মরণোš§ুখ ঢাকা, বিষণœ মানুষ
আলী ফোরকান
কসমস বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং কয়েক বছর আগে জাপান গিয়েছিলেন। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাকাশ বিষয়ে বক্তৃতা দেয়ার কথা তার। ওই সময় একটা কার্টুন বেরিয়েছিলÑ টোকিওর শেয়ারবাজারের রথী-মহারথীরা হকিংকে বলছেন, স্যার আপনি বক্তৃতায় যা-ই বলুন, এমন কথা বলবেন না পি¬জ, পৃথিবী খুব শিগগিরই ধ্বংস হয়ে যাবে। হকিং অবশ্য বক্তৃতায় বলেছিলেন, আগামী অন্তত ২৬ হাজার বছর এ পৃথিবীর বড় ধরনের গাঠনিক কোন পরিবর্তন হবে না। হকিং সমাজবিজ্ঞানী নন। বিশ্বমানের কোন সমাজবিজ্ঞানীকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া যেতে পারে, ঢাকা শহর পড়ষষধঢ়ংব করতে কতদিন লাগতে পারে? এখানে পড়ষষধঢ়ংব মানে শহরের দালানকোঠাসহ সব কাঠামো ভেঙে পড়া বোঝানো হচ্ছে না। বোঝানো হচ্ছে, ঢাকা সম্পূর্ণরূপে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়তে কতদিন সময় লাগবে? একটা সময় ছিল, পাশ দিয়ে একটা গাড়ি ছুটে গেলে সেটার দিকে তাকিয়ে ভাবতামÑ গাড়িটা কার? তখন গাড়ি মানে তার মালিক বিলাত ফেরত ডাক্তার অথবা বিদেশ থেকে পিএইচডি করে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা প্রথম শ্রেণীর কোন ঠিকাদার। এখন বড়সড় একটা ডিপার্টমেন্ট স্টোরের মালিক হলেই কেনা যায় একটি গাড়ি এবং তারা তা কিনছেনও। অন্যদিকে মানুষ বাড়ছে, বাড়ছে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কী মাত্রায় বেড়েছে, একটা উদাহরণ দিলেই তা বোঝা যাবে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর পর্যন্তও ঢাকা থেকে ২৪ ঘণ্টায় ২০ আসনের মাত্র একটি বিআরটিসির কোচ রংপুর যেত। জনসংখ্যা এখন ১৫ কোটি, অর্থাৎ সে সময়ের দ্বিগুণ হয়েছে। অঙ্কের হিসাবে এখন ঢাকা থেকে একটি ৪০ সিটের কোচই যথেষ্ট রংপুর গমনেচ্ছুদের জন্য। কিন্তু পাঠকই বলতে পারবেন, দিনরাত মিলিয়ে এখন কয়শ’ কোচ বা বাস উত্তরবঙ্গে চলাচল করছে। যমুনায় ব্রিজ হওয়ার পর ঢাকা থেকে রংপুর যেতে সময় লাগত পাঁচ ঘণ্টা। এখন লেগে যাচ্ছে সাড়ে ছয় থেকে ৭ ঘণ্টা। রাজধানী ঢাকাকে বলা যেতে পারে বাংলাদেশের স্প্রিং বোর্ড। ঢাকার কাঁটা নড়াচড়া করলে দেশের অন্য জায়গাগুলোর কাঁটাও নড়ে উঠবে। ঢাকার অবস্থা কী, তা বোঝার জন্য একটা ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। কয়েকদিন আগে রিকশায় যাচ্ছিলাম। সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একজন। রাস্তায় লোক গিজগিজ করছে। সহযাত্রী বললেন, এই যে এত লোক, একজনের মুখে হাসি দেখান তো। লক্ষ্য করলাম, সবার মুখই উদ্বিগ্ন অথবা বিষণœœ। স্বাভাবিক মুখচ্ছবি ফুটে নেই কারও চেহারায়। সত্তর দশকের মাঝামাঝি মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী ক্লে সোভিয়েত ইউনিয়ন গিয়েছিলেন। ক্রেমলিন প্রাসাদে কমিউনিস্ট নেতা ব্রেজনেভের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি বলেছিলেনÑ মস্কোর রাস্তায় যাদের দেখলাম, তারা এত কিসের টেনশনে ভুগছে? মনে হচ্ছে সবাই আÍহত্যা করার জন্য ইলেকট্রিক চেয়ারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ছিল, তাই মানুষের চোখে-মুখে এক ধরনের গাম্ভীর্য থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক ও ফ্রি সোসাইটি হওয়ার পরও রাস্তায় মানুষের চেহারা এত রাশভারি কেন? মানুষ আসলে এখন হাসতে জানে না, কাঁদতেও না। অ ংরহমষব ফবধঃয রং ধ ঃৎধমবফু, ধ সরষষরড়হ রং ংঃধঃরংঃরপংÑ একটি মৃত্যু ট্রাজেডি, লাখো মৃত্যু পরিসংখ্যান মাত্র কথাটাই ফলছে এ দেশে। মানুষের সুখানুভ‚তি নেই, দুঃখানুভ‚তিও; সে শুধু শিখে চলেছে কিভাবে বেঁচে থাকা যায়। দেশ, বিশেষত ঢাকার পরিবেশের ওপর মহাবিরক্ত এমন এক বন্ধুকে সম্প্রতি প্রশ্ন করেছিলাম, মন ভালো হওয়ার মতো কোন ঘটনাই কি নেই দেশে? তেমন অন্তত একটা কিছু বল। সে উত্তর করল, হ্যাঁ আছে। শহরের দূরবর্তী কোন এলাকায় যাওয়ার সময় যদি বাসে সিট পেয়ে যাই ও দেখি রাস্তায় তেমন জ্যাম নেই, তখন একটা প্রশান্তির ভাব আসে মনে। এ বন্ধুটিই আমাকে আরেকদিন বলেছে, শরীরের যে অবস্থা, বেশিদিন বোধহয় বাঁচব না। তবে কোন আক্ষেপ নেই। কারণ আমি যাদের ফেলে রেখে যাচ্ছি, তারা যে নরকে বাস করবে তার চেয়ে বড় কোন নরকে যাচ্ছি না আমি। নগরায়নের সময় পৃথিবীর সব দেশেই খেয়াল রাখা হয়, রাস্তা যেন মোট জমির ২২ শতাংশের কম না হয়। এদেশে এই হার কারা কিভাবে কমিয়ে আনল, তার কোন জবাবদিহিতা নেই। কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া ও কমলাপুরে আসা ট্রেনের সংখ্যা প্রতিদিন ৬৮। ট্রেনগুলোকে ঢাকা শহর পার হতে ৭টি রেল ক্রসিং স্পর্শ করতে হয়। প্রতি ক্রসিংয়ে যদি ৩ মিনিট করেও জ্যাম লাগে, তাহলে মোট কত ঘণ্টা জ্যাম তৈরি হয় তাতে? অথচ কোন ক্রসিংয়েই ফ্লাইওভার নেই (মহাখালী ও খিলগাঁও রেল ক্রসিংয়ে যে দুটি ফ্লাইওভার আছে, সেগুলো ট্রেনের জন্য কার্যকর নয়)। অথচ দালানকোঠা, অট্টালিকা বেড়ে উঠছে হু হু করে। পৃথিবীর সব বড় শহরেই রেলক্রসিং মানে সেখানে একটি ফ্লাইওভার। আসলে আমরা একটা বেকুব জাতিতে পরিণত হয়েছি। আমাদের জন্য যা করা হচ্ছে, আমাদের যা বলা হচ্ছে তা-ই মেনে নিচ্ছি। সেদিন আরেক বন্ধু বললেন, আমাদের কতটা বেকুব মনে করা হয় তার প্রমাণ, ইব্রাহিম হত্যার পরপর আমাদের বিশ্বাস করতে বলা হয়েছিল, সে পিস্তল নাড়াচাড়া করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। সংসদ সদস্য নূরুন্নবী চৌধুরী শাওনের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, পিস্তল বিষয়ে ইব্রাহিমের যথেষ্ট পাণ্ডিত্য ছিল। সাধারণ নাগরিক, যারা আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যাপারে অজ্ঞ তাদের সম্পর্কে কথাটা বললে কিছুটা মানাতো। গুলি লেগেছে আবার গলায়। তার মানে ইব্রাহিম পিস্তলটি গলার সামনে ধরে নাড়াচাড়া করছিলেন! রাজনৈতিক নেতৃত্বের মুখে দেশপ্রেমের বুলির অন্ত নেই। সবাই একেকজন পেটেন্ট দেশপ্রেমিক। টেলিভিশন খুললেই দেশপ্রেমের জয়জয়কার। রেডিও-টেলিভিশনে একের পর এক বেজে চলেছে দেশাÍবোধক গান, পণ্যের বিজ্ঞাপনেও দেশপ্রেমের ছোঁয়া। পৃথিবীর কোন দেশে এমন ঘটে কিনা, জানতে হলে বিস্তর ঘাঁটতে হবে। আমেরিকা প্রস্ফুটিত হয়েছে গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। সেই গৃহযুদ্ধ নিয়ে তাদের বাড়াবাড়ি নেই। জর্জ ওয়াশিংটনকে তারা শ্রদ্ধা জানিয়ে রেখেছে রাজধানীর নামকরণে তার নাম ব্যবহার করে। ব্যস ওইটুকু এবং তা যথেষ্ট। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নামে রয়েছে হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামাজিক সংগঠনও রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে কতটা ছোট ভাবলে এমন করা যেতে পারে। কথায় কথায় বলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। নতুন প্রজšে§র কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার তাৎপর্য কী? তাদের কি বোঝানোর চেষ্টা চলছে, দেশটার পাকিস্তানের অংশ হওয়ার আশংকা রয়েছে আবার? মুক্তিযুদ্ধ একটা মীমাংসিত অধ্যায়। এ দেশ আর কখনই পাকিস্তানের অংশ হবে না। কনফেডারেশনও সম্ভব নয়। তা হলে আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কেন? দরকার একুশ শতকের চেতনা। বস্তুত এ প্রজšে§র কাছে দেশপ্রেমের ধারণাটাই অন্যরকম। সে এখন আর সিটিজেন নয়, সে নেটিজেন। ইন্টারনেটে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে সমগ্র পৃথিবী। সে আমেরিকা, ইউরোপ অথবা অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার জন্য ব্যস্ত। তাই বলে কি তার মধ্যে দেশপ্রেম নেই? অবশ্যই আছে। সেটা হচ্ছে সে এমন কিছু করতে চায়, তা দেশে অথবা বিদেশে, যা তার জীবনকে অর্থবহ করে তুলবে ও একই সঙ্গে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। মানুষের প্রকৃত সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে না। জোলো রাজনৈতিক ইস্যু ও বিতর্কে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এ ধরনের নেতৃত্বের আয়ু আর কতদিন, কে জানে।
0 comments:
Post a Comment