Tuesday, October 8, 2013

ঈদ-উল-আযহার ত্যাগ ও মহিমা


ঈদ-উল-আযহার ত্যাগ ও মহিমা
  ফোরকান আলী
পবিত্র ঈদ-উল-আযহা। কুরবানির ঈদ। মুসলমানদের দ্বিতীয় ধর্মীয় উৎসব। ঈদ বা আনন্দ উদযাপনের দিন। ত্যাগ ও মহিমার দিন। ত্যাগ এই অর্থে যে, এ দিনে সবচেয়ে প্রিয়বস্তুকে কুরবানি করার ইতিহাস রচিত হয়েছে। মিল্লাতে আবা ইব্রাহীম বা মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) প্রথম এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূল। ঈমানের অগ্নিপরীায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি খলিলুল্লাহ বা আল্লাহর দোস্ত উপাধি লাভ করেন। তিনি তার মূর্তিশিল্পী ও মূর্তিপূজারী পিতার ন্যায় চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, তারা, নত্র ইত্যাদি নহে, বরং আসলামতু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ ঘোষণার দীপ্ত আবেগে তিনি এক আল্লাহর রাহে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ইব্রাহিমের (আঃ) ঈমান পরীার জন্য মহান আল্লাহ্ একদিন ইব্রাহিমকে (আঃ) স্বপ্নাদেশে তার প্রিয়পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ)কে কুরবানি করতে বললেন। বহু বহু বছরের দীর্ঘ অপোর পর আল্লাহর মেহেরবানীতে তিনি ৮৬ বৎসর বয়সে একমাত্র পুত্র সন্তান লাভ করেছিলেন। কিন্তু ঈমানের এ পরীায়ও তিনি উত্তীর্ণ হন। মিনায় হযরত ইসমাইল (আঃ)-কে কুরবানি করতে গিয়ে স্নেহাধিক পুত্র কিংবা প্রাণাধিক স্ত্রী মা হাজেরা (রাঃ) ধৈর্য ধারন করেন। তাঁরা আল্লাহর নির্দেশ জেনে বরং নিজেকে আত্মোৎসর্গ করতে পেরে তারাখুশি হয়েছিলেন। এটিই কুরবানি ঈদের শিা। এখানে ত্যাগটাই বড় কথা। অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টিকল্পে নিজের জান ও মালকে কুরবানি করতে সদাপ্রস্তুত থাকতে হবে। তাই পশু কুরবানির সময় এ আয়াতটি পাঠ করা হয়- ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন- অর্থাৎ নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও মরণ- সব কিছুই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানে নিবেদিত (৬ঃ১৬২)। আরবী মাসের দ্বাদশ মাস জিলহজ্ব। এ মাসে হজ্বের বিধান পালন করা হয় বলে এ নামকরণ হয়েছে। ইসলামের পঞ্চম রোকন হজ্বের একটি বিধান কুরবানি করা। এটি ওয়াজিব। এ প্রসঙ্গে নবী করীম (সঃ) ইরশাদ করেছেন, সামর্থ্য াকা সত্ত্বেও যে কুরবানি করবে না, সে যেন আমার ঈদগাহের ধারে কাছেও না আসে (মুসনাদে আহমদ ও ইবনে মাজাহ) ।মূলত:‘কুরব’ শব্দমূল  থেকে কুরবানি শব্দটির উৎপত্তি। যার অর্থ নৈকট্য। এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি হাসিল করা যায় বলে একে বলা হয় কুরবানি। ১০ জিলহজ্ব এ বিধানটি পালিত হয়। আর সে সঙ্গে মুসলিম জাহানে পালিত হয় কুরবানির ঈদ। তাই হজ্ব, কুরবানি ও ঈদ পরস্পর সম্পর্কিত। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, আমাদের দেশে কুরবানি নিয়ে বেশ কিছু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। এসব ভুল ধারণা দূর করতে মসজিদের ইমামগণ বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। কুরবানি যে কেউ ইচ্ছা করলে করতে পারে। কিন্তু শুধু মালেকে নিসাবের ওপরই কোরবানি ওয়াজিব। অর্থাৎ যাহার নিকট সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে ৫২ তোলা রৌপ্য অথবা ততোমূল্যের গচ্ছিত অর্থকড়ি নাই, তার ওপর কোন বাধ্যবাধকতা নয়। কিন্তু আমাদের দেশে সমস্যা হচেছ অন্যখানে। অনেকে নিজেদের অর্থসম্পদ, বংশ-গরিমা, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি প্রদর্শন করতেই যেন পশু কুরবানি দিয়ে থাকে। আবার এমন অনেক আছে যারা লোকচুর ভয়ে কিংবা লাজ-লজ্জায় ধার-কর্জ করে হলেও কুরবানি দিয়ে থাকে। কাউকে যেন এরূপ লজ্জায় পড়তে না হয় তা ভাবাও সমাজের কর্তব্য। এছাড়া কুরবানি করতে গিয়ে সাত শরীকের প্রত্যেকেরই নিয়ত সহিহ হওয়া বাঞ্ছনীয়। শুধু গোশত খাওয়ার নিয়ত থাকলে কারো কুরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য হাসিল হবে না। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে কুরবানির মাংস নিয়মানুযায়ী বিলি-বন্টন না করে ফ্রিজে রেখে দেওয়া হয়। এটাও ঠিক নয়। কুরবানির পশুকে নানা রঙে সজ্জিত করাও উচিত নয়। এনিয়ম আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে আরবে প্রচলিত ছিল। কুরবানির প্রচলন শুধু ইসলামে নয়, অন্যান্য ধর্মেও  রয়েছে। ইহুদীদের মতে কুরবানি মানে সাধারণ দিনের ন্যায় পশু জবাই করা। তবে তারা মাংস তিন ভাগ করে একভাগ নিজের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনের জন্য এবং তৃতীয় ভাগ সিনাগগ বা উপসনালয়ের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে। আবার খৃষ্ট ধর্মাবলম্বীদের মতে, কুরবানি মানে এক ধরনের পবিত্র নৈশভোজ। ইসলাম ধর্ম মতে কুরবানি হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর সময় থেকে পরিলতি হয়। পৃথিবীর প্রথম কুরবানি দিয়েছিলেন হাবিল ও কাবিল। যখন হাবিল ও কাবিল দুই ভাইয়ের মধ্যে বিবাদ চলছিল, তখন আদম (আঃ) তাদের প্রত্যেককে কুরবানি করতে বলেন এবং আল্লাহ হাবিলের কুরবানি কবুল করেন। আমাদের নিকট কুরবানি হচ্ছে আত্মশুদ্ধি, আত্মতৃপ্তি ও আত্মত্যাগের । কুরবানির শিা হচ্ছে পাপ ও অনাচার থেকে  রা পাওয়া । শয়তানের ওয়াসওয়াসা কিংবা রিপুর তাড়না দূর করাও কুরবানির অন্যতম শিা। কুরবানির আরেকটি সামাজিক শিা হচ্ছে পিতার আদেশ সন্তানের জন্য অবশ্যই পালনীয়। এছাড়া মুসলিম নারী, ভগ্নি ও স্ত্রীর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত বিবি হাজেরা (আঃ)। আমরা যেন ঈদ-উল-আযহার ত্যাগের আদর্শ হতে বিচ্যুত না হই।  মুসলমান হিসাবে তাই আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে হবে। কারণ আল্লাহর নিকট আমাদের কখনো কুরবানিকৃত পশুর রক্ত, মাংস, হাড় ইত্যাদি পৌঁছায় না। পৌঁছায় শুধু আমাদের আন্তরিকতা ও তাকওয়া বা খোদাভীতি।
হজ্ব ঃ রসুলের (সঃ) বাণী: ১. হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (সঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি এ ঘরে (অর্থাৎ কাবা ঘরে হজ্ব করতে) এলো, স্ত্রী গমন এবং কোনো প্রকার অশ্লীলতা ও ফিস্ক ফুজরীতে নিমজ্জিত হয়নি, তবে সেখান থেকে (এমন পবিত্র হয়ে) ফিরে আসে, যেমন নিষ্পাপ অবস্থায় মায়ের গর্ভ থেকে সে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলো। (মুসলিম)
২. আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসুল (সঃ) আমাদের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, হে লোকেরা, আল্লাহ তোমাদের জন্যে হজ্ব ফরজ করেছেন। অতএব হজ্ব কর। (মুনতাকী)
৩. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত রাসূলে করীম (সঃ) বলেছেন, তোমরা হজ্ব ও উমরা পর পর আদায় কর, কেননা এ দুটি কাজ দারিদ্র্য ও গুণাহ খাতা নিশ্চিত করে দেয়। যেমন রেত লোহার মরিচা ও স্বর্ণ-রৌপ্যের জঞ্জাল দূর করে দেয়। আর কবুল হওয়া হজ্বের সওয়াব জান্নাত ব্যতীত আর কিছুই নয়। (তিরমিযী, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ)
৪. হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, হজ্বের ইচ্ছা পোষণকারী যেন তাড়াতাড়ি তা সমাপন করে। কেননা সে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে, তার উট হারিয়ে যেতে পারে বা তার ইচ্ছা বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। (ইবনে মাজাহ)
৫. হযরত হাসান (রাঃ) হতে বর্ণিত, উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বলেছেন, আমার ইচ্ছে হয় এসব শহরে লোক পাঠিয়ে খবর নিই, যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্ব সমাপন করছে না এবং তাদের উপর জিযিয়া ধার্য করি। ওরা মুসলিম নয়, ওরা মুসলিম নয়। (মুনতাকী)
৬. হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সঃ) কে জিজ্ঞেস করা হল, কোন আমল অধিক উত্তম? তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান। জিজ্ঞেস করা হল অতঃপর কি? তিনি বললেন আল্লাহর পথে জিহাদ। জিজ্ঞেস করা হল তারপর কোন আমলটি সর্বোত্তম? বললেন, কবুল হওয়া হজ্ব। (বুখারী, মুসলিম)
পবিত্র কাবা শরীফ: মুসলমানদের কেবলা কাবা শরীফ। এ কাবা শরীফ মহান আল্লাহতায়ালার এক অপূর্ব সৃষ্টি। প্রতিবছর লাখ লাখ মুসলমান কাবাঘর তওয়াফ করতে মক্কা গমন করেন। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারা কাবাঘর নির্মাণ করে। কাবাঘরকে ল্য করে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সুরা আল-ইমরানের ৯৬ আয়াতে বলেন, “নিশ্চয়ই সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের ইবাদত গা রূপে নিরূপিত হয়েছে, তা ঐ ঘর যা মক্কাতে অবস্থিত”। কাবাঘরটি আল্লাহর আরশে মুয়াল্লাহর ছায়াতলে সোজাসুজি বাইতুল মামুরের আকৃতি অনুসারে স্থাপন করেন। হযরত আদম (আঃ) ও হযরত হাওয়া (আঃ) এর পৃথিবীতে মিলন হলে তারা উভয় আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ইবাদতের জন্য একটি মসজিদ হযরত আদম (আঃ) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করেন এবং বাইতুল মামুরের আকৃতিতে পবিত্র কাবাঘর স্থাপন করেন। এখানে হযরত আদম (আঃ) সন্তুষ্ট চিত্তে আল্লাহর ইবাদত করতে থাকেন (শোয়াব-উল-ঈমান, হাদিসগ্রন্থ)। আবার অনেক তফসীরবিদের মতে, মানব সৃষ্টির বহু আগে মাহন আল্লাহ তায়ালা কাবাঘর সৃষ্টি করেন। তফসীরবিদ মজাহিদ বলেন, “আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বাইতুল্লাহর স্থানকে সমগ্র ভূপৃষ্ঠ থেকে দুহাজার বছর আগে সৃষ্টি করেন”। মুসলিম শরিফের একটি হাদিসে হযরত আবু যর গিফারী হতে বর্ণনা হয়েছে, রাসুল (সঃ) এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “বিশ্বের সর্বপ্রথম মসজিদ হচ্ছে মসজিদে হারাম। এরপরের মসজিদ হচ্ছে মসজিদে আকসা। মসজিদে হারাম নির্মাণে ৪০ বছর পর মসজিদে আকসা নির্মিত হয়”। হযরত আদম (আঃ) কাবাঘর আল্লাহর আদেশে নির্মাণ করেন। এরপর বহুদিন অতিক্রম হয়েছে। শতশত বছর অতিবাহিত হয়েছে। আল্লাহর বান্দারা কাবাঘর জিয়ারত করতো, আল্লাহর কাছে হাজিরা দিতো এ কাবাঘরে সমবেত হয়ে। কাবাঘরে এসে মহান আল্লাহর পবিত্রতা ও অংশীদারহীনতা ঘোষণা দিত। “লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নেয়ামাতা, লাকাওয়ালা মুলক, লাশারিকা, লাকা লাব্বাইক”। এভাবে চলতে চলতে দিন গত হতে থাকলো। এরপর হযরত শীষ (আঃ) কাবাঘর পুনঃনির্মাণ করলেন। দিন দিন একাত্ববাদের সংখ্যা বাড়তে থাকল। এরপর কাবা শরীফ নির্মাণ বা পুনঃনির্মাণ করেন হযরত ইব্রাহীম (আঃ)। হযরত ইব্রাহীম (আঃ), হযরত ইসমাইল (আঃ)কে সাথে নিয়ে কাবাঘর নির্মাণ বা পুননির্মাণ করেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কাবাঘর সংস্কার করে আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন। “হে আমার প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে আজ্ঞাবহ কর, আমাদের বংশ থেকে একটি অনুগত দল সৃষ্টি কর, আমাদের হজ্বের রীতিনীতি বলে দাও এবং আমাদের মা কর। নিশ্চয়ই তুমি দয়ালু। হে প্রতিপালক! তাদের মধ্যে থেকেই তাদের কাছে একজন পয়গম্বর প্রেরণ করুন। যিনি তাদের কাছে তোমাদের আয়াত তেলাওয়াত করবেন। তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিা দিবেন এবং পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই তুমি মহাপরাক্রমশালী। এরপর কয়েকশ বছর পর পবিত্র কাবাঘর সংস্কার করে আমালিকা সম্প্রদায়। তারপর আরো শ শ বছর কিংবা হাজার বছর পরে কাবাঘর সংস্কার করে মক্কার জুরহাস সম্প্রদায়। আরবের অর্থাৎ মক্কায় যে সকল গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের প্রতিপত্তি ছিল, তাদের দায়িত্ব ছিল কাবাশরীফ রণাবেণের। এ দায়িত্ব পালনকে তারা সম্মানিত ও গর্বের মনের করতো। শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিবাহিত হয়। এর পর কাবা শরীফ ও কাবা ঘর সংস্কার করেন মোযার সম্প্রদায়। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) নবুয়ত প্রাপ্তির ৫ বছর আগে কাবাঘর সংস্কার করে মক্কার বিখ্যাত কোরাইশ বংশ। এ কোরাইশ বংশেই মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) ৫৭০ খ্রীঃ জন্মগ্রহণ করেন। কোরাইশরা কাবা শরীফ সংস্কারের পর হাযরে আসওয়াত স্থাপন নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়। সকলের সম্মতিক্রমে আল্লাহর রাসূল কাবাগৃহে হাযরে আসওয়াদ কাবা শরীফে স্থাপন করেন। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) জীবিত অবস্থায় ৬৪ হিজরীতে আবদুল্লাহ ইবনে জোবায়ের (রাঃ) কাবা শরীফ সংস্কার করেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ৭৪ হিজরীতে কাবা শরীফ সংস্কার করেন। সুদীর্ঘ ১৪শ বছরে কাবাগৃহে কোনো সংস্কারের প্রয়োজন হয়নি। শুধুমাত্র কাবাঘরের চারপাশে অবস্থিত মসজিদে হারামের পরিবর্ধন, সংস্কার বা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। কাবাঘরের রণাবেণের দায়িত্ব সৌদি রাজপরিবারের। সৌদি সরকারের প্রধান (বাদশাহ) কাবা শরীফের মোতোয়াল্লির দায়িত্ব পালন করে থাকে। ভৌগোলিক দিক দিয়ে মক্কা ও আরব উপদ্বীপ এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মধ্যস্থলে অবস্থিত। মক্কানগরীর পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে হওয়ায় মহান আল্লাহ কাবাঘর মক্কাতেই স্থাপন করেন। পবিত্র হজ্ব পালন করতে মাসের ১০ তারিখ ঈদুল আজহার দিন। এদিন কোরবানী দিতে হয়। যা হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর ও হযরত ইসমাইল (আঃ)-এর স্মৃতি বহন করে চলছে হাজার হাজার বছর ধরে। যমযম কূপও ঠিক তেমনি হযরত ইসমাইল (আঃ) ও তার মা বিবি হাজেরার (আঃ) স্মৃতি বহন করে চলছেন। এ যমযম কূপ মহান আল্লাহর কুদরতের অপরূপ মতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। হজ্ব মুসলমানদের ঈমানের অন্যতম স্তম্ভ। আরবের মক্কা নগরীর পবিত্র কাবাঘর হেফাজতের মালিক মহান আল্লাহ নিজে। বিশ্ব মুসলমানদের মিলন মেলা ঘটে হজ্বের মাধ্যমে পবিত্র কাবা শরীফে।
কোরবানির আগে ও পরের সতর্কতা: কোরবানি তো দিচ্ছেন কিন্তু কোরবানির আনুসাঙ্গিক সাবধানতাগুলো ঠিক ঠিক জানা আছে? তা না হলে কোরবানির আসল উদ্দেশ্যটাই ব্যহত হতে পারে। তাই সময় থাকতেই জেনে নিন কোরবানির সাবধানতাগুলো। কোরবানির হালাল পশু যে কোন ধরনের গরু, ছাগল, মহিষ কোরবানির জন্য বাছাই করলেই হবে না। ল্য রাখতে হবে এগুলো আপনার কোরবানির জন্য যোগ্য বা হালাল কিনা। কোরবানির পশু কেনবার আগে খানিকটা সতর্কতা অবলম্বন করলেই এ সমস্যা থেকে দূরে থাকা যায়। পশু কেনার প্রথমেই খেয়াল রাখতে হবে আপনার বাছাইকৃত পশুটির কোরবানির জন্য বয়স হয়েছে কিনা। অর্থাৎ পশুটি পূর্ণ বয়স্ক কিনা। আর এটা বুঝতে হলে আপনাকে গরুর দাঁত দেখতে হবে। কম বয়সী গরুর দাঁতের সংখ্যা চারটি এবং পূর্ণবয়স্ক গরুর আটটি দাঁত থাকে। এরপর আপনাকে ল্য রাখতে হবে কোরবানির পশুটি গর্ভবতী কিনা। প্রয়োজনে পশু হাসপাতালে পরীা করানো যেতে পারে। পশুর শিং ভাঙ্গা আছে কিনা অথবা অন্ধ কিংবা শরীরে কোন ধরনের ত-ঘা আছে কিনা। সেসব বিষয়ে পূর্ণ খেয়াল রাখতে হবে। সর্বোপরি কোরবানির পশুটি সুস্থ-সবল আছে কিনা তা ও খতিয়ে দেখতে হবে। এ ছাড়া  ল্য করতে হবে পশুটি স্বাভাবিক আচরণ অথবা ঝিমুচ্ছে কি না। যদি পশুটি ঝিমুতে থাকে অথবা খাবার ঠিক মতো না খায় তাহলে বুঝতে হবে পশুটি রোগাক্রান্ত।
কোরবানির পর্যন্ত পশুর  যতœ:কোরবানি পর্যন্ত পশুটির  যতœ-আত্তি করতে হবে। কারণ কোরবানির আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পশুটিকে সুস্থ-সবল রাখতে হবে। এজন্য পশুটিকে অবশ্যই বাসার শুকনো কোন জায়গায় রাখতে হবে। কোন মতেই একে ভেজা, কাদাযুক্ত বা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় রাখা যাবে না। পশুর রাখার জায়গায় প্রয়োজনে খড় বা চট দিতে পারেন। ত্রেবিশেষে শুকনো ভূসিও ছিটাতে পারেন। এখন যেহেতু শীতকাল তাই পশুকে শীতের হাত থেকে রার জন্য গায়ে মোটা ছালা বা চট দিতে পারেন। পশুটিকে নিয়মিত গোসলও করাতে হবে। কোরবানির পশুর থাকার সুব্যবস্থার পাশাপাশি খাবার দিকটাও দেখতে হবে। খড়ের পাশাপাশি পশুকে দানাদার খাবারও দেয়া যেতে পারে। ঘরের ভাতের মাড়ও দিতে পারেন ভুসির সঙ্গে গুলে। সঙ্গে প্রয়োজনমত লবণ দিয়ে দেবেন। আর সম্ভব হলে সবুজ ঘাসও খাওয়াতে পারেন।
পশুর চামড়ার সংরণ: কোরবানির পশুর চামড়া ছাড়ানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে চামড়ার কোন তি না হয়ে যায়। অসাবধানতাবশত চামড়ার কোন অংশের তি হলে বিক্রির সময় সঠিক মূল্যটি নাও পেতে পারেন। এজন্য পশুর চামড়া ছাড়ানোর কাজে ধারালো ছুরি ব্যবহার করা উচিত। চামড়া ছাড়ানো হয়ে গেলে দেখতে হবে সেখানে কোনরকম মাংস বা চর্বি লেগে আছে কিনা। যদি থেকে থাকে তাহলে তা সাবধানে ছুরি দিয়ে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। তারপর তা পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে হালকা রোদে শুকানো যেতে পারে। চামড়া ছাড়ানোর সাত থেকে আট ঘন্টার মধ্যে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। গরমকালে দুই থেকে তিন ঘন্টার মধ্যে এবং শীতকালে চার থেকে ছয় ঘন্টার চামড়া সংরণের ব্যবস্থা করতে হবে। কয়েকভাবে চামড়া সংরণ করা যায়। এর মধ্যে আছে লবণ পদ্ধতি, রোদ শুকানোর পদ্ধতি এবং হিমাগার পদ্ধতি। আপনার সুবিধামত এগুলো ব্যবহার করতে পারেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা:  অবশেষে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা যেহেতু আপনি দেশের সচেতন একজন নাগরিক আর তাই আপনি কোরবানির পরবর্তী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে অন্যান্যদের চেয়ে বেশি সচেতন। সেই সচেতনতা আরো খানিকটা বৃদ্ধি করতে আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি কোরবানি-উত্তর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার আরো কিছু বিষয়। প্রথমেই পশু জবাই করার সময় সংশ্লিষ্ট জায়গায় গর্ত করে নিতে পারেন। জবাই হয়ে গেলে সেই রক্ত মাটি চাপা দিয়ে দিন। আর গর্ত না করা গেলে জবাইকৃত পশুর রক্ত সঙ্গে সঙ্গে ধুয়ে ফেলুন। জবাই করবার জায়গাটি ব্লিচিং পাউডার অথবা অন্যান্য জীবাণুনাশক নিয়ে পরিষ্কার করুন। কোরবানির বর্জ্য অর্থাৎ গোবর, নাড়ি-ভূড়িসহ অন্যান্য উচ্ছিষ্ট নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে অথবা ময়লার কনটেইনারে ফেলুন। যাতে সিটি করপোরেশনের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাহিনী তা দ্রুত সরিয়ে নিতে পারে। সিটি করপোরেশন কোরবানির দিনের দুপুর ১২টার পর থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভিযানে নামবে।
হজ্ব ও কুরবানী: প্রতিবছরই মুসলমানদের মহামিলনের সমারোহ ঘটে হজ্বের সময়। তৌহিদী পতাকাতলে সমবেত হওয়ার এমন নজির অন্যকোন ধর্মে সাধারণত পরিলতি হয় না। একই ঐক্যতান ও একই উদ্দেশ্য লাভের আশায় মহান রাব্বুল আলামীনের প্রতি এই একনিষ্ঠ প্রয়াস সমগ্র বিশ্বকে অভিভূত করে তোলে। নানা দেশের, নানা বর্ণের এবং নানা ভাষার মানুষের মুখে যখন উচ্চারিত হয়ঃ ‘হে মহা সৃষ্টিকর্তা, আমি তোমার দরবারে হাজির হয়েছি, তুমিই একমাত্র প্রভু। নিশ্চয়ই আমি তোমার প্রশংসা করছি এবং তোমার নিয়ামতের প্রত্যাশা করছি। কারণ তুমিই সবকিছুর মালিক।’ লাখ লাখ উম্মতে মোহাম্মদীর কণ্ঠে সুমধুর ধ্বনি উচ্চারিত হয়ে আসছে গত চৌদ্দশত বছরেরও বেশি কাল ধরে। আর তৌহিদের ঘোষণাকারী হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের উচ্চারণ, নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রকাশ ও আত্মত্যাগের মহান দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা হচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে। পবিত্র হজ্ব ইসলামের পঞ্চম ও গুরুত্বপূর্ণ রোকন। হজ্বের একটি ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। হজ্বের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে জিয়ারতের উদ্দেশ্যে প্রতিজ্ঞা করা। শরীয়তের পরিভাষায় সার্বিক ইবাদত যা একজন মুসলমান জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ থেকে ১৩ জিলহজ্ব পর্যন্ত বায়তুল্লাহ শরীফে পৌঁছে যথাযথভাবে পালন করেন এবং যা বিশ্বমানবতা ও তৌহিদী পয়গাম থেকে উৎসারিত ও আল্লাহপাকের নৈকট্য লাভের এক বাস্তব দৃষ্টান্ত। হজ্বের মর্মকথা হচ্ছে ঃ যে ব্যক্তি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দেবে এবং মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) যে ইরাদা ও ইয়াকিনের সাথে মহান প্রভুর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করেছিলেন, তা পালন করবে। এ পবিত্র কোরানুল করিমে এ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ তিনিই ইব্রাহীম, যিনি তার রবের সাথে কৃত ওয়াদা পূরণের হক আদায় করেছেন। ইসলামের হজ্বের গুরুত্ব ও মাহাত্ম অপরিসীম। সুরা আল ইমরানে বলা হয়েছেঃ মানুষের ওপরে আল্লাহর এ অধিকার যে, বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছানোর যে শক্তি সামর্থ রাখে, সে যেন হজ্ব করে এবং যে এ নির্দেশ অমান্য করে ও কুফরের আচরণ করে তার জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ বিশ্বপ্রকৃতির ওপর অবস্থানকারীদের মুখাপেী নন। হযরত নবী করিম (সাঃ) এ সম্পর্কে বলেনঃ যে ব্যক্তির কাছে হজ্ব আদায়ের অর্থসামগ্রী আছে, যানবাহন আছে, যার দ্বারা মক্কা পৌঁছতে পারে, তারপর সে হজ্ব আদায় করে না, তাহলে সে অন্যধর্মী হয়ে মরুক, তাতে কিছু আসে যায় না।সারাবিশ্বে ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের বন্ধন রচনায় হজ্বের তাৎপর্য অপরিসীম। আরাফতের ময়দানে এই ভ্রাতৃপ্রেম খুলে দেয় এক নতুন দিগন্ত। নানা বর্ণের, নানা ভাষার মানুষগুলো এক রাব্বুল আলামীনের তাঁবেদার হয়ে যায়। গোটা বিশ্বের মুসলমানরা তখন একই মিল্লাতের মানুষ। সবাই এক আদমের সন্তান- পবিত্র হজ্ব এটাই আমাদের শিা দেয় এবং ইবাদতের পাশাপাশি মহামিলনের মাঝে বৃহৎ ঐক্য স্থাপনের নজিরই হচ্ছে পবিত্র হজ্ব।
পবিত্র কোরবানী: পবিত্র হজ্ব আদায়ের অন্যতম অংশ হচ্ছে কোরবানী। কুরব শব্দমূল থেকে কুরবানীর উৎপত্তি, যার অর্থ নৈকট্য। সোজা কথায় আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য আত্মোৎসর্গ করাই হচ্ছে কুরবানী। ১০ জিলহজ্ব হজ্বের এই বিধানটি পালন করা হয় এবং মুসলিম জাহানে কুরবানী ঈদ পালিত হয়। যা ঈদুল আজহা নামেও পরিচিত। পবিত্র কোরানুল করিমের সুরা হজ্বের আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেন, আমার নিকট পশুর রক্ত-মাংস-হাড় ইত্যাদি পৌঁছায় না, পৌঁছায় শুধু তোমাদের
অন্তরের তাকওয়া বা খোদাভীতি। মূলতঃ আমরা কোরবানীর মাধ্যমে কতটুকু আত্মত্যাগ এবং খোদাভীতির পরিচয় দিচ্ছি ও আল্লাহপাকের নির্দেশ কতটুকু পালন করছি, তা তিনি প্রত্য করেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তার প্রাণাধিক পুত্র ইসমাইলকে মহান রাব্বুল আলামীনের নামে উৎসর্গ করে আত্মসমর্পণের নজির স্থাপন করেন। আমাদের উচিত তার আর্দশে উদ্বুদ্ধ হওয়া এবং আত্মত্যাগের শিায় স্রষ্টার নির্দেশ ও বিধানসমূহকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করা। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) আল্লাহপাকের নির্দেশ পালনে এক মহান পরীায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। আমাদের উচিত স্রষ্টার প্রতিটি আদেশ-নির্দেশ অরে অরে পালন করা। ঈদুল আজহা শুধু গোশত ভণের উৎসব নয়, মানবিক কল্যাণে নিবেদিত হওয়ার এক মোম সময়। সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আমরা এ সময় সৌভাতৃত্বের বন্ধন গড়ে তুলতে পারি। অপরের কল্যাণে আত্মউৎসর্গ করতে পারি। কোরবানীর শিাই তাই। প্রতিযোগিতামূলক রক্তরণে কোরবানীর উদ্দেশ্য বিনষ্ট হয় জেনেও আমরা দাম হাঁকিয়ে কোরবানীর শর্তাবলী ভঙ্গ করি। মানবিক কল্যাণ সাধনের পরিবর্তে সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট করি। অপরদিকে দারিদ্র্যের হক আদায়েও কুণ্ঠা বোধ করি। আবার প্রাচীনকালে মিনায় যেভাবে কোরবানীর পশুকে নানান রঙে সজ্জিত করা হতো, কোরবানীর পশুর হাটে এ দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ে। এমনকি লৌকিকতা প্রদর্শনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শরীয়ত বিবর্জিত এসব কর্মকাণ্ড আমাদের সম্পূর্ণ পরিহার করে মানুষের পশু প্রবৃত্তি নিধনে নিজেকে উৎসর্গ করাই হজ্ব ও কোরবানীর একমাত্র উদ্দেশ্য।
কুরবানীর তাৎপর্য ও শিা: জিলহজ্বের দশ তারিখ এলে মুমিনের হৃদয়ে জেগে ওঠে হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর সেই সুমহান ত্যাগের স্মৃতি। প্রভু প্রেমে আপ্লুত হয়ে স্বীয় প্রাণ-প্রতিম পুত্র ইসমাইলকে কোরবানী করার যে কঠিন পরীায় তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তা এক বিরল ঘটনা। আল্লাহ তাঁর খলীলের সেই অকৃত্রিম ত্যাগকে মহাপ্রলয় পর্যন্ত স্মৃতির মিনারে অবিস্মৃত স্মৃতি হিসেবে ধরে রেখেছেন। ইসলামের অনুসারীরা হযরত ইব্রাহীম (আঃ)কে অনুসরণ করে কিয়ামত পর্যন্ত কোরবানী করতে থাকবে। ‘ঈদুল আজহা’ শব্দদ্বয় আরবি। ‘ঈদ’ অর্থ-খুশী; আর ‘আজহা’ অর্থ-কোরবানী বা আত্মোৎসর্গ তাই ‘ঈদুল আযহা’ অর্থ হলো-আত্মোৎসর্গের খুশী, স্বভাবতঃ প্রশ্ন আসতে পারে যে, কোরবানীর মধ্যে আবার খুশী কিসের? তাহলে এবার বুঝতে হবে যে, মূলত মুসলমানদের ঈদের খুশী সাধারণ অর্থে নয়; বরং এ খুশী হচ্ছে উৎসর্গ ও ত্যাগের মাধ্যমে ধর্মীয় কর্তব্য পালনের খুশী। ঈদুল আজহার সাথে কোরবানী সম্পৃক্ত বিধায় এটাকে কোরবানীর ঈদ বলা হয়।  ‘কোরবানী’ শব্দটা ‘কুরবানুন’ শব্দ থেকে উদ্ভূত। ‘কুরবানুন’ অর্থ হলো-নৈকট্য আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশ্যে আত্মোৎসর্গ করাই কোরবাণী। শরীয়তের পরিভাষায় কোরবানী বলা হয়-আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টির জন্যে জিলহজ্ব মাসের ১০ হতে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত নির্দিষ্ট কিছু পশু কোরবানী করা প্রতিটি সঙ্গতিসম্পন্ন মুসলমান যার নিত্যপ্রয়োজনীয় জীবনধারণের সামগ্রী ছাড়া নেসাব পরিমাণ সম্পদ অর্থাৎ সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা এর যে কোনো একটির সমমূল্যের সম্পদ রয়েছে, তার জন্য কোরবানী করা ওয়াজিব। কোরবানী ইসলামের অভিনব কোনো বিধান নয়। হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর শরীয়তের পূর্বেও এ প্রচলন ছিল। আল কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে- ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানীর একটি নিয়ম নির্দিষ্ট করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুষ্পদ জন্তু জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা হজ্ব, আয়াত: ৩৪) ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- হযরত আদম (আ:) থেকে হযরত মোহাম্মদ (সা:) পর্যন্ত সকল নবী-রাসুল ও তাঁদের অনুসারীরা কোরবানী করেছেন। তবে একেক উম্মতের কোরবানীর পদ্ধতি ছিল ভিন্ন রকম। ইতিহাসে প্রথম কোরবানী সংঘটিত হয় হযরত আদম (আ:) এর পুত্রদ্বয় হাবিল-কাবিলের মাধ্যমে। আল্লাহ তাদের কোরবানীর কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘(হে নবী!) আর আপনি তাদেরকে আদমের পুত্রদ্বয়ের (হাবিল-কাবিলের) ঘটনা সঠিকভাবে শুনিয়ে দিন। যখন উভয়েই এক-একটি কোরবানী উপস্থিত করল এবং তৎমধ্যে একজনের (হাবিলের) কোরবানী কবুল হয় আর অপরজনের কবুল হয়নি।  সেই অপরজন বলতে আরম্ভ করল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। উত্তরে সে বলল- আল্লাহ ধর্মভীরুদের কোরবানী কবুল করে থাকেন।’ (সুরা মায়েদাহ, আয়াত: ২৭) হযরত নূহ (আ:)-এর যুগেও কোরবানীর প্রথা চালু ছিল। এ প্রসঙ্গে মিসরের প্রখ্যাত আলেম ও ইতিহাসবিদ মুহাম্মদ ফরিদ ওয়াজদী বলেন, হযরত নূহ (আ:) জন্তু জবেহ করার জন্য পৃথক একটি কোরবানীগাহ নির্মাণ করেছিলেন। তাফসীরে হক্কানীর ভাষ্যানুযায়ী হযরত নূর (আ:) ও হযরত ইব্রাহিম (আ:)-এর শরীয়তেও দ্বীনের বিধানরূপে কোরবানী স্বীকৃত ছিল। বর্তমান বাইবেলেও বহু স্থানে কোরবানীর উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন ভারতবর্ষে নরবলির কুপ্রথা বিদ্যমান ছিল। কোরবানীর মধ্যে ইহলৌকিক-পারলৌকিক উভয় কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আল্লাহ আল কোরআনে বলেন, ‘আর (কোরবানীর) উটগুলোকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন করেছি। এতে তোমাদের বহু কল্যাণ নিহিত আছে।’ (সুরা হজ্ব, আয়াত: ৩৬) কোরবানীর সাথে জড়িত রয়েছে আমাদের সমাজের স্বার্থ। তাই আমাদের ভেবে দেখতে হবে, আমরা তা সঠিকভাবে পালন করছি কিনা। আমরা কোরবানীর গোশত সঠিক নিয়মে গরিব আত্মীয়-স্বজন বা গরিব-দুঃখীকে বিতরণ করছি কিনা। প্রকৃতপে কোরবানী প্রতিবছর আমাদের পশু হনন করতে আসে না, বরং পশু কোরবানীর মাধ্যমে পশু-প্রবৃত্তিকে বিসর্জন দিয়ে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার কোরবানী যে একটি উত্তম ব্যবস্থা সে সূক্ষ্ম কথাটি স্মরণ করিয়ে দিতে ঈদুল আজহা আসে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করাই বান্দার মূল ল্য। এ প্রত্যয়ের ওপরই হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর পে সম্ভব হয়েছিল কঠিন থেকে কঠিনতর পরীায় নিজেকে সমর্পণ করা। একইভাবে যুগে যুগে নবী-রাসুলগণ এই প্রত্যয়, এই ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির ল্েয নিজেদেরকে বিলিয়ে দিয়েছেন। পরবর্তীতে তাঁদের অনুসারীরাও তাঁদের অনুসৃত পথে চলেছেন। তাই আজ আমরা আমাদেরকে শুধু কোরবানীর প্রতীক হিসেবে পশু কোরবানীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। বরং তাঁদের মতো প্রভূপ্রেমে জাগরিত হয়ে জানমাল নিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসতে হবে। মানব কল্যাণের জন্য সকলকে উৎসর্গিত হতে হবে। পশু কোরবানীর সাথে সাথে পশু শক্তিকেও কোরবানী করে দিতে হবে। ইসলামের সঠিক দীা নিয়ে সুন্দর সচেতন সমাজ, পাপমুক্ত পরিবেশ, হিংসামুক্ত রাজনীতি, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, সন্ত্রাসমুক্ত দেশ, প্রেম ও ভালোবাসা বিজড়িত বিশ্ব গড়ে তুলতে হবে। ত্যাগ-উৎসর্গের মাধ্যমে অসহায় নিরন্ন-আশ্রয়হীন মানুষের মুখে হাসি ফোঁটাতে হবে। তবেই ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় জীবনে নেমে আসবে অনাবিল শান্তি, আর আদায় হবে কোরবানীর স্বার্থকতা। কোরবানী হতে হবে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশে। আল্লাহ বলেন, “আল্লাহর সমীপে না তার গোশত পৌঁছে, আর না তার রক্ত বরং আল্লাহর কাছে তোমাদের তাকওয়া পৌঁছে থাকে।” (সুরা হজ্ব, আয়াত: ৩৭)
পরিশেষে, কোরবানীর কিছু মাসআলা উল্লেখ করতে চাই। আশা করি পাঠকবৃন্দ এতে উপকৃত হবেন। কেউ কেউ মনে করেন যে, যাদের ওপর কোরবানী ওয়াজিব নয় তারা কোরবানী করতে পারবে না। এ ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক। বরং তারা কোরবানী করলে অধিক সওয়াব পাবেন। নিজের প থেকে কোরবানী করা ওয়াজিব। সন্তানের প থেকে পিতার ওপর কোরবানী করা ওয়াজিব নয়। তবে পিতা যদি নিজের মাল থেকে নাবালিগ ছেলের প হয়ে কোরবানী করেন তাহলে নফল হিসেবে গণ্য হবে। মৃত ব্যক্তির প থেকে কোরবানী করা যায়। আর এতে তিনি অধিক সওয়াবের অধিকারী হবেন। যদি কোনো ব্যক্তির দশজন ছেলে থাকে আর সবাই একান্নভুক্ত হয়, তাহলে শুধু পিতার ওপর একটি কোরবানী ওয়াজিব হবে। তবে ছেলেরা যদি ব্যক্তিগতভাবে নিসাবের মালিক হয়, তাহলে পিতার কোরবানী তাদের জন্য যথেষ্ট নয়, পৃথকভাবে তাদেরকেও কোরবানী করতে হবে। অনুরূপভাবে স্ত্রী নিজে ‘মালেকে নেসাব’ হলে তাকেও আলাদাভাবে কোরবানী করতে হবে। কোনো কোনো স্থানে প্রচলন রয়েছে যে, এক বছর নিজের নামে, এক বছর ছেলের নামে এবং এক বছর নিজ স্ত্রীর নামে কোরবানী করে, অর্থাৎ প্রতি বছর নাম পরিবর্তন করতে থাকেন। এটা ঠিক নয়। বরং যার ওপর কোরবানী ওয়াজিব, কেবল তার নামেই কোরবানী করতে হবে। কোরবানীর পশুতে কাউকে শরিক করার ইচ্ছে থাকলে খরিদ করার পূর্বেই ঠিক করে নিবে। কারণ একা কোরবানীর নিয়তে পশু খরিদ করার পর অন্য কাউকে শরিক করা মাকরুহ। তবে এমন ব্যক্তি যার ওপর কোরবানী ওয়াজিব নয়, সে একার নিয়তে খরিদ করার পর অন্যকে শরিক নিতে পারবে না। কোরবানীর গোশত নিজে খাবে, বন্ধু-বান্ধব এবং ধনী আত্মীয়-স্বজনকেও দেবে। এমনকি অমুসলিম প্রতিবেশীকেও দিতে পারবে। তবে মৃতের অছিয়তকৃত কোরবানী হলে সে গোশত কেবল গরীবদের মধ্যে সদকা করতে হবে। কোরবানীর গোশত, চামড়া ও তার মূল্য দ্বারা কসাই এবং জবেহকারীকে পারিশ্রমিক দেওয়া বৈধ নয়। পৃথকভাবে তাদের মজুরি দিতে হবে। চামড়ার বিক্রয়লব্ধ সমুদয় অর্থ গরিবকে সদকা করা ওয়াজিব। হালাল প্রাণীর ৮টি অংশ ছাড়া অন্য সবকিছু খাওয়া বৈধ। নিষিদ্ধ ৮টি অংশ হলো- উভয় লিঙ্গ, মূত্র থলি, পিঠের হাড়ের মধ্যকার সাদা রগ, চামড়ার নিচের টিউমারের মতো উচু গোশত, অন্ডকোষ, পিত্ত ও প্রবাহিত রক্ত। কোরবানীর তাৎপর্য বুঝে আল্লাহ সকলকে কোরবানী করার ও তার শিা গ্রহণের তাওফিক দান করুন। আমীন!



†jLK: W.†dviKvb Avjx
M‡elK I mv‡eK Aa¨¶
36 MMbevey †ivo,Lyjbv
01711579267

0 comments:

Post a Comment