীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। বস্তি গুলোর উচ্ছেদ ছাড়া ঢাকা শহরের পরিবেশ উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু এই বস্তি উচ্ছেদ কিভাবে সম্ভব? কেবল বুলডোজার দিয়ে উচ্ছেদ করলেই কি এ সমস্যার সমাধান হবে? না, এ সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন বস্তিবাসীদের পুনর্বাসন। তাদেরকে গ্রামে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
অবশ্য ঢাকা মহানগরীর বস্তি উন্নয়নে বিভিন্ন দাতা দেশও সংস্থা বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে সাহায্য দিয়ে আসছে। সরকার নিয়েছে ঘরে ফেরা কর্মসূচী। কিন্তু এরপরেও অবস্থার উন্নতি হয়নি। সরকারের ঘরে ফেরা কর্মসূচীর আওতায় কিছু পরিবার গ্রামে চলে গেলেও প্রতিদিনই ঢাকার বস্তিতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন পরিবার। এই বস্তিগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দেশের গ্রামাঞ্চলের চেয়েও অনেকগুন বেশি। সরকারের এক জরিপ রিপোর্টে জানা যায়, বর্তমানে দেশেজনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৬ শতাংশ। কিন্তু ঢাকা শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ। বস্তিতে জন্ম হার এতোই বেশি যে, দেশের জনসংখ্যা যেন স্রোতের মতো বাড়ছে। কারণ পরিবার পরিকল্পনা কাকে বলে তাও তারা জানে না।
ঊস্তিতে বসবাসকারী নিম্ন আয়ের এই মানুষগুলোর জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল। বস্তির শিশুরা প্রতিনিয়ত অপুষ্টিতে ভুগছে। আহার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। ১০/১২ টি সন্তানের মুখ আহার যোগাতে ব্যর্থ বাবা-মায়ের বুক ফাটা কান্না এখনো কানে বাজে। কিন্তু তাদের এই অসহায়ত্ব কিভাবে ঘুচবে! তাদেরও তো স্বপ্ন ছিল সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচবার, ছেলে-মেয়েদের, শিক্ষিত করে গড়ে তোলার! দারিদ্র তাদের সেসব স্বপ্ন সাধ কেড়ে নিয়েছে। কেন তারা এ অবস্থার শিকার?
ঊস্তিতে বসবাসকারী অনেক পরিবারেরই গ্রামে বাড়ি ছিল, জমি ছিল; ছিল হালের বলদ। কিন্তু সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস, নদীভাঙন তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে। সর্বশান্ত হয়ে ছুটে এসেছে শহরে। শহরে এসে অসহায় পরিবারের লোকগুলো কাজ নিয়েছে গার্মেন্টসে। তারা ইট, পাথর ভাঙছে। রিকশা-বেবি ট্যাস্কি চালাচ্ছে। টেম্পো বাসে হেলপারি করছে। অন্যের বাড়িতে ঝি চাকরের কাজ নিচ্ছে। সামান্য আয়ে চলছে তাদের বস্তির সংসার। চলছেতাদের জীবন সংগ্রাম। কিন্তু এটাকে কি বাঁচা বলে?
সাম্প্রতিককালে বস্তি উচ্ছেদের বেশ কয়েকটি ঘটনা আমরা লক্ষ্য করেছি। এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেছেন, পুনর্বাসন ছাড়া জোরপূর্বক বস্তি উচ্ছেদে মূল সমস্যার সমাধান হবে না। আমরা সরকারর আইন শৃঙ্খলা বিষয়ক উচ্ছেদের সঙ্গে একমত। তবে বুলডোজার দিয়ে বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। বিশেষ্জ্ঞরা বলেন, পুনর্বাসন না করে জোর করে বস্তি উচ্ছেদ করলে এক স্থান থেকে অন্য স্থঅনে বস্তির সৃষ্টি হবে। বস্তিবাসীদের দুর্ভোগ বাড়বে এবং তাদের জীবন যাত্রার মান নীচে নেমে যাবে। তাঁরা বলেন, পর্যায়ক্রমে পুনর্বাসনের মাধ্যমে বস্তি উচ্ছেদের ব্যাপারে হাইকোর্টেল রায়ের সঙ্গে আমরা একমত।
ঢাকার পরিবেশকে রক্ষা করতে হলে বস্তিবাসীদের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এটা সময়ের দাবি। এজন্য ঘরে ফেরা কর্মসূচীকে সফল করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে না আগালে এক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি আসবে না। বস্তিবাসীদের বাঁচা মরার জীবন নিয়ে রাজনীতি না করে দল মত নির্বিশেষে সকলে মিলে বস্তিবাসীদের উন্নত জীবনের অধিকার নিশ্চিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। অন্যতায় বস্তিবাসীদের ভাগ্যের চাকা ঘুরবে না।

0 comments:

Post a Comment