Friday, December 27, 2013

রুপালি আঁশও বিপুল সম্ভাবনাময়

রুপালি আঁশও বিপুল সম্ভাবনাময়
ড.ফোরকান আলী
সোনালি আঁশ পাট অদূর ভবিষ্যতে বৃহত্তর অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করবে। একদার সোনালি আঁশ পাট প্রসঙ্গে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেেিত আজ বলা চলে। বাংলাদেশের মানুষ পাটের সুদিন দেখেছে, দুর্দিনও। এখন আবার কার্যকর সরকারি প্রণোদনা-সমর্থনে আশান্বিত হয়ে অপো করছে অতীতের। অপরদিকে বাংলাদেশে কৃষি-শিল্প-অর্থনীতিতে তুলার যথার্থ সম্ভাবনাময় ব্যবহারিক দিকটি এখনো প্রায় অপরিচিত। এমন পরিস্থিতিতে, আলোচনার শুরুতেই পাট এবং তুলার তুলনামূলক কিছু কথা বলা দরকার।
বাংলাদেশে উৎপাদিত পাটের একটা বড় অংশই ‘কাঁচা পাট’ হিসেবে রপ্তানি করতে হয়, কারণ উৎপাদিত সমুদয় পাট দেশীয় পাট-শিল্পে ব্যবহার করা অতীতে সম্ভব হয় না। যদি পাট-শিল্পের কার্যকর বিকাশ ঘটিয়ে উৎপাদিত দেশীয় কল-কারখানায় সমুদয় পাটই ব্যবহার করা যায়, তাহলে পাটজাত পণ্য রপ্তানি ব্যাপকভাবেই বাড়াতে হবে। কিন্তু পাটজাত পণ্য রপ্তানির বিষয়টাও আমদানিকারক দেশের চাহিদা এবং অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল থাকবে। পাটের সুদিনে, বিগত সত্তর-আশি দশক পর্যন্ত বাংলাদেশে বার্ষিক মোটামুটি ২০ লাখ একর জমিতে ৬০ লাখ বেল পাট উৎপাদিত হতো। দেশের ছোট-বড় ১০২টি পাটকলের সর্বোচ্চ ব্যবহার-মতা ছিল ৩৪ লাখ বেল, কাঁচা পাট রপ্তানি কমবেশি ১৫ লাখ বেল এবং সাংবাৎসরিক আপৎকালীন মজুদ ১০-১২ লাখ বেল। কিন্তু তখন বিশ্বজুড়েই প্যাকেজিং-পরিবহনে বহুমুখী নতুন প্রযুক্তির প্রচলন এবং সিন্থেটিকের ব্যবহার বাড়তে থাকায় পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা দারুণভাবে কমে গিয়েছিল। তখন হতাশ কৃষকরা পাটের আবাদ কমিয়েছেন আর অনন্যোপায় সরকার বন্ধ করেছেন পাটকল। মনে রাখতেই হবে, পাট-অর্থনীতির বিকাশ-বিস্তার কার্যতই বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল এবং থাকবে ভবিষ্যতেও। সুতরাং দেশে পাটের উৎপাদন এবং শিল্প-বাণিজ্য বিকাশের পরিমাণগত সম্ভাবনাকে স্বল্প এবং মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ না করলে আবার বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
এবার তুলার সম্ভাবনার কথায় আসা যাক। গত ২৯ জুন, ১০ইং তারিখে কটন বোর্ডের সভায় বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পের সামগ্রিক বিপুলতার উল্লেখ করে বলেছেন, বর্তমানে ৩৫০টি বস্ত্রকল, ১ হাজার ৬২৩টি উইভিং মিল, তিন লাধিক হস্তচালিত তাঁত, ২ হাজার ৮২২টি নিটিং, ৩৫৯টি ওয়েট প্রসেসিং এবং ৪ হাজার ৫০০টি গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে। বার্ষিক প্রায় ১ হাজার ৩০০ কেজি বস্ত্রের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েও প্রচুর পরিমাণে বস্ত্র বিদেশে রপ্তানি করা যাচ্ছে। এখন তৈরি পোশাক শিল্পই রপ্তানি আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস, বার্ষিক রপ্তানি আয়ের পরিমাণ মোট ১৩.০৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বস্ত্রশিল্প খাতে ৫০ লাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। কিন্তু এ বিপুল সম্ভাবনাময় শিল্প-খাতের পেছনের প্রধান দুর্বলতার দিকটি, ‘তুলার উৎপাদনে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। এজন্য আমাদের আমদানি-নির্ভরতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে’ উল্লেখ করেই তিনি এ বিষয়ে যথাশিগগির এবং যথোপযুক্ত মনোযোগ দেয়ার অপরিহার্য প্রয়োজনের কথা বলেছেন।
দেশীয় বস্ত্রশিল্পের চাহিদা মিটাতে ‘প্রতি বছর ৪০ লাখ বেল তুলা আমদানি করতে হয়। যার মোট মূল্য প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা।ঃদেশে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে তুলা চাষ করে প্রায় ৭০ হাজার বেল তুলা উৎপাদন হয়। দেশের চাহিদার তুলনায় এ উৎপাদন শতকরা ৫ ভাগ মাত্র।ঃউৎপাদিত তুলার মূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা’। এসব তথ্য বিবেচনায় রাখলেই ভবিষ্যতের করণীয় নির্ধারণ সহজ হতে পারে। ক্রমবর্ধমান পরিমাণ আমদানিকৃত তুলার ওপর নির্ভর করে আমাদের বিপুল সম্ভাবনাময় বস্ত্রশিল্পকে যে বেশি দূর টেনে নেয়া সম্ভব নয়Ñ এ তথ্য-সত্যের বাস্তবতার নিরীখেই ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তুলা (এবং সুতাও) আমদানির স্পর্শকাতরতা’ এবং বিরাট ঝুঁকির দিকটা সংশ্লিষ্ট সকলকেই উপলব্ধি করতে হবে। ‘সাধারণ মানুষ টের না পেলেও সুতাকল মালিক, নিট পোশাক, ডেনিম পোশাক রপ্তানিকারক ও তাঁতিরা ঠিকই টের পান তুলার সংকট। এবার ভারত থেকে তুলা রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় এক সপ্তাহে সুতার দাম বেড়েছে ১০-১৫% পর্যন্ত’ (প্র.আ, ২৫-০৪-১০)।
‘দেশীয় বস্ত্রশিল্পকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে দেশে তুলার উৎপাদন বৃদ্ধি করা খুবই জরুরি। দেশীয় তুলার দ্বারা যদি বস্ত্রশিল্পের চাহিদার ১০% পূরণ করা যায়, তাহলেও তা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বলে গণ্য হবে।ঃতুলা উৎপাদন বৃদ্ধির েেত্র নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। জমির স্বল্পতাঃ বিরূপ আবহাওয়া, উফশী জাতের অভাব, অধিক উৎপাদন খরচ ও অন্য ফসলের তুলনায় বীজ-তুলার দাম কম।ঃ সে কারণে তুলার উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য হেক্টর প্রতি ফলন বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন।ঃ আমরা জানতে পেরেছি, হাইব্রিড ও বিটি কটনের চাষ করে চীন ও ভারত তুলার ফলন বহুলাংশে বৃদ্ধি করতে সম হয়েছে। আমাদের দেশে হাইব্রিড ও বিটি কটনের চাষ সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।ঃ বিশ্বব্যাপী তুলা একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্যরূপে পরিগণিত। তুলার স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব না হলে দেশীয় বস্ত্রশিল্পের টেকসই অগ্রগতি সম্ভব নয়’। মাননীয় মন্ত্রীর বাস্তবসম্মত দিকনির্দেশনার আলোকেই তুলার উৎপাদন বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
সাধারণ কৃষিতাত্ত্বিক বিবেচনায় বলা চলে, প্রায় সমগ্র দেশজুড়েই তুলার আবাদ করা সম্ভব। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষিতে ফসল-বৈচিত্র্য বৃদ্ধির গুরুত্ব বিবেচনা করেও তুলার আবাদ সম্প্রসারণের কার্যকর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। মন্ত্রী মহোদয় যথার্থই বলেছেন, বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমিয়ে তুলার দিকে মনোযোগ দেয়া সম্ভব নয়। এ বাবদে প্রচলিত উফশী ধানের চেয়ে অধিকতর উচ্চ ফলনের হাইব্রিড ধানের আবাদ বাড়িয়ে, খাদ্যোৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করেও তুলার জন্য জমির সংস্থান করা সম্ভব হতে পারে। যথার্থ উচ্চ ফলনশীল উন্নতমানের তুলার আবাদ বাড়িয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ল্য অর্জন করা যাবে। প্রথমত, কৃষকের প্রত্য আয় বৃদ্ধি এবং দ্বিতীয়ত, তুলার জমিতে সাথী-ফসল হিসেবে বিভিন্ন শাক-সবজির আবাদ বাড়িয়ে, কৃষকের বর্ধিত আয়ের পাশাপাশি জনগণের পুষ্টি চাহিদা পূরণ। সর্বোপরি তুলা উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে বস্ত্রশিল্প খাতের প্রধান কাঁচামাল তুলা আমদানি হ্রাসের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় করা যাবে। আমরা জানি, চাহিদা মতো তুলার উৎপাদনে স্বনির্ভর হওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু এ কথাও অনস্বীকার্য যে, দেশে তুলার আবাদ এবং ফলন যতোটা বাড়ানো যাবে, ততোটাই উপকৃত হবে আমাদের বস্ত্র ও পোশাকশিল্প এবং একইসাথে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটবে কৃষিখাতেও। একান্ত বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিকোণ থেকেই মন্ত্রী মহোদয়, বর্তমান পর্যায়ে দেশে তুলার চাহিদার ৫% পূরণের অবস্থাকে মাত্র ১০% পর্যন্ত বাড়ানোর কথা বলেছেন।
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ তুলা উন্নয়ন বোর্ডের পরিকল্পিত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কৃষক পর্যায়ে বিশেষ লাভজনক প্রতিপন্ন না হওয়াতে তুলার আবাদ প্রত্যাশিত মাত্রায় বাড়েনি বরং কমে যাবারও আশঙ্কা থাকে। উল্লেখ্য যে, ২০০৭-০৮ইং প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হলেও ২০০৮-০৯ইং আবাদ কমে দাঁড়িয়েছিল ৩১ হাজার ৫০০ হেক্টর। মানতেই হবে, আকর্ষণীয়ভাবে লাভজনক প্রতিপন্ন হলেই কৃষক পর্যায়ে তুলার আবাদের আগ্রহ সৃষ্টি করা সম্ভব হতে পারে। এমন প্রোপটেই ২০০৮-০৯ইং বছরে মোট আবাদকৃত ৩১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির মাত্র ২০০ হেক্টরে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো হাইব্রিড তুলার আবাদ করা হয়েছিল। এ বাবদে অর্জিত অভিজ্ঞতা হচ্ছে, সুপ্রিম সীড কোম্পানি নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ‘রূপালী-১’ (গণচীন থেকে আমদানিকৃত ঐঝঈ-৪) হাইব্রিড তুলা কৃষক পর্যায়ে যথার্থই লাভজনক এবং সম্ভাবনাময় বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। কোম্পানির তথ্যসূত্রে প্রকাশ, প্রদর্শনীমূলক খামারের মাধ্যমে সুপ্রিম সীড কোম্পানির হীরা হাইব্রিড ‘রূপালী-১’ তুলা আবাদের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে তুলার আবাদ বৃদ্ধির নির্ভরযোগ্য সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
এ যাবৎ বাংলাদেশ কটন বোর্ডের উদ্যোগে মুক্তপরাগায়িত সিবি-১, ৩, ৫, ৮, ৯ এবং ১০ জাতের তুলার আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে সিবি-৯ জাতটি সর্বোচ্চ ফলনশীল বলেই সর্বাধিক জনপ্রিয়। এখানে প্রসঙ্গতই প্রচলিত ‘সিবি-৯’ এবং হাইব্রিড ‘রূপালী-১’ জাত দুটির তুলনামূলক উপযোগিতার তথ্য উল্লেখ করা যেতে পারে।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনার তুলনামূলক বিচারে বলা চলে, বাংলাদেশের পাট-খাতের অবদান উল্লেখযোগ্যভাবেই রপ্তানি তথা অন্যদেশের ওপর নির্ভরশীল থাকবে। অথচ তুলার উৎপাদন যতোই বাড়ানো হোক, আমদানি কমিয়ে উৎপাদিত সব তুলাই সরাসরি দেশের বস্ত্র-খাতে ব্যবহার করা যাবে, এেেত্র পরনির্ভরতা কমবে এবং আত্মনির্ভরতার প্রত্যাশিত ভিত্তিটাই ক্রমশ প্রসারিত হবে ।


0 comments:

Post a Comment