Thursday, June 23, 2016

আত্মবিশ্বাসী হতে শিখল পথশিশুরা

আত্মবিশ্বাসী হতে শিখল পথশিশুরা
আলী ফোরকান 
পথশিশু রায়হান এখন ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং’। পুরো নাম  ইমতিয়াজ হোসেন রায়হান। ছোট বেলায় বাবা মারা যাওয়ায় মা দ্বিতীয় বিয়ে করে। মায়ের দ্বিতীয় সংসারে রায়হানের ঠাই হয়নি। প্রতিদিন সৎবাবার অত্যাচার নির্যাতন চলতে থাকে। একদিন শিশু রায়হান নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে অজানায় পাড়ি দেয়। কুমিল্লা থেকে চলে আসে খুলনায়। খুলনা অজানা অচেনা পথে বিষণœ ও ক্ষুর্ধাত অবস্থায় তার আশ্রয় মিলে সংযোগে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সহায়তা কেন্দ্র সংযোগ ২০০৫ সাল থেকে অন্যান্য শিুদের মতো থাকে ও স্কুলে ভর্তি করায়। পথশিশু রায়হান প্রতি ক্লশেই প্রথম স্থান  অধিকার করে। তার মেধা ও প্রতিভা দেখে সংযোগের শিশু উন্নয়ন ব্যবস্থাপক রায়হানকে খুলনা পলিটেকনিক্যালে ভর্তি করে। এখানে ও সে মেধার স্বাক্ষর রেখছে। “সংযোগ” অপরাজেয় বাংলাদেশের পরিচালিত একটি সংগঠন। সংযোগের শিশু উন্নয়ন বিষয়ক পরিচালকের মতে, প্রতিটি শিশুই সঠিক পরিচর্যা  পেলে সমাজে অনেক বড় বড় স্বাক্ষর রাখতে পারবে। বর্তমানে তার সংযোগে ৬০ জনের অধিক রাহানদের মতো শিশু রয়েছে। তাদের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা হয়েছে । পাশাপাশি সংযোগে শিশুদের সেলাইসহ বিভিন্ন কারিগরী প্রশিক্ষণ দেয়াহয়, জানালেন শিশু উন্নয়ন ব্যবস্থাপক। ইতোমধ্যে তাদের এ কার্যক্রম বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে ভারত মডেল হিসেবে গ্রহণ করেছে। অপরদিকে সম্প্রতি একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবরে জানায় আরেক পথশিশুর কথা। তার নাম স্মৃতি আক্তার। ‘সৎমায়ের অত্যাচারে টিকতে না পেরে আমি আশ্রয় নেই মিরপুরের শাহ আলী মাজারে। সেখান থেকে বাবা ফিরিয়ে নিয়ে থাকতে দেয় ফুফুর বাসায়। ওখানেও আমি টিকতে পারি না। পরে আমি আশ্রয় পাই পথকলি সেন্টারে।’ জীবনের নির্মম এই কাহিনী ১১ বছরের শিশু স্মৃতি আক্তার জুলেখার। সে পথকলি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। স্কাউটে নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেছে, এখান থেকে আমি এমন কিছু শিক্ষা পেয়েছি যা নিজের জীবনে অনেক কাজে লাগবে। ১৩ হাজার স্কাউটের মাঝে এবার জাম্বুরিতে অংশ নিয়েছে ১৩০ বুদ্ধি প্রতিবন্ধী স্কাউট। স্কাউটের চ্যালেঞ্জগুলো কঠিন হলেও তাতে কোন সমস্যা ছাড়াই অংশ নিচ্ছে এসব প্রতিবন্ধী। রাজধানীর ইস্কাটনের সুইড বাংলাদেশের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী স্কুলের শিক্ষার্থীদের একটি গ্রুপ অংশ নিয়েছে জাম্বুরিতে। তারা মনের আনন্দে পুরো জাম্বুরি ময়দানে ঘুরে বেড়ায়। প্রতিবন্ধী স্কাউটদের গ্রুপ লিডার হাসিনা হোসেন বলেন, প্রথমে আমি শংকায় ছিলাম এখানে এসে কেমন করে ওরা। কিন্তু প্রতিটি চ্যালেঞ্জে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ সত্যিই আমাদের অবাক করেছে। এই বুদ্ধি প্রতিবন্ধী দলটির প্রত্যেকেই আবার বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী।এদের মধ্যে শিউলি আক্তার সাথী, নাজমুল হাসান, রায়হান কবীর, নাজমুল ইসলাম, শাহীন সারমিন আক্তার লিপি স্পেশাল অলিম্পিকে অংশ নিয়ে পদক লাভ করেছে। সারমিন চীনে ১০০ মিটার দৌড়ে স্বর্ণপদক জিতেছে। সবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে,দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই শিশু। এরা কোন না কোন বা বা মায়ের সন্তান। অবশ্য শিশু বলতে ঠিক কোন বয়সের ছেলেমেয়েদের বুঝায়। এ নিয়ে রয়েছে মতভিন্নতা। সংবিধানে ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত শৈশবকাল বলে উল্লেখ থাকলেও নারী ও শিশু নির্যাতন বিরোধী আইন ২০০০-এ ১৪ বছর বয়ঃক্রম পর্যন্ত শিশুকাল বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্যদিকে, ১৮ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত ভোটার তালিকাভুক্ত হতে পারে না। সে অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। জাতিসংঘ সনদেও ১৮ বছর পর্যন্ত বয়সের ছেলেমেয়েদের শিশু বলে গণ্য করা হয়। শিশু সনাক্তকরণ বয়সের এরূপ ভিন্নতাহেতু মোট জনসংখ্যার ঠিক কতভাগ শিশু তা নির্ণয় করা কঠিন। তবে, সাধারণভাবে স্কুল জীবনকেই আমরা শৈশবকাল বলে চিহ্নিত করে থাকি। সাধারণত ষোল-সতের বছর বয়:সীমার মধ্যেই ছেলেমেয়েরা স্কুলের গন্ডি পার হয়ে থাকে। যেসব ছেলেমেয়ে স্কুলে যায় না, তাদেরও অনুরূপ বয়স বিবেচনায় শিশু  বলে গণ্য করা হয়। শৈশবকালের সীমারেখা যাই হউক না কেন, মানুষের জীবনে এ সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শরীরে, মননে-মেধায় সার্বিক ভাবে বেড়ে উঠার এই প্রকৃষ্ট সময়। এ সময়ে শিশু কিরূপ পরিবেশ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় বা হচ্ছে, তার উপর অধিকাংশে নির্ভর করে শিশুর বেড়ে উঠার গতি-প্রকৃতি। অনুকূল ও সুস্থ পরিবেশ না পেলে শিশুমনে বিকার-বিকৃতি বাসা বাঁধা যেমন বিচিত্র নয়, তেমনিই অসম্ভব নয় মানসিক বন্ধ্যাত্বের শিকার হওয়া। বাংলাদেশের মত স্বল্পোন্নত দেশসমূহে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পথে বাধা পদে পদে। ঘরে ও বাইরে কোমলমতি ছেলেমেয়েরা অসদাচরণের শিকার হয় হরহামেশা। কখনও অবজ্ঞা করে, কখনও না জেনে না বুঝে শাসন বারণের নামে শিশু-কিশোরদের প্রতি নির্দয় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কখনও কখনও তা হিংসার পর্যায়ে পড়ে। শিক্ষিত ও সম্পন্ন পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যরা, পিতা ও মাতা নিজের সন্তনদের ভালমন্দের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন থাকলেও অন্যের শিশু সন্তানের প্রতি কাঙিক্ষত সহৃদয়তার পরিচয় দিতে পারে না প্রায়শ। গৃহকর্মে নিয়োজিত দরিদ্র শিশুটির সাথে উঠতে বসতে দুর্ব্যবহার করতে অনেকেরই বাধে না। অনেকে এমনও আছে, যারা পান থেকে চুন খসলে অপ্রাপ্তবয়স্ক গৃহকর্মীর উপর নির্যাতন চালাতেও কসুর করে না। অন্যদিকে, ছোট ছোট কারখানায়, হোটেল-রেস্তোরাঁয়, দোকানপাটে যেসব শিশু কাজ করে, তাদের কর্মভার লাঘব করো দেওয়াতো দূরের কথা, অনেক সময় তাদের উপর নেমে আসে নির্যাতন। ক্ষেত্রবিশেষে স্কুলেও শিশুরা নিরাপদ নয়। একশ্রেণীর রাগী-দেমাগী শিক্ষক আছেন, যারা অহরহ বাচ্চাদের সাথে খারাপ আচরণ করে থাকে। জর্জরিত করে থাকে বেত্রাঘাতে। শিক্ষকের পিটুনিতে মৃত্যু  হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে আমাদের সমাজে। ঘরে-বাইরে, পথে ঘাটে অপ্রাপ্তবয়ষ্ক ছেলেমেয়েদের উপর কত বিচিত্র প্রকার নির্যাতন চলে তা বলে শেষ করা যায় না। সম্প্রতি ঢাকায় আয়োজিত এক সেমিনারে তথ্য প্রকাশিত তথ্য মতে, শিশুদের উপর কমপক্ষে ১ হাজার ধরনের অন্যায় আচরণ করা হয়ে থাকে। শিশুরা এমনিতেই অসহায়, উপরন্তু শুধু দিন যাপনের ও প্রাণ ধারণের গ্লানি মোচন করতে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে যে শিশু, সে-তো আরও অসহায়। প্রতিবাদ করার শক্তি-সাহস তার নেই। ভাষা থাকলেও প্রকাশ নেই। বিচার চাইবার তার কোনো জায়গা নেই। বুক ফাটে তার মুখ ফোটে না। সে বিমর্ষ হয়ে যায়। ভেতরে ভেতরে তার প্রতিবাদ ও প্রতিশোধের আগুন জ্বলে। অনেক ক্ষেত্রে বয়সকালে তারই বেপরোয়া বহি:প্রকাশ ঘটে থাকে। বিপথে পা বাড়িয়ে আত্মপীড়ন করে সে মুক্তি খোঁজে, না হয় উচ্ছৃঙ্খল আচরণ দ্বারা সামাজিক অন্যায়ের শোধ নিতে প্রয়াস চালায়। তার মন-মানসের কাঙিক্ষত-সুন্দর বিকাশ ঘটে না। এই পরিস্থিতি সামগ্রিকভাবে দেশ-কালের কারও জন্য শুভকর নয়, হতে পারে না। আজকের শিশু আগামী দিনের সম্পূর্ণ নাগরিক। তার মানবিক শক্তির বাঞ্ছিত ও পরিপূর্ণ বিকাশ ছাড়া সুন্দরতর ভবিষ্যতের চিন্তা করা যায় না। সরকার শিশু নির্যাতন রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের  উদ্যোগ নিয়েছে। এর আগে আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে গৃহীত হয়েছে শিশুসনদ। ১৯৯০ সালে প্রণীত শিশু সনদে বাংলাদেশও স্বাক্ষর করেছে। শিশু নির্যাতন রোধে কৌশলপত্র, শিশু অধিকার সনদ, শিশুনীতি, নির্যাতন বিরোধী কঠোর আইন, এসবের প্রয়োজন ও প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু নীতি-নিয়ম, আইন ও কৌশলই যথেষ্ট নয়। সামগ্রিকভাবে দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন দরকার। এ জন্যে প্রয়োজন সচেতনতা। মনে রাখতে হবে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হচ্ছে অর্থনৈতিক। দারিদ্র্যের কারণেই অধিকাংশ শিশুকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। কাজেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নই হচ্ছে প্রথম কর্তব্য। কর্মক্ষম প্রাপ্তবয়স্কদের যতবেশি কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা যাবে, শিশুশ্রমিকের সংখ্যা তত হ্রাস পাবে। পরিবারের সামর্থ্য বাড়লে শিশু সন্তানদের প্রতি দরিদ্র অভিভাবকদের দায়িত্ববোধও জাগ্রত হবে। মানসিকতার পরিবর্তন ঘটবে সম্পন্ন নাগরিকদেরও। যাবতীয় সমস্যার মূলে রয়েছে অর্থনীতি। এই কথাটি কখনও ভুলে যাওয়া উচিত নয়। শিশুদের বঞ্চনা এবং তাদের নির্যাতিত হওয়ার সমস্যাটিকে অর্থনৈতিক সমস্যা হতে পৃথক করে দেখার সুযোগ নাই। পাশাপাশি এসব নির্যাতি অধিকার বঞ্চিত শিশুদের সঠিক পরিচর্যা করলে এরাই একদিন দেশের বৃহৎ অর্থনীতির মেরুদন্ড হয়ে দাঁড়াতেপারে।                                        
মোবাইল : ০১৭১১৫৭৯২৬৭

0 comments:

Post a Comment