Friday, August 19, 2016

ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কৌশল বদল

ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কৌশল বদল 
আলী ফোরকান
ইয়াবা বাণিজ্যের কৌশল বদলেছে মাদক ব্যবসায়ীরা। এখন গাদা বা বাহক ব্যবহার না করে নিজেরাই চালান পৌঁছে দিচ্ছে রাজধানীতে। কক্সবাজারের চিহ্নিত ইয়াবা সিন্ডিকেটের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে ইয়াবা পৌঁছে দিচ্ছে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়। কিছুদিন পরপর হাজার হাজার ইয়াবা একসঙ্গে পাঠাচ্ছে তারা। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে ইয়াবার চালান ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ জেলায় যাচ্ছে। আর রাজধানীর আবাসিক হোটেলে বসে এসব ইয়াবার চালান হাতবদল হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) অভিযানে কয়েকটি চালান ধরা পড়ার পর মাদক ব্যবসায়ীদের এ কৌশল ধরা পড়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর কমলাপুর এলাকায় একাটি প্রাইভেট কারে পাওয়া যায় ৪৫ হাজার পিস ইয়াবা। এ সময় গ্রেপ্তার করা হয় ছয় যুবককে। ইয়াবার এই চালানটি এযাবৎকালে রাজধানীতে পুলিশের হাতে আটক হওয়া সবচেয়ে বড় চালান। এর আগে ফকিরাপুলের একটি আবাসিক হোটেল থেকে চার হাজার ইয়াবার চালানসহ গ্রেপ্তার করা হয় ছয়জনকে।  খিলগাঁও উড়াল সড়কের কাছে একটি মাইক্রোবাসে সাত হাজার পিস ইয়াবাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। মহানগর পুলিশ জানান, সাধারণত ইয়াবা ব্যবসায়ীরা বাহক দিয়ে রাজধানীতে ইয়াবার চালান পাঠায়। অতীতে কক্সবাজার বা টেকনাফ থেকে আসা চালানসহ আটক হওয়া ব্যক্তিরা নিজেদের বহনকারী বলেই পরিচয় দিয়েছে। তাই ব্যবসায়ী বা পাইকারি বিক্রেতা চক্রের মূলে যেতে পারত না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এসব বহনকারী চতুর না হওয়ার কারণে প্রায়ই ধরা পড়ে। তাই সম্প্রতি কৌশল বদলেছে মাদক ব্যবসায়ীরা। এখন নিজেরা নিজস্ব গাড়িতে করে ইয়াবা ঢাকায় নিয়ে আসছে। সে কারণে তারা ঝুঁকি নিয়ে একই সঙ্গে অনেক ইয়াবা নিয়ে আসছে। এ তৎপরতার কারণে ঢাকা মহানগর পুলিশ নজরদারি জোরদার করেছে। একের পর এক চালানও ধরা পরছে। ৪৫ হাজার ইয়াবার চালানটি রাজধানীতে পুলিশের হাতে আটক হওয়া সবচেয়ে বড় চালান। ডিএনসিসির ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলের উপপরিচালক বলেন, 'মাদক ব্যবসায়ীরা ইয়াবা নিয়ে আসে না নিজেরাই। একবারে অল্প পরিমাণ ইয়াবার চালান পাঠায় তারা, এ প্রবণতা পুরনো। এখন দেখা যাচ্ছে, ঝুঁকি নিয়ে বড় আকারের চালান পাঠাচ্ছে তারা। তাই চট্টগ্রাম রুটের দিকে আমাদের বিশেষ নজরদারি আছে।' গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, রাতে প্রাইভেট কারে করে পাচারের সময় কমলাপুরে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয় শামসুল হুদা, শামছুল আলম, শাহীন ওরফে জুয়েল, সৈয়দ আলম, আবদুল খালেক ও গাড়িচালক আবদুল গফুর। ডিবির মাদক উদ্ধার দল পুলিশ সদর দপ্তরের একটি দলের সহযোগিতায় ওই বিশেষ অভিযান চালায়। অভিযানকালে একটি এক্স করলা প্রাইভেট কারে (ঢাকা মেট্রো: গ-২৩-৮৪৭০) রাখা ৪৫ হাজার পিস ইয়াবার চালান আটক করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানায়, কক্সবাজারের টেকনাফ থানার নীলা এলাকার ইয়াবা ব্যবসায়ী নূরুল হুদার কাছ থেকে চালানটি নিয়ে বিক্রির উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসে তারা। নূরুল হুদা তার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়ই চালানটি পাঠায়। এসব ইয়াবা আজিমপুর এলাকার ইয়াবা ব্যবসায়ী জুয়েল, খিলগাঁও এলাকার রমজান ও বনশ্রী এলাকার আসমার কাছে বিক্রি করার কথা ছিল। পুলিশ কর্মর্কর্তারা জানিয়েছেন, গ্রেপ্তার হওয়া শামসুল হুদা ইয়াবা ব্যবসায়ী নূরুল হুদার ছোট ভাই। ঘটনার দুই দিন আগে জেল থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে ছোট ভাইসহ সঙ্গীদের দিয়ে রাজধানীতে ইয়াবার চালানটি পাঠায় নূরুল। আটক করা প্রাইভেট কারটি নূরুলের বলেই প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে পুলিশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নূরুল হুদা ও শামসুল হুদা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী। গ্রেপ্তার হওয়ার পর শামসুল হুদা জানায়, ইয়াবার চালানটির কিছু অংশ হেলাল ও বোরহান নামের দুই মাদক ব্যবসায়ীর। এদের সহায়তায় রাজধানীর কেরানীগঞ্জ থেকে ইয়াবা বিক্রি করেন শামসুল। ডিবির সহকারী কমিশনার (এসি) জানান, ফকিরাপুল বাজারের হোটেল আলীজার পঞ্চম তলার ৫০১ নম্বর কক্ষে অভিযান চালিয়ে তিন হাজার ৯৩০টি ইয়াবা, ছয় লাখ ৫৮ হাজার ৫০০ টাকাসহ ছয়জনকে আটক করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত সারোয়ার কামাল, মুক্তার হোসেন, মঞ্জুর আলী, নাছিম, কামাল ওরফে হৃদয় নামের পাঁচজনের বাড়ি কক্সবাজারে। আবদুল জব্বার নামের অপর ব্যক্তির বাড়ি বরিশালে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তারা টেকনাফ থেকে কৌশলে ইয়াবা সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে। রাজধানীতে হোটেলে বসে চালান হাতবদল করে তারা। ডিবি সূত্রে জানা যায়, খিলগাঁও উড়াল সড়কের কাছে একটি মাইক্রোবাসে তল্লাশি চালিয়ে সাত হাজার পিস ইয়াবাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত আয়েজ, ইলিয়াস ও গাড়িচালক নুর মোহাম্মদের বাড়ি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার নীলাবাজার এলাকায়। আমিনুল ইসলাম ওরফে আমিন নামের অন্যজনের বাড়ি কক্সবাজার সদরে। তারা টেকনাফ থেকে বিভিন্ন কৌশলে ইয়াবা ট্যাবলেট চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পাইকারি হিসেবে সরবরাহ করত। রাজধানীতে ইয়াবা আনার জন্য তারা মাইক্রোবাস ভাড়া করে। গ্রেপ্তার হওয়া আমিন জানায়, টেকনাফে খালেক নামের একজন তাকে ইয়াবার চালানটি দেয় রাজধানীতে নিয়ে আসার জন্য। গাড়িচালক নুর মোহাম্মদ জানায়, একবার চালান নিয়ে ঢাকায় এলে ৩৫ হাজার টাকা পায় সে। গ্রেপ্তার হওয়ার আগের মাসেও একটি চালান নিয়ে আসে নূর মোহাম্মদ। ডিএনসিসির পরিদর্শক জানান, ফকিরাপুলের আলীজা আবাসিক হোটেলে অভিযান চালিয়ে চারজনকে এক হাজার ৪০০টি ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো সেলিনা আক্তার, হাবিবা, মাহবুব আলম ও শাহাবুদ্দিন। তারা কক্সবাজার থেকে মাইক্রোবাসে ইয়াবার চালানটি নিয়ে ঢাকায় আসে। চারজন স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে আলীজা হোটেলের ৪০৮ ও ৪০৯ নম্বর কক্ষ ভাড়া নেয়। তবে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গী ছাড়া তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। হোটেল থেকেই চালানটি খুচরা বিক্রেতাদের সরবরাহ করার কথা ছিল। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেপ্তার হওয়া নারী হাবিবা রোহিঙ্গা। তারা সবাই ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, 'অভিযানে ইয়াবাসহ ধরা পড়া বেশির ভাগই বাহক। স্থানীয় ভাষায় এদের গাদা বলা হয়। এদের গ্রেপ্তার করা হলেও কারবারি পর্যন্ত যাওয়া যায় না। দু-একজন ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করতে পারলে সিন্ডিকেটের খবর জানা যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এ ঘৃণিত ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করতে পারলে দেশের যুব সমাজ মাদক মুক্ত হবে।

0 comments:

Post a Comment