Monday, April 23, 2018

স্মরণ : নলিনী দাস

স্মরণ : নলিনী দাস
আলী ফোরকান
জš§ : ১৯১০ সালের ১ জানুয়ারি
মৃত্যু : ১৯৮২ সালের ১৯ জুন 
নলিনী দাস ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের বিপ্লবী। নলিনী দাস, একটি বিপ্লব ও সংগ্রামের নাম। যে নামটি শুনলে কল্পনায় ভেসে ওঠে বিপ্লবী জীবনের প্রতিচ্ছবি, ফাঁসির দৃশ্য ও আন্দামান সেলুলার জেলের নিষ্ঠুর-নির্মম নির্যাতন এবং মৃত্যু। চট্টগ্রামের সূর্য সেন, বরিশালের নলিনী দাস ছিলেন ব্রিটিশরাজের আতঙ্ক। এই দুজনকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দেয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকার ৫ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ১৯১০ সালের ১ জানুয়ারি নলিনী দাস ভোলা জেলার সাহবাজপুরে জš§গ্রহণ করেন। পিতা দুর্গামোহন দাস। নলিনী দাসের শিক্ষাজীবন শুরু ভোলাতে। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় হরতাল ধর্মঘটে যোগ দিয়ে কারাবরণ করেন। ১৯২৮ সালে ভোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করে বরিশাল বি. এম. কলেজে আই.এস.সি. ক্লাসে ভর্তি হন। বরিশালে সে সময় তিনি একজন ভালো ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। পরীক্ষার আগেই মামলা পড়ায় আর পরীক্ষা দিতে পারেননি। ১৯২৯ সনে মেছুয়াবাজার বোমার মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে তিনি আত্মগোপন করেন। পলাতক অবস্থায় ১৯৩০ সনে কলকাতার পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট সাহেবকে হত্যা-প্রচেষ্টা মামলায় গ্রেফতার হন। ১৯৩১ খ্রি. হিজলি ক্যাম্পে রাজবন্দিদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণকালে তিনি সেখানে ছিলেন। ওই বছর ডিসেম্বর মাসে তিনি ও ফণী দাশগুপ্ত হিজলি জেল থেকে পলায়ন করেন। পলাতক অবস্থায় ১৯৩২ খ্রি. ফরাসি অধিকৃত চন্দননগরে যে বাড়িতে তিনি ও বিপ্লবী দীনেশ মজুমদার ও বীরেন রায় থাকতেন তা পুলিশ ঘেরাও করলে তারা ৪ ঘণ্টাব্যাপী লড়াই করেন। এই খণ্ডযুদ্ধে চন্দননগর পুলিশ কমিশনার কিউ সাহেব নিহত, বীরেন রায় ধৃত এবং নলিনী দাস ও দীনেশ মজুমদার আহত অবস্থায় পালাতে সক্ষম হন। ১৯৩৩ খ্রি. কলকাতার এক বাড়িতে পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে আহত হয়ে অন্য বিপ্লবীদের সঙ্গে তিনি ধরা পড়ে জগদানন্দ মুখার্জিসহ যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ডে দণ্ডিত হয়ে ১৯৩৪ খ্রি. আন্দামানে প্রেরিত হন। এই মামলায় দীনেশ মজুমদারের ফাঁসি হয়। আন্দোলনের চাপে সরকার ১৯৩৮ খ্রি. আন্দামান থেকে তাদের কলকাতায় ফিরিয়ে আনলেও ৩০ জন রাজবন্দিসহ তাকে ‘ভয়ানক বিপ্লবী ব্যক্তি’রূপে চিহ্নিত করে সেপ্টেম্বর ১৯৪৬ খ্রি. পর্যন্ত কারাগারে আটক রাখে। মুক্তি পেয়েই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নিষ্ঠাবান কর্মী হিসেবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-বিধ্বস্ত কলকাতায় প্রতিরোধ কমিটির কাজে তৎপর হয়ে ওঠেন। দেশ বিভাগের পর বরিশালে চলে যান। তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে ভোলায় কৃষক আন্দোলনের কাজে সংশ্লিষ্ট থাকায় ১৯৫০ খ্রি. পাক সরকার কর্তৃক গ্রেফতার হয়ে ১৯৫৬ খ্রি. যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার আমলে ছাড়া পান। শুধু কৃষক আন্দোলনে নয়, পশ্চিম-পাকিস্তানের আধিপত্য থেকে মুক্তি পাবার জন্য সেখানে যে গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী শক্তি সংগঠিত হচ্ছিল তারও তিনি সক্রিয় অগ্রণী কর্মী ছিলেন। ১৯৫৯ খ্রি. আইয়ুুব খানের ক্ষমতা দখল ও সামরিক আইন জারির পর তিনি আত্মগোপন করেন। তার রচিত ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে দ্বীপান্তরের বন্দি’ গ্রন্থে তার দীর্ঘ ২৩ বছরের কারাবাস ও ২০/২১ বছরের পলাতক জীবনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। শুধু অগ্নিযুগের সশস্ত্র বিপ্লববাদী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনই নয়, ১৯৪৭- এ দেশ ভাগের পরে ’৭১র ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সারির সংগঠকদের মধ্যেও তিনি ছিলেন উল্লেখযোগ্য। ১৯৭২-৮২ সাল পর্যন্ত দেশ গড়ার কাজে গণমানুষের মধ্যে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। ১৯৮২ সালের ১৯ জুন দেশমাতৃকা ও দেশের মানুষের সার্বিক মুক্তির আন্দোলনে নিবেদিত প্রাণ কমরেড নলিনী দাস মৃত্যুবরণ করেন।

0 comments:

Post a Comment