প্রকৃতির নিরব প্রতিশোধ: বির্পযস্ত পরিবেশ
আলী ফোরকান
প্রাচীনকাল থেকে পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ বর্তমান পাহাড়ের পরিবেশ বিশাল পার্থক্য রয়েছে। পাহাড়ের গায়ে পাহাড়িরা জুম চাষ করে আসছিল। কিন্তু পাহাড়িরা কখনও পাহাড়ের কোন ক্ষতি করেননি বা ক্ষতি করতে দেননি। কারণ পাহাড়িদের মধ্যে একটা দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, প্রয়োজনে প্রকৃতির দান গ্রহণ করো এবং প্রকৃতিকে রক্ষা করো।
পাহাড়ের গায়ে ছোট বড় মাঝারি সব ধরনের গাছ ছিল, ছিল ঝোপঝাড়, লতাপাতা, আর বাঁশঝাড়ের তো কোন অভাবই ছিল না। পাহাড়ের মাটি ধরে রাখতে বাঁশঝাড়ের কোন জুড়ি নেই। আমাদের দেশে প্রায় ২৫ প্রজাতির বাঁশ আছে। তার মধ্যে প্রায় ১০ প্রজাতির বাঁশ জন্মে বাংলাদেশের পাহাড় এবং পাহাড়ের আশ পাশের অঞ্চল থেকে এসেছে।
বাংলাদেশের প্রায় ৯৫০ প্রজাতির বন্য প্রাণী আছে। এর মধ্যে ১২৫ প্রজাতি হলো স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৬৫০ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির সরীসৃপ ও প্রায় ৪০ প্রজাতির উভচর। যেমনি বনভূমি বেশি দেখা যায় বাংলাদেশের সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে তেমনি বন্য প্রাণীও বেশি দেখা যায় ওই এলাকাগুলোতে। পাহাড়িদের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী শিকার করে খাওয়া, তবে তাদের জনসংখ্যা বেশি না থাকায় বণ্যপ্রাণী ও পরিবেশের ওপর কম সময়ে বড় ধরনের কোন পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো ছিল না। সব কিছু মিলে সবুজ পাহাড় উদ্ভিদ ও প্রাণী নিয়ে বেশ ভালই ছিল। তবে পাহাড়ি এলাকায় কোথাও কোন পরিবেশ বিপর্যয়কারী কোন কাজ হতো না, তা বলা যেত না।
তবে পাহাড় এবং পাহাড়িদের মধ্যে যে নিবিড় ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ছিল তার ব্যতিক্রম ঘটনার অবতারণা হলো উপমহাদেশের ব্রিটিশদের উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা চালুর মধ্য দিয়ে। এর ব্যতিক্রম হয়নি বাংলাদেশেও। ব্রিটিশ বেনিয়াদের লক্ষ্য ছিল লুটেপুটে নিয়ে যাওয়া এবং অর্থ সংগ্রহ করা। ফলে তারা পাহাড়ি এলাকার দেশীয় বন্য উদ্ভিদ উজাড় করে, সেখানে বিদেশিগাছের চারা রোপণ করতো ত্বরিত অর্থ প্রাপ্তির লালসায় তাদের ওই ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডে আমাদের প্রকৃতির অনেক ক্ষতি হয়েছে।
পরবর্তী পাকিস্তান আমলে বিদেশী প্রজাতির গাছের চাষ আরও বেড়ে যায়। দেখা দেয় প্রকৃতির স্বাস্থ্যের বিপর্যয়। ফলে দেশি প্রজাতির অনেক উদ্ভিদের বিলুপ্তি ঘটে। বন্য প্রাণীর সংখ্যা দিনে দিনে কমে যায় এবং এর দ্বারা বন্য প্রাণীর অস্তিত্বের পথে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে অনেক বন্য প্রাণী।
ইংরেজ ও পাকিস্তানীরা আমাদের যে ক্ষতি করেছে তার প্রতিকার অসম্ভব। তবে তাদের সেই বৈরি মনোভাব যে ক্ষতি করেছে তার প্রতিকার না করে বরং স্বাধীনতা উত্তর আমরাও এখন বনভূমির ধ্বংসের পথে নেমেছি। বরং পাহাড়ে বসবাসকারী গরিব ও অসহায় লোকদের জীবন কেড়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। কারণ পাহাড়ের পাদদেশে গাছপালা কেটে আবাসন তৈরি করছে। ফলে প্রকৃতির পাশে কেউ না দাঁড়ালে প্রকৃতি নিজেই নিজের মতো করে প্রতিশোধ নিচ্ছে।
প্রতি বছর বেড়ে যাচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। আর সর্বশেষ যোগ হয়েছে এ সময়ে বন্যা ও ভূমিধস। ওই ভয়াবহ ভূমিধসের ফলে রাঙামাটি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যসহ প্রায় ১৬০ জন লোকের প্রাণহানি হয়, ধ্বংস হয় হাজার হাজার বাড়িঘর, ধ্বংস হয় সড়ক মহাসড়ক। সেই সব বিপর্যস্ত পাহাড়িরা এখন সর্বস্বান্ত হয়ে বিপদের মহাসমুদ্রে অবস্থান করছেন। একদিকে স্বজন হারানোর শোক, অন্যদিকে বাসগৃহ, সম্পদ, অর্থ হারিয়ে অতিকষ্টে জীবন পাড়ি দিচ্ছেন ঐসব পাহাড়ি আদিবাসী ও বাঙালি জনগণ।
তো এখন প্রশ্ন জাগতে পারে তাহলে কেন এমন মহাবিপর্যয় আসলো পাহাড়ি এলাকায়। অতি মাত্রায় জনগণের আগমন, বেশি বেশি আবাসন নির্মাণ করা, অধিকহারে গাছ পালা উজাড় করা এবং সর্বোপরি পাহাড় কেটে পাহাড়ের ঢালে আবাসন নির্মান করাকে চিহ্নিত করা যায়। ফলে বন্যা, অতিবৃষ্টি ডেকে আনে এইসব বিশাল মানবিক বিপর্যয়। এরপরই প্রশ্ন জাগবে তাহলে আমাদের সবুজে ঢাকা পাহাড় কাটছে কারা? আসলে পাহাড় কাটছে প্রভাবশালীরা- যারা সব সময়ই ধরা ছোঁয়ার বাহিরে থাকে। প্রশাসন তথা সরকার তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয় যুগে যুগে। কারণ তারা যুগে যুগে গড়ে তুলেছে অর্থের পাহাড়, সেই অর্থ দিয়ে ম্যানেজ করছেন প্রশাসনকে। অথবা যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন তাদের দলীয় আর্শিবাদপুষ্ট লোকজন, সরকারের প্রভাবের কারণে স্থানীয় প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে না। যদিও সংবাদ মাধ্যমগুলো চেষ্টা করে, এগুলো সরকার ও প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে।
যাদের বাবা হারিয়েছে, যাদের পরিবারের সদস্যদেকে হারিয়েছেন এই সব ভূমিধস/পাহাড় ধসের মাধ্যমে অথবা যাদের একমাত্র অবলম্বন হারিয়েছেন আমাদের/অথবা যারা কোন বিচার বিবেচনা না করে পাহাড় গাছপালা কেটেছেন তাদের কাছে কি এসব প্রশ্নের আদৌ উত্তর জানা আছে, আছে কি কোন সান্তনার বাণী। সেনাবাহিনীর একজন মেজর, ক্যাপ্টেন সহ আর যে দুই জন সেনা সদ্যকে হারিয়ে ফেলেছে, তাদের পরিবারকে কে শোনাবে উজ্জল ভবিষ্যতের কথা?
এরকম ভূমিধস অনেক আগে থেকে সংঘটিত হচ্ছিল এসব পাহাড়ি এলাকায়। যার ফলে আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগে সরকারের পক্ষথেকে ১১ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। সেই টাস্কফোর্স স্বল্পমেয়াদি, মধ্য মেয়াদি ও দীর্ঘ মেয়াদী সুপারিশ করেছিল বলে জানা যায়। তবে সেই সুপারিশের আলোকে সরকার কি ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল, তা আজ পর্দার আড়ালে থেকে গেছে। পাশাপাশি জানা যায়নি, কারা পাহাড় কাটে? কারা প্রকৃতিকে ধ্বংস করে? কাদের কারণে ঐ মৃত্যুর মিছিল বাড়ে? সেক্ষেত্রে ওই টাস্কফোর্সের সুপারিশগুলো কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে? তা নিয়ে এখনও মানুষের জানার আকাঙ্খা। পাহাড় ধসে মৃত্যুর জন্য মানুষ নামের অ মানুষরাই অবশ্যই দায়ী।
অতএব আসুন এই জীবনবিনাশী, প্রকৃতি ধ্বংসকারী কার্যক্রমকে প্রতিরোধ করি, বেশি করে জনসচেতন বাড়াই। দোষীদের শাস্তির আওতায় এনে বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে সোচ্চার হই। বাঁচতে সাহায্য করি কিছু গরীব, অসহায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও বাঙালি জনগণকে যাঁরা ওই প্রকৃতিকে সঙ্গী করে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারকে বলিষ্ঠ এবং কঠোর ভূমিকা ও পদক্ষেপ নিতে হবে। আসুন সবাই মিলে বলি “লও সে নগর, দাও সে অরন্য।”
0 comments:
Post a Comment