Thursday, June 16, 2016

চীন ও বিশ্ব রাজনীতি

চীন ও বিশ্ব রাজনীতি
আলী ফোরকান 
ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে এক সময় ঘটেছে ভয়াবহ যুদ্ধ। কিন্তু ইউরোপের অনেক দেশ মিলে এখন গড়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বিদূরিত হতে পেরেছে এসব দেশের মধ্যে আগের মতো যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা। ইউরোপে যা ঘটেছে, এশিয়ায় তা ঘটার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এশিয়ার তিনটি শক্তির দেশ চীন, জাপান ও ভারত একত্রে কোনো এশীয় ইউনিয়ন গড়ে তুলতে আগ্রহী নয়। চীনের সাথে সম্প্রতি জাপানের দূরত্ব আবার অনেক বেড়েছে। অন্য দিকে ভারত চীনের চেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই পেতে চাচ্ছে মিত্র হিসেবে। চীন-ভারত বিরোধের একটা বড় কারণ এখনো হয়ে আছে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ, যা সহজে মিটবার নয়। ১৯১১ সালে চীনে শেষ হয় মাঞ্চু রাজবংশের রাজত্ব। ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠা পায় চীন প্রজাতন্ত্র। যার প্রেসিডেন্ট হন, সান-ইয়াৎ-সেন। ১৯১৪ সালে ভারতের সিমলায় একটি সমেলন অনুষ্ঠিত হয় তদানীন্তন ব্রিটিশ-ভারত, চীন ও তিব্বতের প্রতিনিধিদের মধ্যে। এই সমেলনে ব্রিটিশ-ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন ম্যাক মাহন। তিনি রচনা করেন একটি সীমান্ত রেখা, যা পরিচিত হয়ে আছে ম্যাক মাহন সীমান্ত রেখা হিসেবে। তিব্বতের প্রতিনিধি এই সীমান্ত রেখাকে মেনে নেয়। কিন্তু চীনের প্রতিনিধি এই সীমারেখাকে স্বীকৃতি প্রদান করেননি। হিমালয় অঞ্চলে চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধের উদ্ভব হতে পেরেছে এই ম্যাক মাহন রেখাকে ঘিরে। সাবেক কাশ্মীরের একটি জেলাকে বলা হতো লাদাখ। এই অঞ্চল কাশ্মীরের রাজা এক সময় দখল করেছিল। কিন্তু  এটা আসলে হলো তিব্বতের অংশ। এখানে যারা বাস করে, তারা সবাই কথা বলে তিব্বতীয় উপভাষায়। আর তারা ধর্মে হলো লামা বৌদ্ধ। চীন এই অঞ্চলকে চীনের অংশ বলে মনে করেছে। চীন এর মধ্যে দিয়ে বানায় একটি মহাসড়ক, তার সিংকিয়াং (জিংজিয়াং) প্রদেশে যাওয়ার জন্য। আর এই সড়কের কাছে নির্মাণ করে কিছু সামরিক স্থাপনা। ভারত এতে প্রথমে প্রতিবাদ করেনি। পরে বলে চীনের সামরিক স্থাপনা সরাতে এবং সড়কটি বন্ধ করতে। চীন এতে রাজি হয় নি। ভারত ১৯৬২ সালে চীনের সামরিক স্থাপনায় আক্রমণ চালায়। ফলে ১৯৬২ সালে বাধে চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ। ভারত এই যুদ্ধে হারে। চীন দখল করে নেয় লাদাখ অঞ্চলের প্রায় এক হাজার ২০০ বর্গমাইল জায়গা। যা সে এখনো ছাড়েনি। লাদাখের কাছ ঘেঁষে হলো বাল্টিস্তান । বাল্টিস্তান তখন আজাদ কাশ্মীরের অংশ। শোনা যাচ্ছে চীন নাকি বাল্টিস্তানে সৈন্য পাঠিয়েছে। ১৯৬২ সালে যুদ্ধ হয় পূর্ব হিমালয় সীমান্তে ও। ভারতের তখনকার আসাম প্রদেশের একটি অংশকে বলা হতো নিফা। ১৯৭২ সালে নিফাকে পৃথক করা হয়েছে। তাকে দেয়া হয়েছে ভারতের একটা প্রদেশের মর্যাদা। আর এই প্রদেশের নামকরণ করা হয়েছে অরুণাচল। অরুণাচলের রাজধানীর নাম হলো ইটানগর। অরুণাচলের পশ্চিমে হলো ভুটান। উত্তরে হলো তিব্বত এবং খাস চীন। আর দক্ষিণে হলো আসাম। আর পূর্বে মিয়ানমার। এটি একটি জনবিরল প্রদেশ। ১৯৬২ সালে হয়েছিল এই অঞ্চলে যুদ্ধ। ভারতীয় সৈন্য এখানেও যুদ্ধে হারে। অরুনাচলের বিরাট অংশ চীন দখল করে যে কারণেই হোক পরে আবার ছেড়ে দেয়। তবে এই অঞ্চলে চীন এখনো দাবি করছে ম্যাক মাহন সীমান্ত রেখার দক্ষিণে প্রায় ৩০ হাজার বর্গমাইল ভূমি। এই সীমান্ত বিশেষভাবে হয়ে আছে অপষ্ট। এখানকার বাসিন্দা বেশির ভাগ হলো তিব্বতিদের মতোই। চীনা সৈন্য এখন অবস্থান করছে ম্যাক মাহন রেখা থেকে সাড়ে ১২ মাইল দূরে। ভারতীয় সৈন্য অবস্থান করছে ম্যাক মাহন সীমারেখা থেকে সাড়ে ১২ মাইল দক্ষিণে।
১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর থেকে পাকিস্তান চেয়েছে চীনের সাথে বিশেষ দক্ষতার বন্ধনে আবদ্ধ হতে। সে আজাদ কাশ্মীর সীমান্তে ১৯৬৩ সালে চীনের সাথে বিশেষ সীমান্ত চুক্তি করে। ভারত এই চুক্তিকে বলেছে বেআইনি। ১৯৭১ সালে চীন চায়নি সাবেক পাকিস্তান ভেঙে যাক। সে চেয়েছে সাবেক পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে বজায় রাখতে। আর এর জন্য তদানীন্তন পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীকে অনুরোধ করেছে একটি রাজনৈতিক সমাধানে আসতে। নিষেধ করেছে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ওপর নির্যাতন চালাতে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, জেনারেল নিয়াজি তার জবানবন্দীতে চীনের এই ইচ্ছার কথা বিশেষভাবে বিবৃত করেছেন। চীনপন্থী বলে কথিত কমিউনিটরা ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে চিহ্নিত করেছিল ‘দুই কুকুরের লড়াই’ হিসেবে। তারা গ্রহণ করেছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অনেক জায়গা দখল করে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। যত কারণে ভারত সরকার চেয়েছে পাকিস্তানের সাথে সরাসরি যুদ্ধ করে তার পূর্বাঞ্চল দখল করতে। তার মধ্যে একটা বড় কারণ হলো, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের চীনপন্থী কমিউনিটদের উত্থানভীতি। ভারতের কাছে আলবদর, রাজাকার ও আলসামসের মতো কোনো গোষ্ঠী কিছুমাত্র ভীতির কারণই ছিল না। ভারত তার নীতিনির্ধারণে এদের কোনো বিবেচনার মধ্যেই গ্রহণ করেনি। কিন্তু বিবেচনার মধ্যে গ্রহণ করেছে চীনপন্থী কমিউনিষ্টদের। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত আশা করেছিল চীন তাদের হয়ে ভারতের বিপক্ষে যুুদ্ধ করবে। কিন্তুু চীন তা করেনি। কারণ তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের সাথে করেছিল ২৫ বছরের বিশেষ মৈত্রী চুক্তি। চীন চায়নি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুদ্ধে জড়াতে। কিন্তু তবু সে যতটা পেরেছে সাহায্য করেছে পাকিস্তান সরকারকে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকারকে শেষ পর্যন্ত সাহায্য করতে এগিয়ে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সে বঙ্গোপসাগরে পাঠায় তার সপ্তম নৌবহরের যুুদ্ধ জাহাজ। শোনা যায় মার্কিন চাপেই ভারত বাধ্য হয়েছিল ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। ১৯৭১ সালে কলকাতায় অনেক কথা যাচ্ছিল। আরো অনেক রকম কথাই শুনতে পেয়েছিল এ শহরের মানুষ। ১৯৭১ সালের পরিস্থিতি ছিল যথেষ্ট জটিল। এখন যত সহজ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা হচ্ছে, আসল ইতিহাস ঠিক তেমন ছিল বলে ভাববার কিছু নেই। বাংলাদেশকে নিয়ে চলেছিল ভারত, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিশেষ দ্বন্দ¡। সোভিয়েত ইউনিয়ন চেয়েছিল ভারত মহাসাগরে তার কর্তৃত্ব। আর এই জন্য চেয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ন্ত্রণের বিশেষ অধিকার। ভারত সরকার এটা দিতে স্বীকৃত হয়েছিল। সবাই চেয়েছিল নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধার করতে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান হয়ে উঠেছিল বিশেষ বিবেচ্য।
এখন বিশ্বরাজনীতির ধারা বদলে গিয়েছে। ভেঙে পড়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। কমিউনিজম এখন আর কোনো বিশ্বজনীন রাজনৈতিক সমস্যা নয়। রাশিয়ার কমিউনিষ্টরা আর রাষ্ট্রক্ষমতায় নেই। চীনে কমিউনিষ্ট পার্টি এখনো ক্ষমতায় আছে। কিন্তু তারা আর এখন চাচ্ছে না বিশ্বজুড়ে কমিউনিষ্ট বিপ্লব ঘটাতে। চীনের কমিউনিষ্ট পার্টি হয়ে উঠেছে একটা উগ্র জাতীয়তাবাদী দল। যার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে চীনকে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করা। চীনের কমিউনিষ্টরা অবশ্য আগাগোড়া দেখিয়েছে চীনা জাতীয়তাবাদী মনোভাব। চীন চেয়েছে সামরিক প্রযুক্তিতে স্বয়ম্ভর হতে। চীন তার প্রথম পারমাণবিক বোমার বিফোরণ ঘটায় ১৯৬৫ সালে। এরপর সে তার হাইড্রোজেন বোমার বিফোরণ ঘটায় ১৯৬৭ সালে। রাশিয়া চেয়েছিল পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে চীন থাকুক রুশ প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে। কিন্তু চীন তা মানতে রাজি হয়নি। সে চেয়েছে এই ক্ষেত্রে স্বাবলম্বী হতে। চীন পারমাণবিক রিঅ্যাক্টার কিনতে চাচ্ছে না বিদেশের কাছ থেকে। সে আর কিনছে না সামরিক সম্ভার অন্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে, যেমন কিনছে ভারত। চীন তার সামরিক প্রয়োজন এখন নিজেই পূরণ করতে সক্ষম। চীনের বিশাল এই সামরিক শক্তিকে ভয় করছে জাপান। ভয় করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা এশিয়াতে শক্তির ভারসাম্য সৃষ্টির চেষ্টা করছে ভারতকে শক্তিশালী করে। আর ভারত এতে যথেষ্ট উৎসাহী হয়ে উঠেছে। চীন চুপ করে বসে নেই। সে বর্তমান পাকিস্তানের সাথে ইতোমধ্যেই গড়ে তুলেছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। শোনা যাচ্ছে বেলুচিস্তানে চীন গড়ছে নৌঘাটি। শ্রীলঙ্কায় সে নৌঘাটি গড়ছে। নেপালে চীনের প্রভাব এখন ভারতের তুলনায় কম নয়। চীন আফ্রিকার একাধিক দেশে ঘটাতে পেরেছে তার বাণিজ্য-সম্প্রসারণ। চীন বাংলাদেশের সাথে চাচ্ছে বিশেষ সম্পর্ক গড়তে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমন যে, এর মধ্যে দিয়ে সৈন্য ও সমর উপকরণ পাঠিয়ে চীনের হিমালয় সীমান্তকে অনেক সহজে নিরাপদ করা সম্ভব। চীন চাচ্ছে তার হিমালয় সীমান্তের বিশেষ নিরাপত্তা। আর তাই সে চাচ্ছে না বাংলাদেশ থাকুক ভারত-মার্কিন প্রভাব বলয়ে। বাংলাদেশের দু’টি বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। বিএনপি নেত্রীকে সফরে আমন্ত্রণ জানিয়ে চীনের কমিউনিট পার্টি ব্যক্ত করতে চেয়েছে যে, বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রনীতি তার কাছে বাঞ্ছিত নয়। বাংলাদেশের উচিত হবে চীন-ভারত দ্বন্দে¡ জড়িয়ে না পড়া। বর্তমান পরিস্থিতে বাংলাদেশের মনে হয় উচিত হবে ভারত ও চীন, এই উভয় রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিরপেক্ষ থাকার অধিকারের স্বীকৃতি। বাংলাদেশ দু’টি বৃহৎ রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দে¡র কোনো আংশীদার হতে পারে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় ১৯৪৫ সালে। কিন্তু  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও হয়েছে আরো অনেক যুদ্ধ। এর মধ্যে কোরিয়ার যুদ্ধের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল ধরে হয়েছিল কোরিয়ার যুদ্ধ। যাতে মার্কিন সৈন্য হতাহত হয়েছিল ১৪ লাখ দুই হাজার এবং ব্রিটিশ সৈন্য হতাহত হয়েছিল চার হাজার ৪৫১ জন। চীনের কত সৈন্য হতাহত হয়েছিল তার হিসাব আমাদের জানা নাই। কোরিয়া নিয়ে আবার কোনো যুদ্ধে চীন জড়িয়ে পড়তেই পারে। আর সে ক্ষেত্রে যুদ্ধ নিশ্চয় নেবে ১৯৫০-এর দশকের চেয়ে আরো ভয়াবহ রূপ। তবে আপাতত মনে হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে না ওই অঞ্চলে কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে। চীনের সাথে সরাসরি আপাতত যুদ্ধ চাচ্ছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করছে মধ্যপ্রাচ্যে। যুদ্ধ করছে আফগানিস্তানে। যুদ্ধের আর সম্প্রসারণ তার পক্ষে এখনই উপযুক্ত হবে মনে হচ্ছে না। ১৯৫০-এর দশকে চীনের হাতে পারমাণবিক বোমা ছিল না। ছিল না হাইড্রোজেন বোমা। কিন্তু চীন এখন অস্ত্রের দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অপেক্ষা খুব কম অগ্রসর হয়ে নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন চলেছে অর্থনৈতিক মন্দা। সে দেশে বেকারের হার দাঁড়িয়েছে প্রায় শতকরা ১০ ভাগ। যুদ্ধ বেকার সমস্যা সমাধানে এবং অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে কিছুটা সহায়তা করে। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মার্কিন অর্থনীতির মহামন্দাকে কাটাতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু বর্তমানে যুদ্ধ হলো খুবই বিপজ্জনক পন্থা। মার্কিন যুুক্তরাষ্ট্রকে তাই ভাবতে হচ্ছে এ ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা ভিন্নভাবে।

0 comments:

Post a Comment